প্লেগের বিরুদ্ধে লড়ছেন অবনীন্দ্রনাথ, প্লেগ ছিনিয়ে নিয়ে গেল তাঁর ছোট্ট মেয়েকেই 

কলকাতা জুড়ে তখন প্লেগের আতঙ্ক। চারপাশে মৃত্যু। কিছুতেই আর স্থির থাকতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ এবং আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন চাঁদা তোলা। খোলা হল প্লেগ হাসপাতাল। প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতেই মহামারী থাবা আছড়ে পড়ল অবনীন্দ্রনাথের নিজের বাড়িতেই। ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে গেল মৃত্যু। এই ধাক্কা সহজে মেনে নিতে পারেননি অবনীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর বাড়ি জুড়ে মেয়ের স্মৃতি। সেই বাড়ি সহ্য হচ্ছিল না। চলে এলেন চৌরঙ্গীর একটি বাসায়। পাখি পুষলেন।

কিন্তু, ক্ষত কিছুতেই জুড়োচ্ছিল না। তখন আঁকতে বসলেন ছবি। জন্ম নিল বিখ্যাত ‘শাহজাহানের মৃত্যু’ ছবিটি। নিজেই বলেছিলেন, ‘মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম।’ এই ছবিই ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথের প্রথম ছবি। ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবারে একটি চিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। সেই প্রদর্শনীতে রুপোর মেডেল জিতে নিয়েছিল ‘শাহজাহানের মৃত্যু’। সন্তানশোকের ফসল একটি ছবি স্বীকৃতি পেল দেশের তাবড় শিল্পরসিকদের কাছে।

মৃত্যুর সঙ্গে ছবির অদ্ভুত সব সমাপতন অবনীন্দ্রনাথের জীবন জুড়ে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট। অবনীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মদিন। অথচ, এমন দিনকেও জড়িয়ে নিল শোক। নশ্বর জীবনের সমস্ত ‘লেনাদেনা’ চুকিয়ে চিরতরে চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। এই শোকের মধ্যে ফের ছবির কাছেই আশ্রয় খুঁজতে চাইলেন অবনীন্দ্রনাথ। দক্ষিণের বারান্দায় বসে অবনীন্দ্রনাথ তখন আঁকছেন ‘রবিকাকা’-র শেষযাত্রার ছবি। সেখানে অসংখ্য ঊর্ধমুখী হাতের সারি। কবির মৃতদেহ যেন চলেছে অমৃতলোকে। এই ছবিও ছাপা হয়েছিল ‘প্রবাসী’-তেই।   

নিজের প্রিয় ভাইপোকে রবীন্দ্রনাথ বলতেন, “অবন একটা পাগলা।” নিজের গোটা বইয়ের জন্য প্রথম ছবি আঁকার ভার দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথকেই। একুশ বছরের যুবক অবনীন্দ্রনাথ তখন মিঃ গিলার্ডির কাছে আঁকা শিখছেন। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ এল, ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্যের জন্য ছবি এঁকে দিতে হবে। অতএব, বত্রিশটি স্কেচ করে দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রথম ইলাস্ট্রেটর। অবনীন্দ্রনাথ পরে লিখেছিলেন, “চিত্রাঙ্গদা তখন সবে লেখা হয়েছে। রবি’কা বললেন ছবি দিতে হবে। আমার তখন একটু সাহসও হয়েছে, বললুম রাজী আছি। সেই সময় চিত্রাঙ্গদার সমস্ত ছবি নিজের হাতে এঁকেছি, ট্রেস করেছি। চিত্রাঙ্গদা প্রকাশিত হলো। এখন অবশ্য সেসব ছবি দেখলে হাসি পায়।”

অবনীন্দ্রনাথকে জুড়ে আছেন ‘রবিকাকা’। তাঁর লেখার উৎসাহদাতা, আঁকার সমালোচক। সামাজিক নানা উদ্যোগেও কাকার সঙ্গে বারবার জড়িয়ে গেছেন অবনীন্দ্রনাথ। আর, তিনি নিজে এক অমল মানুষ। ছোটোবেলায় ভারী দুরন্ত মানুষটি নিজেকে মনে করতেন ‘খ্যাপা’। বারবার মেতে উঠতেন নানা কাজে। অথচ বলতেন, “কর্মজীবন বলে আমার কিছু নেই, অতি নিষ্কর্মা মানুষ আমি। নিজে হতে চেষ্টা ছিল না কখনও কিছু করবার, এখনও নেই। তবে খাটিয়ে নিলে খাটতে পারি, এই পর্যন্ত।” আর, নানা আঘাতে, মৃত্যুতে বারবার আশ্রয় খুঁজতেন ছবির কাছে। ছবি আর শোক তাঁর জীবনে সমাপতিত, বারবার। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.