চিত্তরঞ্জনকে নির্দেশ দিলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আত্মা, ‘‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ’’! 

Story image

প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কুখ্যাত ডগলাস কিংসফোর্ডকে তখন হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছে বিপ্লবীরা। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ব্যর্থ হলেও পরিকল্পনা বন্ধ হয়নি। উল্টোদিকে, কিংসফোর্ডকে হত্যার ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’-ও হন্যে হয়ে খুঁজছে ব্রিটিশ পুলিশ। ১৯০৮ সালের ২ মে, মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি, ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট, ১৩৪ নং হ্যারিসন স্ট্রিট-সহ কলকাতার নানা ডেরায় তল্লাশি হল। গ্রেপ্তার হলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, অরবিন্দ ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো সহ অসংখ্য বিপ্লবী। উদ্ধার হল বোমা তৈরির মালমশলাও। শুরু হল কুখ্যাত ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’।

অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়ালেন ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। বিচারপতি চার্লস পোর্টেন বিচক্রফ্‌টের এজলাসে শুনানি চলছে। খবরের কাগজের পাতার পর পাতা জুড়ে এই মামলারই খবর। এই সময়ে, ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ এই মামলা থেকে অনেকটাই দূরে। তাঁর ঝোঁক জন্মেছে আত্মা-চর্চায়। তাঁর রসা রোডের বাড়িতেও বসে প্ল্যানচেটের আসর। কিন্তু, ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’-র খবর তাঁকেও বিব্রত করে, দুশ্চিন্তা হয়। নিজে কলকাতা অনুশীলন সমিতির সহ-সভাপতি ছিলেন পাঁচ বছর। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার সঙ্গেও গভীর সম্পর্ক ছিল। মামলার গতিপ্রকৃতি তাই চিত্তরঞ্জনকে বিচলিত করে। একদিন, আলিপুর মামলা নিয়েই আলোচনার জন্য তিনি ডেকে আনলেন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আত্মাকে। সেই আত্মা বারংবার নির্দেশ দিলেন, ‘‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ।’’

এরপর, এই মামলা লড়তে এলেন চিত্তরঞ্জন। তখন তাঁর আয় মাসে হাজার পাঁচেক। অভিযুক্তদের থেকে টাকা নেওয়া দূরের কথা, উলটে এই মামলা লড়তে গিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা দেনা হয়ে গেল তাঁর। দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলল। ৯ দিন ধরে নিজের পরিসমাপ্তি বক্তব্য দিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। ফলাফল সবারই জানা। মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া ঝুলছিল যাঁর মাথায়, সেই অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পেয়ে গেলেন।

প্ল্যানচেটের সূত্রে মামলা লড়ার নির্দেশ পাওয়ার কাহিনি আমাদের অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে না। কিন্তু, তারপরের ঘটনাকে তো অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯১০ সালে ‘ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা’ কিংবা ১৯১৪-এ ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলা’– ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন বারবার ভারতীয় বিপ্লবীদের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর অসামান্য যুক্তি ও সওয়াল অভিযুক্ত বিপ্লবীদের শাস্তি অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে। আদালত অবমাননার দায় থেকে মুক্ত করেছেন অমৃতিবাজার পত্রিকার সম্পাদককেও। ব্যারিস্টার হিসেবে তিনি কিংবদন্তি। ব্যারিস্টারি করে বিপুল রোজগার করেছেন, বিলিয়েও দিয়েছেন অকাতরে। এই শিক্ষা অবশ্য বাবা ভুবনমোহন দাশের থেকেই পেয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন। পরোপকারী ও দাতা সেই মানুষটাকে তো দেউলিয়াও হতে হয়েছিল।

আর চিত্তরঞ্জন? কংগ্রেসের কাজে ময়মনসিংহ যাচ্ছেন। অনেকটা পথ। তাঁর জন্য প্রথম শ্রেণির কামরার টিকিট কাটা হয়েছে। চিত্তরঞ্জন রাজি নন। হেসে বললেন, “আমি তো ভাই আর পঞ্চাশ হাজারি ব্যারিস্টার সি আর দাশ নই। কোনো মামলাও পরিচালনা করতে যাচ্ছি না। যাচ্ছি দেশের জনগণের কাছে তাঁদের সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁরা তো তৃতীয় শ্রেণিতেই চড়েন।” এখান থেকেই চেনা যায় মানুষটাকে।

তিলক স্বরাজ তহবিলের অর্থ সংগ্রহ চলছে গোটা কলকাতা জুড়ে। ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জনের বাড়ি থেকেই এই তহবিল গড়ার সলতে পাকিয়েছেন মহাত্মা গান্ধি। কলকাতার পথে-পথে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করছেন কর্মীরা। বেশ্যাপাড়াতেও অর্থ সংগ্রহ করতে যাওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক বাঁধল। চিত্তরঞ্জন অটল, তিনি অর্থসংগ্রহের জন্য বেশ্যাপাড়ায় যাবেন। “বেশ্যা বলে কি তাঁরা বাংলার নারী নন? নন কি পরাধীনা? নিপীড়িতা?… স্বরাজ তো তাই এদেরই জন্য। যে স্বরাজ দেশের অর্থাভাব দূর করবে না, দূর করবে না শোষণ, নির্যাতন, মুক্তি দেবে না পতিত-পতিতাদের, তেমন স্বরাজ এ দেশের মানুষ চান না। আমিও চাইনে।”

পরদিন নিজে কলকাতার বারাঙ্গনাপল্লিতে এসে দাঁড়ালেন চিত্তরঞ্জন। দরজায় দরজায় ঘুরে ঘুরে বলতে লাগলেন, “মা-বোনেরা স্বরাজ ফান্ডে ভিক্ষা দাও।” সমাজ এতদিন যাঁদের ঘৃণাভরে প্রান্তিক করে রেখেছিল, তাঁদের কাছে এ যেন মুক্তির ডাক। কাঁদতে কাঁদতে নিজেদের সঞ্চয়, গয়না চিত্তরঞ্জনের কাছে উপুড় করে দিয়েছিলেন সেদিন নিষিদ্ধ পল্লির ‘পতিতা’-রা। তাঁর পায়ে মাথা ঠুকে বলতে লাগলেন, “বাবা, আমাদের কি মুক্তি হবে?” দেশবন্ধুর দু’চোখ ভরেও তখন নদী বইছে।

নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল গড়েছেন মানুষটি। নিজের পৈতৃক বাড়িও দান করে দিয়েছেন জনহিতার্থে। আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় জেল খেটেছেন। লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ চুক্তি করেছেন। স্বপ্ন দেখতেন, হিন্দু-মুসলমানের যৌথ অখণ্ড বাংলার। সেই স্বপ্ন আর সফল হয়নি…

বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করে গেলেন দার্জিলিং। সেখানেই মৃত্যু আকস্মিকভাবে নিয়ে গেল তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর শোকে কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘রাজভিখারী’। এমনকি, কবিতা লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশও। তৎকালীন বাংলার তিন কবিকে যিনি একসূত্রে বাঁধতে পারেন, তিনি সামান্য মানুষ হতে পারেন না। সারা দেশও যে তাঁকে দেশবন্ধু হিসেবেই চিনত। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.