সোনার ছেলের গলায় সোনার পদক। গোটা ভারত অপেক্ষা করেছিল আরও একটি সোনা জয়ের। সেটাই করে দেখালেন নীরজ চোপড়া। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম ভারতীয় হিসাবে সোনা জিতলেন তিনি। ফাইনালে ৮৮.১৭ মিটার দূরে জ্যাভলিন ছুড়লেন নীরজ।
সাধারণত নীরজ নিজের প্রথম থ্রোতেই সব থেকে দূরে জ্যাভলিন ছোড়েন। যোগ্যতা অর্জন পর্বে ৮৮.৭৭ মিটার দূরে জ্যাভলিন ছুড়ে যেমন এক থ্রোয়েই বাজিমাত করে দিয়েছিলেন। সেই থ্রোয়ের কারণে প্যারিস অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জনও করে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু ফাইনালে প্রথম থ্রোটি ফাউল করে ফেলেন নীরজ। দ্বিতীয় থ্রোতে আর ভুল করেননি। ৮৮.১৭ মিটার দূরে জ্যাভলিন ছুড়েই চিৎকার করে ওঠেন নীরজ। নিজেই বুঝতে পারছিলেন যে, থ্রো ভাল হয়েছে। প্রথম তিনটি থ্রোয়ের পরে এক নম্বরেই ছিলেন তিনি। নীরজের তৃতীয় থ্রোয়ের দূরত্ব ছিল ৮৬.৩২ মিটার।
জ্যাভলিনের ফাইনালে তিন জন ভারতীয় জায়গা করে নিয়েছিলেন। নীরজ ছাড়াও ছিলেন কিশোর জেনা এবং ডিপি মানু। ফাইনালে তাঁরা শেষ করলেন পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে। ফাইনালে প্রথম তিনটি থ্রোয়ের পর সেরা আট জনকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁরা আরও তিনটি করে থ্রো করার সুযোগ পান। মোট ছ’টি থ্রোয়ের পরেও নীরজকে টপকাতে পারলেন না কেউ।
২০২১ সালের ৭ অগস্ট দিনটি ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা ভুলতে পারবেন না শুধু মাত্র নীরজের জন্য। অলিম্পিক্সে অ্যাথলেটিক্সে সোনা এনে দিয়েছিলেন তিনি। হয়ে উঠেছিলেন ভারতের সোনার ছেলে। এক সময় শুধু মাত্র ওজন কমানোর লক্ষ্য নিয়ে যে নীরজকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনিই এখন গোটা ভারতের চোখের মণি।
ছোট থেকে নীরজের এক এবং একমাত্র দুর্বলতা ছিল খাবার। যে কোনও খাবার দেখলেই হামলে পড়তেন তিনি। পছন্দ ছিল তাজা ক্রিম এবং চুরমা (রুটি, ঘি এবং চিনি দিয়ে বানানো এক ধরনের পঞ্জাবি পদ)। খাবারের প্রতি নীরজের এই টানে ইন্ধন দিতেন তাঁর ঠাকুমা। সুযোগ পেলেই নাতিকে চুরমা বানিয়ে খাওয়াতেন। ঠাকুমার প্রশ্রয় পেয়ে অতি অল্প বয়সেই নাদুস-নুদুস গোলগাল চেহারার হয়ে পড়েছিলেন নীরজ। ১২ বছরে তাঁর ওজন দাঁড়ায় ৯০ কেজির বেশি। ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছিলেন ওবেসিটির দিকে।
বাধ্য হয়ে তাঁর ওজন কমানোর লক্ষ্যে বাবা-মা জোর করে মাঠে পাঠাতে থাকেন। হরিয়ানার পানিপথ জেলার খান্দরা গ্রামে জন্ম নীরজের। বাড়ির পাশেই শিবাজি স্টেডিয়ামে রোজ সকালে জগিং করতে যেতেন তিনি। সেখানেই পরিচয় হয় প্রাক্তন জ্যাভলিন থ্রোয়ার জয় চৌধুরির সঙ্গে। জয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত নীরজ জানতেনই না জ্যাভলিন কী জিনিস। একদিন খেলাচ্ছলেই তাঁকে জ্যাভলিন ছুড়তে বলেছিলেন জয়। প্রথম প্রচেষ্টাতেই প্রায় ৪০ মিটার দূরে ছুড়েছিলেন নীরজ। প্রথম বার দেখেই জয় বুঝেছিলেন নীরজের ওজন বেশি থাকলেও শরীরের নমনীয়তা রয়েছে।
এরপর থেকেই ধীরে ধীরে জ্যাভলিন নীরজের জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে ওঠে। তাঁর ওজনও ক্রমশ কমতে থাকে। চণ্ডীগড়ের ডিএভি কলেজে পড়াকালীন নিজের খেলাধুলোকে শীর্ষস্তরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন নীরজ। অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন বিভিন্ন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। ততদিনে নীরজ হয়ে উঠেছেন সুঠামদেহী। পেটানো চেহারা দেখলে মেলানো যাবে না ছোটবেলার সঙ্গে।
২০১৪-য় দক্ষিণ এশীয় গেমসে ৮২.২৩ মিটার ছুড়ে জাতীয় রেকর্ড স্পর্শ করেন। তখন সেই রেকর্ডকে কেউ পাত্তা দেননি। তবে নীরজ নজর কেড়ে নেন সে বছরই পোলান্ডের বিডগজে অনুষ্ঠিত হওয়া আইএএএফ বিশ্ব অনূর্ধ্ব-২০ প্রতিযোগিতায়। ৮৬.৪৮ মিটার ছুড়ে জিতে নেন সোনা। তৈরি করেন বিশ্ব জুনিয়র রেকর্ড। এর আগে এই প্রতিযোগিতায় কোনও ভারতীয় পদক জেতেননি।
পরের বছর এশীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ৮৫.২৩ মিটার ছুড়ে সোনা জেতেন নীরজ। ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে ৮৬.৪৭ মিটার ছুড়ে সোনা জেতেন। কমনওয়েলথ গেমসের অভিষেকেই পদক পেয়েছিলেন তিনি। সে বছরই দোহা ডায়মন্ড লিগে ৮৭.৪৩ মিটার ছুড়ে নিজেরই জাতীয় রেকর্ড ভেঙে দেন। ৮৮.০৬ মিটার ছুড়ে এশিয়ান গেমসেও সোনা জিতেছিলেন তিনি।
২০১৯ সালটা নীরজের পক্ষে খুব একটা ভাল যায়নি। কনুইয়ের চোট পান। সেই চোট সারাতে গিয়ে বছরভর প্রায় কোনও প্রতিযোগিতাতেই অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ২০২০-তে অতিমারি পর্বে গোটা বিশ্বেই খেলাধুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এর পর করোনা অতিমারি প্রকোপে বন্ধ ছিল খেলা। অলিম্পিক্সে নেমেই সোনার পদক জিতেছিলেন নীরজ। তার পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন এবং আগের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী দেখিয়েছে তাঁকে। বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে প্রথম সোনাও এল নীরজের হাত ধরেই। গত বছর এই প্রতিযোগিতায় রুপো জিতেছিলেন তিনি।