বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টের বার্ষিক রিপোর্ট। সেখানে স্থান পেয়েছে হাই কোর্টের বিচারপতিদের দেওয়া সেরা রায়গুলি। তাতে যেমন সেরার তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রাথমিকে নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে দেওয়া রায়, তেমনই অন্তঃসত্ত্বা নাবালিকার গর্ভপাত থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত— এক বছরের মেয়াদে প্রত্যেক বিচারপতির দেওয়া সেরা রায়গুলিই তালিকাভুক্ত হয়েছে বার্ষিক রিপোর্টে। এমন রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ায় খুশি আইনজীবী মহল। এর মাধ্যমে আদালতের দেওয়া রায় সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সহজেই অবহিত হতে পারবেন বলে মনে করেন তাঁরা।
গত বছর প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। পরে এই মামলার তদন্তে ইডিও যুক্ত হয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হন তৃণমূল বিধায়ক তথা তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। কালক্রমে মামলায় জড়িয়ে পড়েন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন বিচারপতি। যদিও ওই নির্দেশ কার্যকর হওয়ার আগেই অভিষেকের আবেদন মেনে মামলার বেঞ্চ পরিবর্তন করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। হাই কোর্টের সদ্য প্রকাশিত ওই বইয়ের তথ্য বলছে, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় নজরকাড়া রায় দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির সত্য উদ্ঘাটন এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন তিনি। এটিই তাঁর এ বছরের সেরা রায়।
হাই কোর্টের প্রকাশিত রিপোর্টে বিচারপতিরা নিজেদের এজলাসে যে সব মামলার বিচার করেছেন, তার মধ্যে থেকে একটি রায়কে বাছাই করা হয়েছে। অর্থাৎ, সব বিচারপতিরই বছরের সেরা রায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়কর বিভাগের একটি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয় প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। বিচারপতি ইন্দ্রপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় এবং বিচারপতি বিশ্বরূপ চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ লাগাতার অপরাধের ক্ষেত্রে জুভেনাইল আইন মেনে কী ভাবে বিচারপ্রক্রিয়া চলবে তা নিয়ে বছরের সেরা রায় দেয়। জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলি উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ এবং আত্মপক্ষ সুযোগ না দিয়ে কোনও এলপিজি ডিস্ট্রিবিউটরের অনুমতি কেড়ে নিতে পারবে না বলে জানায় বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ। ওই রায়টিকেই ওই বেঞ্চের বছরের সেরা রায় বলে ধরা হয়েছে কোর্ট প্রকাশিত রিপোর্টে। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ বা মহার্ঘভাতা দেওয়ার নির্দেশ বিচারপতি হরিশ টন্ডন এবং রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ। ওই নির্দেশকে বছরের সেরা রায়ের তকমা দেওয়া হয়েছে। এখন ওই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
অপরাধী এবং ভিকটিমের ফোনের কল ডিটেলস রেকর্ড (সিডিআর) এবং টাওয়ার লোকেশন একই স্থানে পাওয়া গেলেই তদন্তকারী অফিসার তা সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন না। এর জন্য সার্ভিস প্রোভাইডারের মতামত প্রয়োজন। ফৌজদারি আইনে উপযুক্ত সাক্ষী নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয় বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী এবং বিচারপতি বিভাস পট্টনায়েকের ডিভিশন বেঞ্চ। সন্তান জন্মগত ভাবে আমেরিকার নাগরিক। সন্তানকে ফিরে পেতে হাই কোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের মামলা করেছিলেন এক ব্যবসায়ী। যাঁর বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রী এবং তাঁর পরিবারকে বেআইনি ভাবে এ দেশে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তীর বছরের সেরা রায়, সন্তানের দায়িত্ব নিতে অপারগ ওই ব্যবসায়ী। তাঁর কর্তব্যবোধ নিয়ে আদালত প্রশ্ন তোলে। প্রত্যেক জীবের বাঁচার অধিকার নিয়ে বছরের সেরা রায় দেয় অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অপূর্ব সিংহ রায়ের ডিভিশন বেঞ্চ। আদালত জানায়, নিরাপত্তার সঙ্গে সব জীবের জীবনধারণের অধিকার রয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনে অন্যের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, অরণ্য, বন্যপ্রাণ, পাখি, সরীসৃপ রক্ষায় আদালতের ওই রায়কে দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন অনেক আইনজীবীই।
