বান্দুং সম্মেলনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমে পাকিস্তান এই সম্মেলনে কমিউনিস্ট চীনের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করে এবং মার্কিন উস্কানিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান আর নিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে সম্মেলন ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে। নেহেরু চীনকে বড়দাদার মত আগলে রাখতে চেষ্টা করেন। শুধু তাই নয়,  চৌ এন লাইএর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে বান্দুংএর রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, দুপাশে লোক জড় হয়ে হাততালি দিত। (যদিও নেহেরুর এই মাতব্বরিতে চৌ এন লাইএর বিরক্ত হয়েছিলেন।  ১৯৬৫ সালে চীনে সফররত শ্রীলঙ্কার এক প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন, নেহেরুর চেয়ে বেশি উদ্ধত ব্যক্তি তিনি দেখেননি)।

ওদিকে সকলের অগোচরে নেহেরুর ছোট ভাই চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলির সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন। এই আলোচনার কথা স্বয়ং চৌ এন লাই  এক রাজনৈতিক কমিটির বৈঠকে প্রকাশ করেন।  তিনি বলেন মহম্মদ আলি তাঁকে জানিয়েছেন পাকিস্তান চীনের বিরোধী নয়। পাকিস্তান চীনের থেকে আক্রমণ আশা করে না। পাকিস্তান ও চীনের আভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার মাধ্যমে যৌথ শান্তি প্রতিষ্ঠা আর সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়েছে।

১৯৫৬র সেপ্টেম্বরে  মেজর জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন প্রতিনিধি চীনের আমন্ত্রণে চীন সফর করেন এবং তাদের রণকৌশল প্রত্যক্ষ করেন। ফিরে এসে  চীন দ্বারা আক্রমণের আশঙ্কা রক্ষামন্ত্রককে জানায়।  কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন তাঁদের কথায় গুরুত্ব দেননি।

১৯৫৬র ডিসেম্বরে চৌ এন লাই ভারত সফরে এসে বলেন চীন এবং মায়ানমারের মধ্যে সীমান্ত হিসেবে ম্যাকমাহন লাইনই বজায় আছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ম্যাকমাহন লাইনের যে অংশ পড়ে, তার মীমাংসাও শান্তিপূর্ণ ভাবে করা হবে, অতি শীঘ্রই। অতি শীঘ্রই চীনা সৈন্যরা হানা দিলে তৎকালীন নেফার (অরুনাচল প্রদেশ)  ওয়ালংএ। 

১৯৫৭ সালে পিকিংএর ভারতীয় দূতাবাস থেকে নিউ দিল্লিতে চীনের পিপলস ডেইলির একটি সরকারি ঘোষণার ক্লিপিংস পাঠানো হয় যাতে বলা হয় চীনের সিং কিয়াং প্রদেশের ইয়ে চেং থেকে  তিব্বতের গারটক পর্যন্ত ৭৫০ মাইল লম্বা, ১২ ফুট চওড়া একটি রাস্তা তৈরি করা হয়েছে এবং সেটি গিয়েছে লাদাখ অঞ্চলের আকসাই চীনের মধ্যে দিয়ে।  গ্রীষ্মকালে দুইটি টহলদারি পুলিশ পার্টি পাঠানো হয় যার মধ্যে একটি নিখোঁজ হয়ে যায়। দিল্লির চীনা রাষ্ট্রদূতকে তাদের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে চীন নিরুত্তর থাকে। 

দুই মাস পর চীনের তরফ থেকে জানানো হয় ভারতীয় জওয়ানরা চীনা এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করলে তাদের বহিষ্কার করে কারাকোরাম গিরিবর্ত্মে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়। সৌভাগ্যক্রমে একটি ভারতীয় অনুসন্ধান পার্টি  তাদের আবিষ্কার করে, যখন অনাহারে তারা প্রায় মৃত্যুর দরজায় উপস্থিত হয়েছে। ভারত সরকার অবশ্য  ঘটনাটি চেপে যাওয়া সাব্যস্ত করে।

১৯৫৮র জুলাইতে ‘চায়না পিক্টোরিয়াল’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত মানচিত্রে নেফার পাঁচটি বিভাগের চারটি এবং আকসাই চীন সহ লাদাখের একটি বিস্তীর্ণ অংশ  চীনের অন্তর্ভুক্ত বলে দেখানো হয়। নেহেরু চৌ এন লাই কে একটি দীর্ঘ চিঠিতে ঐ ম্যাপের কথা উল্লেখ করে বলেন চীন যেন ম্যাকমাহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়। দেড় মাস পর চৌ এন লাই উত্তর আসে, যেখানে চীন ম্যাকমাহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে মানতে অস্বীকার করে। তবে তিনি জানান শীঘ্রই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সমাধান’ সম্ভব হবে। আর পশ্চিম সীমান্ত তো ভারতীয় ম্যাপে ভুল দেখানো হয়েছে।

পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায় যখন ১৯৫৯ এর ৩০শে মার্চ দলাই লামা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। চীন খোলাখুলি ভারত বিরোধিতা শুরু করে। পালডেন গিয়াৎসো নামক  একজন তিব্বতী বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেছেন ঐসময় চীনে নেহেরুকে “the running dog of imperialist”  বলে উল্লেখ করা হত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য উল্লেখ করে তিব্বতের “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” বিদেশীদের সাহায্যে ষড়যন্ত্রে নেমেছে।

