যাদবপুরের ঘটনায় অনেকেই বলছেন এসএফআইকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করা অনুচিত হচ্ছে।কারণ তারা নাকি যাদবপুরে ততোটাও “শক্তিশালী” নয়।
আচ্ছা এই যে দশ তারিখের প্রেস রিলিজ এসএফআই-এর পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল, এখানে ঠিক কি বলা হয়েছে?
এখানে বলা হচ্ছে আত্মহত্যা।
তা এসএফআই-এর হাতে কি দশ তারিখে এমন কোন প্রমাণ ছিল যার দ্বারা তারা নিশ্চিত হয়েছিল ঘটনা হত্যার নয়, আত্মহত্যার?
আজকে তাহলে এমন কি প্রমাণ এলো যার জন্য তিন দিনের মাথায় নিজেদের অবস্হান পাল্টে এসএফআই ঘোষণা দিল এই ঘটনা আত্মহত্যার নয়, হত্যার?
যদি মনে করি এই তিনদিন আসলে সরকারের সাথে দরদাম চলছিল ঠিক কাকে কাকে ধরা হবে, কাকে কাকে বলির বখরা বানানো হবে, তাই ঘটনার প্রথমেই আত্মহত্যার সিলমোহর দিয়ে কাউকে কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছিল, তাহলে কি সেটা ভুল ভাবব?
আসলে যাদবপুরে অংশদীয়, সংসদীয় সব বামই একই গোত্রের। এখানে ছেলে টানার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে।সেই পদ্ধতি মেনেই সব দল চলে।
যেমন ধরুন, প্রথমে এই সৌরভ চৌধুরীদের মতো ছেলেরা, যারা জেলার ছোট ছোট শহর বা গ্রাম থেকে এসেছে তাদের এগিয়ে দেওয়া হবে রাগিং করতে।
প্রশ্ন হোল এদেরই কেন এগিয়ে দেওয়া হবে বা এরাই কেন এগিয়ে যাবে?
প্রথমত এদের কোন ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সেভাবে। ফলত অংশদীয় হোক বা সংসদীয়, দাদারা জানেন এরা তাদের কখনই পাল্টা চাপ দিতে পারবেনা।বরং একাডেমিক নানা সুযোগ সুবিধার জন্য এরা দাদাদের উপর নির্ভরশীল হয়েই থাকবে।প্লাস এইসব জেলার ছেলেদের একটু পাম্প দিয়ে ছেড়ে দিলে এরা নিজেদের বৈপ্লবিক সত্ত্বা প্রমাণের তাগিদে ধরে আনতে বললে বেঁধেই আনবে।
এই বেঁধে আনার কাজটি “কাফি” হওয়ার পরে আসরে নামবেন দাদারা। তারা এরপর সদ্য ক্যাম্পাসে আগত ছেলেটি বা মেয়েটিকে শেল্টার দেওয়ার নামে নিজের কক্ষগত করবেন।ততোদিনে হয় ছেলেটি বা মেয়েটিও বুঝে যাবে যে তাকে যদি এখান থেকে ডিগ্রী নিয়ে বেরোতে হয় তাহলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করে লাভ নেই।বরং এই কাফির মতো দাদাদের শেল্টারে থেকে মানে মানে ডিগ্রীটা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়াই ভালো।
এই শ্রেণী হোল বুদ্ধিমান শ্রেণী।এরা জানে এদের যোগ্যতা আছে। কাজেই একবার পাস করে বেরিয়ে গেলে আর যাদবপুরে টিকি বেঁধে রাখার দরকার নেই। কিন্তু এর বাইরে একটা বেশ বড় অংশ আছে এই সৌরভ, মনোতোষদের মতো।যারা পড়াশুনার সময়টায় “কলরব” করতে গিয়ে নিজেদের কেরিয়ারটির বারোটা বাজিয়ে ফেলেছে। এখন যাদবপুরের বাইরে বেরোলে এরা কোথাওই “চান্স পেয়ে” দেখাতে পারবেনা।বরং এখানে দাদাদের কাছের এবং কাজের লোক হয়ে থাকা গেলে নানা সুবিধা পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে।
