প্রায় ১৭-১৮ বছর আগের কথা। বেঙ্গালুরুর রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি বৈঠকে সূর্যের করোনার ছবি তোলার প্রস্তাব পাশ হয়েছিল। তা গিয়েছিল ইসরোর কাছে। ২০০৯ সালে সেই প্রস্তাবে সরকারি সিলমোহরও পড়ে। তবে প্রকল্পের মোড় ঘুরে যায় ২০১৩ সালে। সৌর গবেষণা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা মহাকাশবিজ্ঞানী উডুপি রামচন্দ্র রাও বলেছিলেন, ‘‘শুধু করোনার ছবি কেন? কেন আমরা এল১ পয়েন্টে (ল্যাগরাঞ্জ পয়েন্ট) পৌঁছনোর কথা ভাবতে পারছি না?’’ প্রথমে মনে হয়েছিল, ঠিক শুনছি তো? নাসার মতো আমরাও এল১ পয়েন্টে গিয়ে সূর্যে নজরদারি করব!
রাও বেঁচে নেই। তবে শনিবার ‘আদিত্য এল১’ উৎক্ষেপণের ঠিক আগে বারবার মনে পড়ছে তাঁর সেই দূরদর্শী ভাবনার কথা। আমাদের জগতের কেন্দ্রে থাকা সূর্যই নিকটতম নক্ষত্র। পৃথিবীর প্রাণের উৎস সূর্য। তবু এই নক্ষত্রের যে অপার রহস্য, তার সিকি ভাগও আমরা জানি না। ‘আদিত্য’ গিয়ে এক বারে সব কিছু জেনে ফেলবে, এমন নয়। কোনও একটি মহাকাশ অভিযানে সব রহস্য জেনে ফেলাও যায় না। তবে রহস্য সন্ধানের একটি সূচনা বিন্দু থাকে। ‘আদিত্য এল১’ অভিযান সেই সূচনা বিন্দু। এ বার প্রশ্ন জাগতেই পারে, আমরা কী খুঁজতে এত দূর পাড়ি দিচ্ছি? কেন দিচ্ছি?
এই অভিযানের লক্ষ্য সূর্যের করোনা অঞ্চলের (বাইরের অংশ) উত্তপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়া এবং কী ভাবে সেখান থেকে তেজোদীপ্ত কণা (চার্জড পার্টিকল) মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে, তার সুলুকসন্ধান। সেই সুলুকসন্ধানে ভবিষ্যতের পাশাপাশি সূর্যের অতীতও দেখা হবে এবং ভবিষ্যতে কী হতে পারে তার পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। এই পূর্বাভাসের জেরে শুধু মহাকাশ বিজ্ঞান নয়, খোদ পৃথিবীর মানুষেরও লাভ অনেক।
তবে তার আগে বুঝতে হবে করোনার চরিত্র। সূর্যের ওই অংশটি একটি বিরাট চৌম্বকক্ষেত্র। সেই অংশে মাঝেমধ্যেই অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয় এবং সেই উথালপাথালের জেরে চৌম্বকক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসে প্লাজ়মা স্রোত। বিজ্ঞানের ভাষায়, করোনাল মাস ইজেকশন। তার ফলেই তেজোদীপ্ত কণার স্রোত ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। এই ঘটনাকে সৌরঝড়ও বলা যায়। এই বিষয়গুলি বোঝার জন্যই ‘আদিত্য’-র শরীরে কয়েকটি যন্ত্র বসানো আছে।
এই ঝড়ের পূর্বাভাস দিতে হলে আরও একটি বিষয় বোঝা প্রয়োজন। তা হল সৌরবায়ু। আদতে সূর্যের থেকে একটি স্রোত সব সময়েই বয়ে চলেছে। সেই স্রোতে গা ভাসিয়েই করোনা থেকে নির্গত কণাগুলি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ছুটে চলে। তবে স্রোতে কণাগুলি বহু দূরে ভেসে যাবে নাকি অচিরেই স্তব্ধ হয়ে যাবে, তা বুঝতে হলে সৌরবায়ুর গতিবেগও বোঝা সম্ভব। তা বোঝার জন্য ‘আদিত্য’-র শরীরে তিনটি আলাদা যন্ত্র বসানো আছে।
পৃথিবীর ঝড়ঝঞ্ঝার পূর্বাভাসের ফলে না হয় বিপদ থেকে বাঁচা যায়। সৌরঝড়ের পূর্বাভাসের জেরে কী লাভ হবে? শুধু তাত্ত্বিক বিজ্ঞান গবেষণার লাভ নয়। সৌরঝড়ের পূর্বাভাসে বস্তুগত লাভও যথেষ্ট। কারণ, ওই প্রবল কণাস্রোত যদি মহাকাশে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহের উপরে আছড়ে পড়ে তা হলে সেগুলি বিকল হয়ে যেতে পারে।
বর্তমানে শুধু ভারতেরই প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ মহাকাশে আছে। ওই সব সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এক ধাক্কায় টেলিকম ব্যবস্থা, পাওয়ার গ্রিড ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। ওই কণার স্রোত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ভেদ করে আয়নোস্ফিয়ারে কণাস্রোত ঢুকে পড়লে বিমান চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
এটাও তো প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই নজরদারির জন্য ১৫ লক্ষ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া হচ্ছে কেন? কারণ, সূর্যের উষ্ণতম স্থান হল এই করোনা। তবে পৃথিবী থেকে একমাত্র সূর্য গ্রহণের সময় তার দেখা মেলে। তবে সূর্য নিয়ে গবেষণা করতে হলে নিরন্তর নজরদারি প্রয়োজন। তাই ‘এল১’ পয়েন্টে পৌঁছতে হবে। সেখানে গিয়ে সাধারণ আলোকরশ্মি, অতি-বেগুনি রশ্মি, এক্স-রে দিয়ে সূর্যের উপরে টানা নজরদারি প্রয়োজন। তাই এত দূরে পাড়ি না-দিয়ে উপায় নেই।
তবে এই দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়াও কম কঠিন নয়। শনিবার বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে ‘আদিত্য’-কে। তিলে তিলে যাঁকে তৈরি করেছি আমরা, ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। চার মাসের পথ পেরিয়ে তাকে নিখুঁত ভাবে ‘এল ১’ পয়েন্টে স্থাপন করতে হবে।
তার পরেই সূর্যের চোখে চোখ রেখে শুরু হবে নজরদারি।
(লেখক: আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজ়ারভেশনাল সায়েন্সেস- এর অধিকর্তা এবং আদিত্য এল১ অভিযানের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী।)
অনুলিখন: কুন্তক চট্টোপাধ্যায়