১৯৫৯এর আগস্টে চীনারা নেফার সুবনসিরি নদীর কাছে লংজু দখল করে। এক ভারতীয় পুলিশ নিহত এবং আর একজন আহত হয়।কয়েক সপ্তাহ পর, লাদাখের কংকাল পাসে, ভারতের সীমানার চল্লিশ মাইল ভিতরে ভারতীয় টহলদার বাহিনী চীনা বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। ১০-১২ জনের প্রাণ যায়।১৬জন বন্দী হয়,যাদের চার সপ্তাহ পর ফেরত দেওয়া হয়। ভারতকে তাদের অধিকৃত এলাকার ২০  কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গা থেকে সেনা সরাতে বলা হয়, যা মানা ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

১৯৬০ সালের এপ্রিলে চৌ এন লাইন ভারতে আসেন। কিন্তু কোন সমাধান হয়নি।  কৃষ্ণ মেনন মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে চৌ এন লাইএর সঙ্গে দেখা করেন, যা সফরসূচির অন্তর্গত ছিল না। যদিও এই আলোচনার ফলাফল বিদেশ মন্ত্রকের কাছে অজানা থাকে।

১৯৬২ সালের মাঝামাঝি ভারতীয় সেনারা লাদাখে চীনা সেনাদের রসদ যাতায়াতের পথে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে শক্ত ঘাঁটি বানায়।

পূর্বে ৮ই সেপ্টেম্বর; ২০শে অক্টোবর পূর্ব এবং পশ্চিম, দুই দিক থেকেই প্রবল আক্রমণ শুরু হল। প্রতিটি ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে ছয় জন চীনা সৈন্য মোতায়েন হয়েছিল। চীনে প্রচার হতে লাগল আগ্রাসনকারী ভারত এবং তার নেতা সাম্রাজ্যবাদীদের পোষা কুকুর নেহেরু চীনা এলাকা দখল করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।

পন্ডিতজীকে স্বীকার করতে হল ভারত সরকার বাস্তব জগতে নয়, এক কল্পলোকে বাস করছিল। সৈন্য- সামন্ত, অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্য, রসদ, পরিকাঠামো, রণনীতি, রাস্তাঘাট প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রেই ভারতীয় সরকার অযোগ্য প্রমাণিত হল।

(পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট লৌহমানব আয়ুব খান ঐ সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানকে ডেকে পশ্চিম দিক থেকে ভারত আক্রমণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে সেনাপ্রধানেরা রাজী হননি, কেননা তাতে মার্কিন মহাপ্রভু  চটে যেতে পারেন, মার্কিন সাহায্য বন্ধ হতে পারে।) 

২০ থেকে ২৪ অক্টোবর প্রবল যুদ্ধ হল। নেফায় লোহিত নদী ধরে ওয়ালং থেকে হায়ুলিয়ং পর্যন্ত আশি মাইল চীনেরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে গেল এবং অধিকৃত এলাকায় প্রয়োজনীয় রাস্তাও বানিয়ে ফেলল। এর পর হল পাঁচ দিনের যুদ্ধবিরতি। সেই পুরোনো প্রস্তাবের পুনরুক্তি, ভারতীয়দের অধিকৃত এলাকা থেকে কুড়ি কিলোমিটার পিছিয়ে যেতে হবে। ভারতের পক্ষে তা মানা ছিল অসম্ভব। ৩১শে অক্টোবর নেহরু বিরোধীদের চাপে কৃষ্ণ মেননকে বরখাস্ত করতে বাধ্য হন। যশবন্ত চৌহান হলেন নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।

১৪ই থেকে ১৯শে নভেম্বর নেফাতে আর ১৮ই থেকে ২১শে নভেম্বর লাদাখে বন্যার জলের মত চীনা সৈন্যদল ঢুকতে লাগল। চীনের ছয়টি ব্রিগেড পৌঁছে গেল তেজপুর শহরের কাছে।

ভারতের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ পরাজয়। ২১ তারিখে চীনের তরফ থেকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয় এবং চীন নেফা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। তার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়  রাশিয়া চীনকে তেল সরবরাহ বন্ধ করেছিল। তাছাড়া সমতলভূমিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লড়তে অসুবিধা হত না।

সর্দার প্যাটেলের সাবধানবাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে, চীন সফরকারী ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধির সতর্কীকরণকে পাত্তা না দিয়ে, চীনের একটার পর আগ্রাসন কে দেখেও না দেখার ভান করে, চৌ এন লাইয়ের প্রতি অতিরিক্ত দুর্বলতা আর চীনের প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়ে নেহেরু
যে ভুলটা করেছিলেন তার খেসারত দিয়েছিল হতভাগ্য ভারতীয় সেনারা, শত্রুর বুলেটে প্রাণ দিয়ে, শীতে জমে, অঙ্গহানি করে।

আকসাই চীন এখন পাকাপাকি ভাবে চীনের দখলে। ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা আর আকসাই চীনের রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন অত্যাধুনিক বলা যায়। এদিকে ভারত উত্তরপূর্ব সীমান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির জন্য জোর দিয়েছে এই সেদিন, ২০১৪র পর থেকে।   বান্দুং সম্মেলনে চীন আর পাকিস্তান প্রথম কাছাকাছি আসে, এখন তারা একে অন্যের বন্ধু। ভারতে পাকিস্তানের জঙ্গি কার্যকলাপে চীন উদাসীন। মাসুদ আজহারকে আন্তর্জাতিক আতঙ্কবাদী ঘোষণার পথে চীন একটি বড় বাধা।

প্রজাতন্ত্রের মোড়কে রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার ভুলের মাসুল আমাদের দিয়ে যেতে হবে অনির্দিষ্ট কাল ধরে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.