সাড়ে চার বছর, টানা দশটি ডার্বির পর অবশেষে শাপমুক্তি!
কলকাতা ডার্বিতে অবশেষে জিতল ইস্টবেঙ্গল। শনিবার ডুরান্ড কাপে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে নন্দকুমারের একমাত্র গোলে মোহনবাগানকে হারিয়ে দিল তারা। বিশ্বকাপার জেসন কামিংস-সহ পূর্ণশক্তির দল নামিয়েও ইস্টবেঙ্গলকে হারাতে পারল না মোহনবাগান। ২০১৯-এর ২৭ জানুয়ারির পর আবার কলকাতা ডার্বিতে জিতল ইস্টবেঙ্গল।
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর তখন পাঁচ মিনিটও হয়নি। ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে প্রদক্ষিণ করছেন ফুটবলারেরা। এত ক্ষণ ধরে রাখা গেলেও সহ্যের সীমা আর বাঁধ মানল না। পিল পিল করে মাঠে ঢুকে পড়লেন সমর্থকেরা। যুবভারতীতে তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। তার মাঝেই লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে মুক্তির আনন্দ। সাড়ে চার বছর ধরে বয়ে চলা অপমানের মুক্তির। গ্যালারিতে একের পর এক বোম ফাটতে লাগল। বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় সেনাবাহিনীর কর্তারা সমর্থকদের তাড়া করা শুরু করলেন। কিন্তু আবেগ বাঁধ মানলে তো! হিমশিম খেতে হল নিরাপত্তারক্ষীদের। কিন্তু রাতটাই ছিল লাল-হলুদের। ম্যাচের অনেকক্ষণ পরেও দর্শকাসনে ‘ইস্টবেঙ্গল, ইস্টবেঙ্গল’ করে চেঁচিয়ে গেলেন তাঁরা।
কে ছিলেন না মোহনবাগানের দলে? সবচেয়ে আলোচিত নাম কাতার বিশ্বকাপে খেলা অস্ট্রেলিয়ার জেসন কামিংস। বলা হয়েছিল দরকারে তাঁকে নামানো হবে। ইস্টবেঙ্গলের খেলা এমনই ছিল যে সেই ‘দরকার’ এসে গেল ম্যাচের ৫৫ মিনিটেই। এ ছাড়া, ভারতীয় ফুটবল দলে মিডফিল্ডে যাঁরা নিয়মিত খেলেন, সেই সাহাল আব্দুল সামাদ, অনিরুদ্ধ থাপা, লিস্টন কোলাসোও অনেক ক্ষণ ধরে খেললেন। লিস্টনকে গোটা ম্যাচে পকেটে পুরে রাখলেন খাবরা। ক্রেসপো মাথা তুলতে দিলেন না অনিরুদ্ধকে। আর কামিংসের খেলা দেখে বোঝা গেল এখনও ভারতীয় ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে।
তার বিপরীতে ইস্টবেঙ্গল! দলটাই তৈরি হয়েছে কিছু দিন আগে। সেরা ফুটবলার ক্লেটন সিলভা শনিবার সকালেই এসেছেন। তাঁর খেলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। বাকি যাঁদের নেওয়া হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ভাল ভাবে বোঝাপড়াই গড়ে ওঠেনি। সেই দল নিয়েই বাজিমাত করে দিলেন কার্লেস কুয়াদ্রাত। বাংলাদেশ সেনার বিরুদ্ধে যে দলটা আগের ম্যাচে দু’গোলে এগিয়ে ড্র করেছিল, তারাই ৬০ মিনিটে গোল দিয়ে ভারতের অন্যতম সেরা দলকে আটকে রাখল ম্যাচের শেষ পর্যন্ত।
স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাচের শুরু থেকে আক্রমণ ছিল মোহনবাগানের। ইস্টবেঙ্গল খেলছিল ধীরগতিতে। কিন্তু সময় যত গড়াল ততই এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে এই ইস্টবেঙ্গল আগের তিন বারের দল নয়। গত তিন বছরে যে ভাবে বার বার লাল-হলুদের রক্ষণ ভেঙে ঢুকে যেতেন মোহনবাগানের ফুটবলারেরা, এ দিন সেটা হচ্ছিল না। বরং ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্স ছিল অনেক ছন্দবদ্ধ।
মন্দার রাও দেশাই ইতিমধ্যেই ভারতীয় ফুটবলে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বাঁ দিক থেকে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনিই। কম যাননি বুড়ো ঘোড়া হরমনজ্যোত খাবরাও। মাঝে জর্ডান এলসেকে নিয়ে একটু চিন্তা ছিল। তিনিও মন্দ খেলেননি।
