উফ্, আমরাই ‘ফার্স্ট’! ১৯টা মিনিট যেন দমবন্ধ ছিলাম, আনন্দবাজার অনলাইনে লিখলেন ইসরোর বিজ্ঞানী

ঘড়ির কাঁটায় তখনও ৬টা বাজেনি। আমাদের চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার ক্রমশ নামছে। চাঁদের মাটির সঙ্গে দূরত্ব কমতে কমতে যখন আর দু’কিলোমিটার বাকি, না চাইতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। চার বছর আগে ঠিক এই পর্যায়ে এসেই তো থমকে গিয়েছিল আমাদের সব স্বপ্ন। ২.২ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছনোর পরেই ল্যান্ডার থেকে আর কোনও সিগন্যাল আসছিল না। চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। চাঁদের বুকে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে গিয়েছিল আমাদের যত্নে লালিত সেই ল্যান্ডার। সেই স্মৃতি যেন আমার অবচেতনে এখনও টাটকা ছিল। এ বার তাই সেই পর্যায়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠেছিলাম মনে মনে। কিন্তু সে সব অতীত। আমাদের বিক্রম (ল্যান্ডার) চাঁদে পা রেখেছে। আর দ্বিমত নেই। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আমরাই ‘ফার্স্ট’।

এ এক অনন্য অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম, চিন্তা, চেষ্টা আর অনেক পরিকল্পনার যোগফল যেন আমাদের এই সাফল্য। আমি এবং আমার প্রত্যেক সহকর্মী এত দিন এই আনন্দভরা সন্ধ্যাটার জন্যেই তো অপেক্ষা করে ছিলাম! চাঁদের বুকে দেখতে চেয়েছিলাম ঠিক এমনই একটা ভোর। এখনও পর্যন্ত চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৃথিবীর আর কোনও দেশ যেতে পারেনি। রাশিয়া কিছু দিন আগে চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। আমরাই প্রথম চাঁদের ‘কুমেরু’ জয় করলাম।

ইসরোর অফিসে বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস।

চাঁদের উপরে ৩০ কিলোমিটারের কক্ষপথে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল বিক্রম। আমাদের অফিস থেকে সারা ক্ষণ তার দিকে নজর রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৪ লক্ষ কিলোমিটার দূরে একটা যন্ত্র কোন পরিস্থিতির মুখে পড়বে, কী করবে, তার অধিকাংশই আর হাতে থাকে না। সকলে তাই ২৩ তারিখের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। দিন ঘনিয়ে এল। আমাদের উত্তেজনাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল। বুধবার সকাল থেকে এখানে আমরা সবাই স্বাভাবিকই ছিলাম। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই চারপাশে যেন চাপা একটা উত্তেজনা চোখে পড়ছিল। মুখে কেউ কিছুই বলছে না। অথচ, সকলের মধ্যে যেন একটা ‘কী হয়, কী হয়’ চাঞ্চল্য।

আমরা যে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম, তা কিন্তু নয়। কারণ, এত দিন ধরে এত রকম ভাবে আমরা যে সাফল্যের প্রস্তুতি নিয়েছি, তার উপর ভরসা ছিল। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। অনেক রকম প্রতিকূলতা কল্পনা করে আগে থেকে বিকল্প প্রস্তুত করে রেখেছি। সিস্টেমেও কোথাও কোনও ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি। ফলে আমাদের অভিযান যে সফল হবে, সে বিষয়ে আশাবাদী ছিলাম প্রথম থেকেই।

পৌনে ৬টা থেকে চাঁদের উপরের ৩০ কিলোমিটারের কক্ষপথ থেকে বিক্রমের ‘রাফ ব্রেকিং’ শুরু হল। ৭.৪ কিলোমিটারের কক্ষপথে এসে কিছুটা দম নিল ল্যান্ডার। সেখানেই ‘রাফ ব্রেকিং’ সম্পূর্ণ। ওই সময়ে দেখে নেওয়া হয়েছিল, সামনের পরিস্থিতি কতটা অনুকূল। এর পর ‘ফাইন ব্রেকিং’-এর পালা। এ সবই আসলে আমাদের আলোচনার সুবিধার্থে প্রচলিত ভাষা। নামতে নামতে ৮০০ মিটার উচ্চতায় এসে আবার সামান্য থামে বিক্রম। ৮০০ মিটার থেকে ক্রমে ১৫০ মিটার, ৬০ মিটার হয়ে ১০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছয় বিক্রম। ধাপে ধাপে তার গতি হ্রাস পেয়েছে। বিক্রমের মধ্যেকার ক্যামেরাগুলি প্রতি মুহূর্তে চাঁদের মাটিতে অপেক্ষাকৃত মসৃণ এলাকার সন্ধান করেছে। কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি।

আসলে, বিক্রমকে ওখানে পাঠানোর আগে থেকেই আমরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুর ২/৪ কিলোমিটার এলাকা স্ক্যান করে রেখেছিলাম। যেখানে গর্ত, খানাখন্দ আর পাথরের টুকরো তুলনামূলক কম ছিল। তাই অবতরণের সঠিক জায়গা খুঁজে নিতে বিক্রমের অসুবিধা হয়নি।

চাঁদে এখন সবে ভোর হল। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মাটিতে পা রাখল বিক্রম। তার দরজা খুলে গিয়ে পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসবে রোভার প্রজ্ঞান। এই যন্ত্রগুলির শক্তির উৎস সূর্যই। সৌরশক্তিতে কাজ করছে সব যন্ত্রপাতি। আপাতত আগামী ১৪ দিন চাঁদে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করবে প্রজ্ঞান। পৃথিবীর হিসাবে ১৪ দিন চাঁদে আসলে এক বেলা মাত্র। ১৪ দিন পরেই চাঁদের মাটিতে সূর্য ডুবে যাবে। সেই আঁধারে আমাদের চন্দ্রযানের ‘নটে গাছটিও যাবে মুড়িয়ে’। এখন ১৪টা দিন আমাদের অনেক অজানা তথ্য, জ্ঞান আহরণের পালা। নতুন আবিষ্কারের শিহরণে ভারতের তেরঙা উড়িয়ে অসীম সম্ভাবনাময় একটা দিন শুরু হল চাঁদের দেশে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.