যদিও নানা রকম রাগিং থুড়ি বিপ্লবের পরেও এরা এই দাদাদের থেকে কাফি ছেড়ে যৎসামান্যও পাননা।সেটা পায় যাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, যাদের অংশদীয় বা সংসদীয় বামপন্হার “ফ্যামিলি” ব্যাকগ্রাউন্ড আছে তারাই।অর্থাৎ কোলকাতার ছেলেরাই।
আর ধরুন কেউ এইসব কিছু সহ্য করেও এই দাদাদের গোয়ালে ঢুকলনা।তাহলে তার অবস্হা হবে সুরঞ্জন সরকারের মতো। অধ্যাপকরাই তাকে জানিয়ে দেবে যেহেতু সে অংশদীয়, সংসদীয় সব বামদল ছেড়ে এবিভিপির মতো “প্রতিক্রিয়াশীল” শক্তির সাথে গেছে তাই তাকে তারা ক্লাসে এল্যাও করতে পারবেননা, কারণ তাতে নাকি এই অংশদীয়, সংসদীয়দের মুক্ত চিন্তায় বাধা পরছে।
আহা, মুক্ত চিন্তার কি বহর! এমনই মুক্ত চিন্তার শক্তি যে আর্বাণ নকশালদের নিয়ে সিনেমা ক্যাম্পাসে দেখানো হলে ভয় পেয়ে মুক্তচিন্তকরা হাঙ্গামা বাধিয়ে দেন সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করতে।
এবার এই যে অংশদীয় বা সংসদীয়, দুই দলই একে অপরের থেকে নানা সুবিধা পেয়ে থাকে।কাজেই দুই দলেরই দায় থাকে দায়ে বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর। ঠিক যেমন এক্ষেত্রে ঘটনা ঘটার পরেই সংসদীয় বামেরা তড়িঘরি আত্মহত্যায় শিলমোহর দিতে চেয়েছিল।কারণ ধরা তো পরেছে খালি তিনটি ছেলে।তার বাইরে বাচানো তো হচ্ছে আরও অনেককে।তার মধ্যে যেমন ডিন অব স্টুডেন্ট আছে, হোস্টেল সুপার আছে, রাগিং বিরোধী কমিটির তরুণ তুর্কী নেতা আছেন, তেমনই অনেক অংশদীয় বা সংসদীয় নেতাদের ছেলে “বৌমারাও” আছেন।
ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত যদি হতো তাহলে দেখতেন অংশদীয়, সংসদীয় সবাই জালে জড়িয়েছে।কিন্তু আমরা জানি তা হবেনা।কারণ ঐ যে আগেই বলেছি, বেশী টানাটানি হলে আবার নো ভোট্টুর ভাঁড়ারে টান পরবে। সেই কারণেই তিনটি বলির বখরা দিয়েই এযাত্রা সামলে দেওয়া যাবে।
আজকে যারা সাধু সাজছেন, বছর কয়েক আগে যখন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ক্যাম্পাসে বহিরাগত অনুপ্রবেশ আটকাতে চেয়েছিলেন এবং সিসিটিভি বসাতে চেয়েছিলেন তখন ঠিক কারা বাধা দিয়েছিলেন? কোন কোন অধ্যাপকরা সেদিন ক্যাম্পাসে মুক্তচিন্তার প্রসারে বাধা পরবে ভেবে প্রবল “চিন্তান্বিত” হয়ে উঠেছিলেন?
আজ টিভিতে দেখলাম এরকমই এক অধ্যাপিকা ক্যাম্পাসে সিসিটিভি না থাকা নিয়ে খুবই দুঃখপ্রকাশ করলেন।অথচ সংসদীয় বামেদের হয়ে দুবার ভোটে দাঁড়ানো এই অধ্যাপিকাই সেদিন হোক কলরবের “পাশে” দাঁড়িয়েছিলেন।
আসলে আজকে যারা ছেলেটির মৃত্যু নিয়ে কুম্ভীরাশ্র বওয়াচ্ছেন, সেদিন যারা ক্যাম্পাসে সিসিটিভির বিরোধিতা করেছিলেন তারা কি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন?
নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো যাদবপুরের উপাচার্যকে পাঠানো চিঠিতে ঠিক কি বলেছে? সেদিন যখন স্বপ্নদীপের পরে যাওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ হোস্টেলে যায় তখন পুলিশকে হোস্টেলে ঢুকতে বাধা কারা দিয়েছিল? শুধুই কি অংশদীয়রা? নাকি সংসদীয়রাও সাথে ছিল? সংসদীয়রা তো এখন “পবিত্র গঙ্গার জলে” গলা ডুবিয়ে বলছে তারা “এসবের” মধ্যে থাকেনা।তা তারা যখন দশ তারিখ থেকে তেরো তারিখে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে ঘটনা হত্যার নয় আত্মহত্যার, তাহলে নিশ্চয়ই তারা এটাও জানে যে কারা সেদিন পুলিশকে আটকেছিল? তারা নিশ্চয়ই এটাও জানে যে কারা হোস্টেলকে মদ, গাঁজা, যৌনতার মুক্তাঞ্চল বানিয়ে রেখেছে? তারা তাহলে এদের চিহ্নিত করতে এবং পুলিশের হাতে তুলে দিতে পুলিশকে সাহায্য করুক। নাকি তাতে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে যাবে?
হোস্টেল সুপার আজ বলছেন তিনি নাকি হোস্টেলে ঢুকতে পারতেননা। হোস্টেলে গেলে তিনি ঘেরাও হয়ে যেতেন। তা সুপার কি জানাবেন কারা তাকে ঘেরাও করত? আর বারবার ঘেরাও হওয়ার পরেও কেন তিনি নিজ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চাননি কিংবা তিনি কি এই ঘটনা উপাচার্যকে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন? যদি জানিয়ে থাকেন তাহলে উপাচার্য ঠিক কি ব্যবস্হা নিয়েছিলেন?
মিলিয়ে নেবেন, জনরোষের কারণে সরকার যদি বাধ্য হয় একটু বেশী ধরপাকর করতে তাহলে এই অংশদীয়, সংসদীয় সব বামেরাই নেমে পরেছে “কলরব” তুলে “রাষ্ট্রের অত্যাচারের” বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে।আর আজ যে অধ্যাপক, অধ্যাপিকারা “গুডি গুডি” সেজে দুঃখ প্রকাশ করছেন তারাই আবার সেদিন মুক্তিচিন্তার প্রসারে এই খুনীদের পাশে দাঁড়িয়ে পরেছেন। (খুনী কথাটা ভেবেচিন্তেই লেখা, কারণ যারা খুনীদের আড়াল করতে চায়, তারাও খুনী)আসলে যাদবপুরে যা হচ্ছে তা হোল পকেটমারির গ্যাং।ঠিক যেমন একজন পকেটমার ধরা পরলে সেই দলের বাকী পকেটমাররাই সব থেকে বেশী চেঁচায় এবং লাফায় এবং তারপরে পাবলিকের থেকে পকেটমারকে আলাদা করে দেয়।এও তেমনই হচ্ছে এবং তাতে রাজ্য সরকারেরও সম্পূর্ণ সহযোগীতা আছে। বিপদের দিনের “নো ভোট্টু” বন্ধুদের আর কেইবা বিপদে ফেলতে চায়।বরং এই সময়ে পাশে দাঁড়ালে পরের ভোটে “নো ভোট্টুর” খরচা কিছু কম হবে।আর স্বপ্নদীপ তো একটা জেলার ছেলে, ওরকম এক আধটা ছেলে মরে গেলে আর সরকারের কিইবা যায় আসে।সেই কারণেই তো এখনও আমাদের মুখ্যমন্ত্রী এক লাইনও বলেননি এই নিয়ে। কারণ একটা স্বপ্নদীপের থেকে খুনী হলেও নো ভোট্টুরা সরকারের বেশী কাজের। আসলে চামড়া সবই নির্লজ্জের, খালি জার্সির কালার আলাদা।
দীপ্তস্য জশ