এক তরুণীকে বাংলাদেশ থেকে এ দেশে পাচার করেছিল নারী পাচারকারীরা। ওই তরুণী হাই কোর্টের দ্বারস্থ হলে তাঁকে নিজের দেশে ফেরার রায় দেন বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত। গত এক বছরে তাঁর সেরা রায় এটি। শারীরিক হেনস্থার শিকার হন ১৩ বছরের এক নাবালিকা। অভিযোগ, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওই নাবালিকার শরীর স্পর্শ করেছিলেন এক ব্যক্তি। যদিও তিনি হেনস্থার অভিযোগ অস্বীকার করেন। বিচারপতি বিবেক চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ, ওই নাবালিকার শারীরিক বিকাশ সম্পূর্ণ হয়নি এ কথা ঠিক। জানা গিয়েছে, অপুষ্টির কারণেই তার ওই অবস্থা। কিন্তু খারাপ উদ্দেশে ১৩ বছরের নাবালিকার বুকে হাত দেওয়া অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। ওই ব্যক্তির তিন বছরের সাজা এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন বিচারপতি। তাঁর এজলাসে বছরের সেরা রায়ের তালিকায় এই মামলাটি রয়েছে। এক ব্যক্তিকে থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধর করার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। স্বামীর মৃত্যুর বিচার চাইতে হাই কোর্টের দরজায় কড়া নাড়েন তাঁর স্ত্রী। তদন্ত শুরু করে সিবিআই। ময়নাতদন্তে দিল্লির এমসের চিকিৎসকরা জানান, ওই ব্যক্তির শরীরে একাধিক ক্ষত থাকলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে চার্জ গঠন করে। বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ নতুন করে চার্জ গঠনের নির্দেশ দেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, শুধু মেডিক্যাল রিপোর্ট একটি তদন্তের পক্ষে যথেষ্ট নয়। ওই ব্যক্তির শরীরে আঘাতের চিহ্ন বলে দিচ্ছে তাঁর উপর কী অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁর মন্তব্য, ‘‘রক্ষাকর্তা হত্যাকারী হয়ে গেলে তা দুর্ভাগ্যজনক।’’ অন্য একটি মামলায় অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন এক নাবালিকা। নিজের জীবন দিয়ে হলেও সে গর্ভপাত করাতে চায়। বিচারপতি অনিরুদ্ধ রায় সেই অনুমতি দেননি। তাঁর পর্যবেক্ষণ, প্রত্যেকের স্বাধীন জীবন ধারণের অধিকার রয়েছে। কিন্তু কোনও সমস্যা না-থাকলে একটি জীবন নষ্ট করাও অনুচিত। এ ছাড়া ওই বই অনুযায়ী, কলকাতা হাই কোর্টের অন্য বিচারপতিরাও সেরা রায় দিয়েছেন।
শুধু হাই কোর্ট নয়, জেলা এবং নিম্ন আদালতের একাধিক বিষয় ওই বইতে তুলে ধরা রয়েছে। মোটের উপর গোটা রাজ্যে গত এক বছরের বিচার প্রক্রিয়ার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ওই বইটি থেকে খানিকটা হলেও আন্দাজ করা যায়। বার্ষিক রিপোর্ট তৈরি করেছে হাই কোর্ট গঠিত একটি কমিটি। বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর নেতৃত্বে ওই কমিটিতে রয়েছেন বিচারপতি শম্পা সরকার এবং বিচারপতি রাই চট্টোপাধ্যায়। এই ধরনের পদক্ষেপের প্রশংসা করছেন আইনজীবীরাও। হাই কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘এটা ভাল সিদ্ধান্ত। এর আগে সব বিচারপতির পারফরম্যান্স (সেরা রায়) সাধারণ মানুষ জানতে পারতেন না। এখন কেউ চাইলে জানতে পারেন।’’ বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক বিশ্বব্রত বসুমল্লিকের কথায়, ‘‘এ ভাবে বিচারপতিদের এক বছরের সেরা রায় অনেকের অজানা ছিল। আমাদের হাই কোর্ট যে কত ভাল ভাল রায় দেয় তা সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে অনেকের।’’ কয়েক বছর আগে অল্প কিছু তথ্য নিয়ে এই রিপোর্ট প্রকাশিত হত। বইয়ের আকারে রিপোর্ট প্রকাশ এ বারই প্রথম।