প্রথম সুযোগটা পেয়েছিল মোহনবাগানই। বাঁ প্রান্ত থেকে উঠে এসেছিলেন লিস্টন কোলাসো। তিনি পাস করেছিলেন আর্মান্দো সাদিকুকে। চলতি বলে সাদিকুর শট বারের বেশ কিছুটা উপর দিয়ে চলে যায়। এর পর ধীরে ধীরে ম্যাচে ফেরে ইস্টবেঙ্গল। মোহনবাগানের আক্রমণের পাল্টা দিয়ে প্রতি আক্রমণে উঠতে থাকে তারা। বক্সের একটু বাইরে ডান দিকে একটি ফ্রিকিক পায় ইস্টবেঙ্গল। লম্বা ক্রস পেয়েছিলেন জর্ডান এলসে। কিন্তু হেডে সঠিক পাস দিতে পারেননি। মোহনবাগানের গোলকিপার বিশাল কাইথ বল তালুবন্দি করেন।
কিছু ক্ষণ পরে আবার সুযোগ এসেছিল ইস্টবেঙ্গলের সামনে। এ বার বাঁ প্রান্ত ধরে উঠে আসা মহেশ পাস দেন জেভিয়ার সিভেরিয়োকে। স্পেনের খেলোয়াড়ের শট আটকে দেন মোহনবাগানের ডিফেন্ডার আনোয়ার। তার পরেই সিভেরিয়ো পাস দিয়েছিলেন নন্দকুমারকে। কিন্তু একটু জোরে পাস হওয়ায় মোহন গোলকিপার বিশাল এগিয়ে এসে সে যাত্রা দলকে বাঁচিয়ে দেন। মোহনবাগানও থেমে থাকেনি। সেই সময়ে ইস্টবেঙ্গল টানা আক্রমণ করলেও প্রতি আক্রমণে একটি সুযোগ পেয়েছিল সবুজ-মেরুন। বাঁ দিক থেকে আশিস রাই বল বাড়িয়েছিলেন মনবীরের উদ্দেশে। কিন্তু পঞ্জাব-তনয়ের শট অনেক উপর দিয়ে উড়ে যায়।
প্রথমার্ধে ইস্টবেঙ্গলকে অনেকটাই ঝলমলে লেগেছে। অতীতে যে ভাবে মোহনবাগানকে দেখলেই দল কুঁকড়ে যেত, সেটা একদমই দেখা যায়নি। বরং কার্লেস কুয়াদ্রাতের ছেলেরা বার বার আক্রমণে উঠেছেন। রক্ষণও ছিল শক্তিশালী। সে ভাবে দাঁত ফোটাতেই পারেনি মোহনবাগান।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই দুই দলই নেমেছিল গোলের লক্ষ্যে। কিন্তু ফাইনাল থার্ডে গিয়ে মোহনবাগান সুযোগ কাজে লাগাতে পারছিল না। হুগো বুমোস মাঝ মাঠ সে ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। লিস্টনকে কার্যত পকেটে পুরে রেখেছিলেন খাবরা। ফলে মনবীরও বল পাচ্ছিলেন না।
গোলের লক্ষ্যে ৫৫ মিনিটের মাথায় জোড়া বদল আনেন মোহনবাগানের কোচ জুয়ান ফেরান্দো। একসঙ্গে নামিয়ে দেন দুই বিদেশিকে। বুমোস এবং সাদিকুকে তুলে নামান অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপার জেসন কামিংস এবং দিমিত্রি পেত্রাতোসকে। কাকতালীয় হলেও তার পরেই গোল খেয়ে যায় মোহনবাগান। আনোয়ার আলির ভুল পাসে বল পেয়েছিলেন সাউল ক্রেসপো। তিনি পাস দেন ডান দিকে থাকা নন্দকুমারকে। সামনে তখন মোহনবাগানের মাত্র দু’জন খেলোয়াড়। নন্দকুমার বেশ খানিকটা এগিয়ে কিছুটা থমকালেন। মোহনবাগানের ডিফেন্ডারকে মাটি ধরিয়ে বাঁ পায়ের বাঁকানো শটে বিশালকে পরাস্ত করে বল জালে জড়ান নন্দ।
লাল-হলুদ গ্যালারি তখন উত্তাল। চার বছর পর যুবভারতীতে ডার্বিতে গোল করল ইস্টবেঙ্গল। দীর্ঘ দিন বাদে পাওয়া মুহূর্ত খোয়াতে চাইছিলেন না ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা। উল্টো দিকে থাকা মোহনবাগান গ্যালারি তখন স্তব্ধ।
গোল করে কিছুটা সময়ের জন্যে তেড়েফুঁড়ে আক্রমণে উঠেছিল মোহনবাগান। কামিংস অন্তত দু’টি ভাল সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রথম বার তাঁর ডান পায়ের শট আটকে যায় ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারের গায়ে। দ্বিতীয় বারের সুযোগটা অনেক ভাল। বাঁ দিকে ভাসানো ক্রস। কিন্তু কামিংসের বাঁ পায়ের শট উড়ে গেল বারের উপর দিয়ে।
ম্যাচ শেষের তখন মিনিট কয়েক বাকি। যুবভারতী জুড়ে নামল বৃষ্টি। তার মধ্যেই একটানা আক্রমণ করে গেল মোহনবাগান। কিন্তু সমতা ফেরানোর গোল অধরাই থাকল।