স্বামী বিবেকানন্দের জ্বালানো দেশপ্রেমের আগুন শুধু ভগিনী নিবেদিতা নিজের মধ্যে প্রজ্বলিত করেননি, তিনি এই ভারতপ্রেমের আগুনের শিখা সারা দেশের প্রত্যেক প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
নিবেদিতা দেশের বহু শহরে ও নানা প্রদেশে গেছেন। তাঁর জ্বলন্ত বক্তৃতা ও বীরাঙ্গনার ন্যায় আহ্বানের মাধ্যমে স্বামীজির বাণী, আদর্শ ও দেশপ্রেম দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
উনি চারিদিকে ভারতের আদর্শ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি, আমরা ভগিনী নিবেদিতার মাধ্যমেই স্বামী বিবেকনন্দকে আরও ভাল করে জানতে পারি। নিবেদিতার জন্যেই, আমরা স্বামীজিকে ও ভারতবর্ষকে আরও ভাল করে বুঝতে পারি।
বিবেকানন্দ ছিলেন যেন মহাদেব ও নিবেদিতা তাঁর ভাগীরথী। উনি বিবেকানন্দের সকল চেতনা ও আদর্শ যেন নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন, এবং সেই চেতনা ও জ্ঞানের স্রোতে ভাগীরথীর মতো প্রবহমান ছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ যখন পাশ্চাত্যে যান, ওঁর কাছে হিন্দু সভ্যতার ঐতিহ্য ছাড়া আর কোন সম্পদ ছিল না।
স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক বক্তৃতা শুনে মার্গারেটের মধ্যে তাঁর আনুগত্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন ও মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা জেগে উঠেছিল।
নিবেদিতা একজন কৌতূহলী ও তার্কিক মহিলা ছিলেন এবং তাঁর মধ্যে মানুষকে শিক্ষিত করার, তাদের সেবা করার ও নিজের আধ্যাত্মিক জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা ও ব্যক্তিত্ব তাঁকে ভারতের বৈদান্তিক জ্ঞান ও ভারতের সভ্যতার সম্বন্ধে যথেষ্ট আকর্ষিত করেছিল। তিনি তাঁর এই কাজে যোগদান করার সদিচ্ছা জানিয়েছিলেন।
“আমি খুব স্পষ্ট ভাবে বলি, যে আমি খুবই নিশ্চিত যে তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে ভারতে সেবার কাজে। যার প্রয়োজন ছিল সে একজন পুরুষের নয়, একজন নারীর। এক সত্যি সিংহীর, ভারতে কাজ করার জন্য, বিশেষভাবে মহিলাদের জন্যে” – স্বামী বিবেকানন্দ
“ভারত এখনই মহান নারীর জন্ম দিতে পারবে না, তাকে বিদেশের থেকে সাহায্য নিতে হবে। তোমার বিদ্যা, বুদ্ধি, সততা, পবিত্রতা, ভালবাসা ও স্নেহে পরিপূর্ণ, দৃঢ়তাতে ভরপুর এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল তোমার এই কেল্টিক রক্ত যা তোমাকে সেই নারী বৈশিষ্ট্য দেয় যার প্রয়োজন ছিল” – স্বামী বিবেকানন্দ
মার্গারেট শেষ পর্যন্ত নিজেকে স্বামী বিবেকানন্দের চরণে সমর্পিত করার পণ করে ১৮৯৭ সালে ভারত এলেন। উনি ১৮৯৮-এর ২৫শে মার্চ ব্রহ্মচর্য বরণ করলেন এবং নতুন নাম ‘নিবেদিতা’ হিসেবে পরিচিত হলেন।
ওঁকে স্বামীজির শুধু আরও একজন শিষ্যা বাড়ানোর জন্য বেছে নেননি, তাঁকে সম্পূর্ণ রূপে ভারতের পরম্পরা ও ঐতিহ্যের মধ্যে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতা বেদান্ত দর্শনকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন, এবং বেদান্তকেই ব্যবহারিক আধ্যাত্মিকতার মূল করে ভারতীয় সমাজের সকল ক্ষেত্রে সেবার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮-এর মে থেকে অক্টোবর আলমোড়া ও কাশ্মীর প্রবাসে যান, ভগিনী নিবেদিতাও ওঁর সঙ্গে যান।
ভগিনী নিবেদিতার জন্যে এ যেন এক সারা জীবনকালের অভিজ্ঞতা, ভারতের বিশালতা ও তার ওপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজত্বের প্রকোপ।
