ভিজে চোখের কোণে কালি পড়েছে। কথা বলতে গেলেই ওঁরা কেঁদে ফেলছেন।
“বিচার পাবে তো আমার ছেলে?” কাঁপা গলায় বলে ওঠেন মা। বাবা জানতে চান, “আদৌ সামনে আসবে তো ওর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ? শেষ পর্যন্ত সবটা ধামাচাপা পড়ে যাবে
না তো?”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে মৃত স্বপ্নদীপ কুণ্ডুর মামার বাড়ি রানাঘাটে। সেখানেই আপাতত রয়েছেন তাঁর বাবা-মা আর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাই। শুক্রবার বিকেলে সেখানে বসেই তাঁরা আকুল আর্জি জানান, যারা এই ঘটনার পিছনে রয়েছে, তাদের যেন চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া হয়।
বুধবার রাত সওয়া ১১টা নাগাদ অন্য এক জনের ফোন থেকে মা-কে ফোন করেছিলেন স্বপ্নদীপ। কার্যত আর্তনাদ করে বলেছিলেন, “মা, আমাকে বাঁচাও।” বলেছিলেন, “তুমি এখনই এসো। আমাকে নিয়ে যাও। তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে।” তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন, সেটা আর জানা হল না মায়ের। এর খানিক পরেই হস্টেল থেকে ফোন করে কেউ জানায়, স্বপ্নদীপ পড়ে গিয়েছেন। ছেলের বড় মামাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা রামপ্রসাদ কুণ্ডু যখন কেপিসি হাসপাতালে পৌঁছন, তখন সব শেষ। সমস্ত কথা বুকের মধ্যে নিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন স্বপ্নদীপ।
প্রশ্ন এখন একটাই, এই অপমৃত্যুর পিছনে আসল কারণ কী? ঠিক কী ঘটেছিল সে দিন?
স্বপ্নদীপের বাবা-মা, মামা-মামিরা কেউ মানতে রাজি নন যে, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। রামপ্রসাদের দাবি, “আমার ছেলেকে ওরা মারাত্মক র্যাগিং করেছে। প্রচণ্ড অত্যাচার করেছে। সেটা যাতে জানাজানি না হয়, তার জন্যই ওকে খুন করা হয়েছে।” খুনের পিছনে হস্টেলের একাধিক ‘সিনিয়র’ যুক্ত বলে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, দু’জনের নামও দিয়েছেন।
রামপ্রসাদ জানান, গত ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্ম জমা দেওয়ার পরে বাইরে একটি খাবারের দোকানে এক সিনিয়রের সঙ্গে তাঁদের আলাপ হয়। তিনিই স্বপ্নদীপকে তাঁর হস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তবে আবাসিক হিসেবে নয়, এক সিনিয়রের ‘অতিথি’ হিসাবে। মাস দুয়েক পরে স্বপ্নদীপ আবাসিক হয়ে যাবেন বলে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল। আপাতত খাওয়া-খরচ বাবদ হস্টেলের দাদাদের হাতে রবিবার এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন স্বপ্নদীপ। এ দিন সে কথা বলতে বলতে হু-হু করে কেঁদে ফেলেন রামপ্রসাদ। বলেন, “যারা আমার ছেলেকে মেরেছে, তারা নরপিশাচ, তারা নরখাদক।”
স্বপ্নদীপের থেকে সামান্য ছোট রত্নদীপ। দু’জনের সম্পর্ক প্রায় বন্ধুর মতো। একে অন্যকে ডাকতেন ‘ভাই’ বলে। মৃত্যুসংবাদ আসা ইস্তক সে কার্যত বোবা হয়ে গিয়েছে। বুধবার রাত থেকে এক দানা খাবার মুখে তোলেননি মা আদর কুণ্ডু। মাঝে-মধ্যে ছেলের নাম ধরে চিৎকার করে উঠছেন। স্বামীকে সামনে পেলে জানতে চাইছেন, “আমার গোপাল ফিরবে তো আমার কোলে?”
স্বপ্নদীপদের নিজেদের বাড়ি নদিয়ারই হাঁসখালি থানার বগুলায়। বৃহস্পতিবার রাত ১১টা নাগাদ তাঁর দেহ প্রথমে রানাঘাটের এই বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরে নিয়ে যাওয়া হয় বগুলার বাড়িতে। অত রাতেও পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছিল। সেখান থেকে শান্তিপুর শ্মশানের দিকে রওনা দেওয়ার সময়ে খাট কাঁধে তুলে রামপ্রসাদ ককিয়ে ওঠেন— “গোপাল রে…!” রাত পেরিয়ে গেলেও সেই আর্তনাদ ভুলতে পারেনি বগুলা।
শুক্রবার সকালেই স্বপ্নদীপের মৃত্যুর বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি চেয়ে বগুলায় প্রতিবাদ মিছিল বার হয়। বগুলা শ্রীকৃষ্ণ কলেজের সামনে থেকে রওনা হয়ে মিছিল যায় স্বপ্নদীপ-রত্নদীপদের বগুলা হাইস্কুলে। ছাত্র থেকে শিক্ষক, অবিভাবক থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সকলেই মিছিলে যোগ দেন। একসময়ে পড়ুয়ারা কৃষ্ণনগর-দত্তফুলিয়া রাজ্য সড়কের উপর বসে পড়ে। পরে তারা রাস্তা ছেড়ে উঠে গেলেও বিচারের দাবি দিনভর স্কুল-বাজার-চায়ের দোকান সর্বত্র ঘুরেছে।