গ্রাম থেকে হাই স্কুল দূরে। প্রাথমিকের পরে অনেকেই তাই ছেলেমেয়েদের আর স্কুলে পাঠাতেন না। স্কুলছুট বাড়ত। সঙ্কট মেটাতে বাম আমলের শেষে চালু হয়েছিল বেশ কয়েকটি জুনিয়র হাই স্কুল। কিন্তু বাঁকুড়া জেলায় অধিকাংশ জুনিয়র হাই স্কুলেই পড়ুয়া কমছে স্থায়ী শিক্ষকের অভাবে। পরিস্থিতি এমন যে, কোথাও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী বাধ্য হচ্ছেন ক্লাসে যেতে।
৩০০ জন পড়ুয়ার ইন্দাসের শান্তাশ্রম জুনিয়র গার্লস হাই স্কুলে রয়েছেন এক জন স্থায়ী শিক্ষিকা ও এক জন অতিথি শিক্ষক। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা শতাব্দী রায় জানান, দু’জন শিক্ষিকা বদলি হয়েছেন। এক জন শিক্ষিকার পক্ষে মিড-ডে মিল দেখা, চারটি ক্লাস সামাল দেওয়া, প্রশাসনিক কাজ করা প্রায় অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়েই ক্লাসে যান চতুর্থ শ্রেণির কর্মী গোলক মজুমদার।
এ ক্ষেত্রে অনিয়মের প্রশ্ন উঠছে। তবে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকার দাবি, ‘‘আমাদের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কোনও বিষয় পড়ান না। কখনও হাজিরা নিতে বা ক্লাস সামাল দিতে যান।’’ গোলক অবশ্য ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। কম্পিউটারের সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন। বিএড করার ইচ্ছাও রয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘২০২২ সালের অক্টোবরে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকার সময় আমি কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী প্রকল্পের সব কাজ এক জন করণিক হিসেবে করেছি। আমার সন্তান যদি শিক্ষকের অভাবে ক্লাসে বসে থাকত, তা হলে কী করতাম? তাই পড়ুয়াদের সঙ্গে ক্লাসে ইতিহাসের গল্প করি, নীতিমূলক গল্প শোনাই।’’ এতে আপত্তি নেই অভিভাবকদেরও। অভিভাবক শ্যামদাস মণ্ডল, প্রদ্যুৎ পালেরা বলেন, ‘‘দু’জন শিক্ষকের পক্ষে সব ক্লাস করা সম্ভব নয়। দু’-তিনটি ক্লাস ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই ছাত্রীদের বসে থাকতে হয়। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী উচ্চশিক্ষিত, এটাই ভরসা।’’
ইন্দাস ব্লকেরই চাঁদগ্রাম জুনিয়র হাই স্কুলে আবার স্থায়ী শিক্ষকই নেই। দু’জনই অতিথি শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক আশিস মেটে বলেন, ‘‘পড়ুয়া কমতে কমতে চল্লিশে ঠেকেছে।’’ অভিভাবক বাপি রায়, আজফর আলি লায়েকরা জানালেন, সামর্থ্য থাকলে দূরের স্কুলেই সন্তানদের ভর্তি করাতেন। একই অবস্থা পাশের ব্লক পাত্রসায়রের টাসুলি জুনিয়র হাই স্কুলেরও। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক (অতিথি শিক্ষক) মুক্তচন্দ্র কুণ্ডু বলেন, ‘‘৫২ থেকে ছাত্র-ছাত্রী ১২-য় নেমেছে। শিক্ষকের অভাবে স্কুল না বন্ধ হয়ে যায়!’’
রাজ্যে দীর্ঘদিন স্কুল শিক্ষক নিয়োগ থমকে থাকাতেই এই পরিস্থিতি, দাবি বিরোধী শিক্ষক সংগঠনগুলির। এবিটিএ-র জেলা সম্পাদক অস্মিতা দাশগুপ্ত জানালেন, রানিবাঁধের বিক্রমডিহি, ধাদকিডিহি, মুকুন্দপুরের জুনিয়র হাই স্কুল, ঝিলিমিলি গার্লস জুনিয়র হাই স্কুল, ওন্দার অঙ্গদপুর এবং সোনামুখী খাগ জুনিয়র হাই স্কুলও শিক্ষকের অভাবে বন্ধ হওয়ার মুখে। তাঁর মতে, ‘‘শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী দেড় কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে। তাই জেলায় ৩৪৫টি জুনিয়র হাই স্কুল চালু হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রায় সবই ধুঁকছে।’’
পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির বাঁকুড়া জেলা সভাপতি গৌতম দাসের অবশ্য দাবি, ‘‘শীঘ্রই উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ হবে।’’ বাঁকুড়ার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পীযূষকান্তি বেরারও আশ্বাস, ‘‘শূন্য পদের তালিকা শিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়েছে। নিয়োগ হলেই ওই স্কুলগুলি শিক্ষক পাবে।’’