প্রাচীন বাংলার বৃহত্তম টাকশাল

মুর্শিদাবাদের এলাহিগঞ্জের এক ভাঙা ঢিপি খোঁড়ার সময় কুলিরা পেয়েছিলেন একঘড়া মোহর। মোহরগুলির অনুসন্ধান শুরু হয়। রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানায় যে, মোহরগুলি  মুর্শিদাবাদের নিজস্ব টাকশালে তৈরি। উদ্ধার হওয়া এক হাঁড়ি মোহরের পঁয়ষট্টিটি রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে রয়েছে।

নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদে টাকশাল ছিল। মুদ্রা তৈরির কারখানাকে বাংলায় বলে ‘টাকশাল’, ইংরেজিতে বলে মিন্ট্ ‘Mint’।  

দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ ‘মুকসুদাবাদের’ নাম বদলে জায়গার নাম রাখেন ‘মুর্শিদাবাদ’। বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য প্রচুর মুদ্রার প্রয়োজন সে কথা বুঝতে পারেন দেওয়ান মুর্শিদকুলি এবং সহযোগী শেঠ মানিকচাঁদ। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, পাটনা ও ঢাকা থেকে মুদ্রা তৈরি করে আনার খরচ অনেক বেশি, সেই জায়গায় তাঁরা নিজেরাই যদি মুর্শিদাবাদে একটি টাকশাল বানিয়ে নেন তাহলে অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমস্যার সমাধানও সম্ভব হবে।

মুর্শিদকুলি এবং মানিকচাঁদের যৌথ প্রয়াসে মুর্শিদাবাদে গড়ে ওঠে বাংলার এই টাকশাল। মানিকচাঁদের কুঠি যেখানে ছিল, সেই মহিমাপুরের অন্যপারে গঙ্গানদীর তীরে এই টাকশাল স্থাপিত হয় – এমন একটি মত জানা যায়। মানিকচাঁদ এবং মুর্শিদকুলির চেষ্টায় শ্রীবৃদ্ধি হয় টাকশালের। ধীরেধীরে এই টাকশাল হয়ে ওঠে বাংলার বৃহত্তম টাকশাল। এই টাকশাল থেকে মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ, দ্বিতীয় আলমগীর ও দ্বিতীয় শাহ আলমের নামের মুদ্রাও তৈরি হয়েছিল এক সময়।

মুর্শিদাবাদের এই টাকশালটি ঠিক কোথায় ছিল সে সম্পর্কে গবেষকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন টাকশালটি প্রথমে ছিল নদীর ওপারে ইচ্ছাগঞ্জের ঠিক বিপরীত দিকে। পরে সেখান থেকে সরিয়ে আনা হয়েছিল ইমামবাড়ার কাছে। আবার কেউ বলেন, টাকশালের সেই জায়গায় বর্তমান ইমামবাড়ার পশ্চিমাংশ নির্মাণ করা হয়েছে। ইমামবাড়ার সামনের ঘাটটির নাম ‘মিন্টঘাট’। অনুমান এক সময় সেখানেই নাকি ছিল টাকশাল।

আবার কেউ কেউ বলেন টাকশাল দেখাশোনার দায়িত্ব যেহেতু জগৎশেঠের উপর ছিল, সেহেতু টাকশালটি ছিল জগৎশেঠদের বাড়ির কাছাকাছি। বর্তমানে জগৎশেঠদের সেই বাড়ি নদীগর্ভে, বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে টাকশালও তলিয়ে যায় নদীগর্ভে। নবাবি আমলে জগৎশেঠ পরিবার সোনা-চাঁদির একচেটিয়া কারবার করতেন এবং নবাবকে তা সরবরাহও করতেন। তার জন্য তাঁরা বাট্টা ও কমিশন পেতেন। টাকশালের দৌলতে শেঠদের ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে।

যে কেউ সোনা-রুপো কিনে নবাবি টাঁকশালে দিলে তা থেকে মোহর বা টাকা তৈরি করে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু সেই কাজের জন্য তাকে দিতে হত কমিশন।  সেই কমিশনের কিছু অংশ জগৎশেঠও পেতেন। বাকি পেতেন নবাব। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ কুঠির সাহেবরাও এক সময় নবাবি টাকশাল থেকে মুদ্রা তৈরি করিয়ে নিতেন। প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭২৫ সালে মুর্শিদাবাদের টাকশালে মিন্ট্ ডিউটি বা টাকশালে কমিশন বাবদ আদায় হয়েছিল ছ’লক্ষ টাকা। ভাবা যায়! বছর-বছর এর চেয়েও বেশি মুনাফা পেতে থাকেন নবাব। ধীরেধীরে বাংলার একচেটিয়া বৃহত্তম টাকশালে পরিণত হয় এই মুর্শিদাবাদের টাকশাল। 

বাদশা ঔরঙ্গজেবের নাম দিয়ে তৈরি মুর্শিদাবাদে টাকশালের টাকা পাকিস্তানের লাহোর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়। দ্বিতীয় শাহ আলম-এর রাজত্বের দশ, এগারো ও উনিশ বছর পূর্তিতে তাঁর নামাঙ্কিত মুদ্রা মুর্শিদাবাদের টাকশাল থেকে বের হয়েছিল। যে মুদ্রাগুলি ছিল পুরোপুরি দেশিপ্রথায় তৈরি। মোহরের একপিঠে ছিল ফার্সি ভাষায় লেখা বাদশার নাম এবং অপর পিঠে লেখা ছিল “জবরে মুর্শিদাবাদ” বা “জলুষ ১৯”। এই ছাঁচ আর পরবর্তীকালে বদলানো হয়নি। 

পরে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হলে মুর্শিদাবাদের টাকশাল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার টাকশালে মুদ্রা তৈরি করলেও বহুদিন যাবৎ মুর্শিদাবাদের টাকশালের নাম ও প্রতীক ব্যবহার করত। এখানকার মুদ্রা চেনার সহজ উপায় ছিল যুঁইফুল ছাপ। যা ছিল বিখ্যাত।শোনা যায়, মানিকচাঁদের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রঘুনন্দন টাকশালের অধিকর্তা হন। প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুদ্রা তৈরি অব্যাহত ছিল এই টাকশালে। তারপর একদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যায় বাংলার বৃহত্তম টাকশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.