ভগিনী নিবেদিতা বুঝেছিলেন যে ভারতীয়রা কখনই এক আদর্শ মানুষ হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না, যতদিন না ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শেষ হয়।
ভগিনী নিবেদিতা মেয়েদের জন্যে একটা বিদ্যালয় শুরু করেন কোলকাতার বাগবাজারে। যার উদ্বোধন করেন শ্রীমা সারদাদেবী ১৮৯৮-এর ১৩ নভেম্বর।
১৮৯৯-এর মার্চে কোলকাতায় ভগিনী নিবেদিতা যুবকদের সংগঠিত করে একটা স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করেছিলেন এবং তাদের সঙ্গে সেবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
নিজের বিদ্যালয়ের জন্যে টাকা যোগাতে নিবেদিতা ১৮৯৯-এর মাঝামাঝি একটা লেকচারে অংশগ্রহণ করতে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যান । বোস্টনে থাকার সময়, তাঁর সঙ্গে বিখ্যাত দেশপ্রেমী বিপিন চন্দ্র পালের পরিচয় হয়।
ভগিনী নিবেদিতা বেশ গভীরভাবে ব্রিটিশ শাসকদের ও খ্রিস্টান মিশনারিদের ক্ষোভের সম্মুখীন হন।
১৯০২-এর ২০ অক্টোবর বরোদাতে তাঁর দেখা হয় ঋষি শ্রী অরবিন্দর সঙ্গে, যিনি তখন বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মস্তিষ্ক। নিবেদিতা হাজার হাজার তরুণ ছেলে মেয়েকে আকর্ষিত করেন তাঁর গুজরাত ভ্রমণে।
ব্রিটিশ সরকারের বাংলা বিভাজনের নির্ণয়ের বিরোধিতার আন্দোলনে বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী আনন্দ মোহন বোসের প্রস্তাবের পক্ষে ১৯০৫ সনে এক জনসভায় তীব্র বক্তৃতা দেন।
ভগিনী নিবেদিতা একজন প্রশান্ত লেখক ছিলেন এবং তাঁর লেখা প্রবুদ্ধ ভারত, সন্ধ্যা, ডন এবং নিউ ইন্ডিয়াতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো।
সংগ্রামী খবরের কাগজ “যুগান্তর”, যেটা ঋষি অরবিন্দ, তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত শুরু করেছিলেন, সেটার পরিকল্পনা ১২ মার্চ ১৯০৬ নিবেদিতার বাড়িতেই করা হয়েছিল।
নিবেদিতা শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। উনি ১৯০৭-এ ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন, এবং সেখানে ব্রিটিশ সাংসদদের সঙ্গে হওয়া সকল বৈঠক ও সাক্ষাৎকারের খবর কাগজে প্রকাশ করেন।
নিবেদিতা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্য করতেন। ভূপেন্দ্র নাথ দত্ত ও তারক দত্ত নির্বাসিত ছিলেন, তাঁদের সংগ্রামী পত্রিকার বাধাহীন নিয়মিত প্রকাশর জন্যে যথেষ্ট অর্থেরও জোগাতেন তিনি।
স্বামীজির কঠোর প্রচেষ্টায় নিবেদিতা উৎসাহী নারী থেকে স্বদেশপ্রেমী নারীতে পরিণত হন। তিনি নিজের পরিচয় ভারতীয়তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন।
ভগিনী নিবেদিতা নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা খুব সুন্দর ভাবে তাঁর বিভিন্ন লেখায় প্রকাশ করেছেন। যেমন ‘মাস্টার অ্যাজ আই স হিম’, ‘কালি দ্য মাদার’, ‘দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’, ‘ক্রেডল টেলস অফ হিন্দুইজম্’, ‘ফুটফলস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি’, ‘সিভিক আইডিয়াল অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিটি’, ‘হিন্টস অফ ন্যাশনাল এডুকেশন অফ ইন্ডিয়া’ প্রভৃতিতে ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর তাঁর জ্ঞানের ও দর্শনের স্পর্শ পাওয়া যায়।
ভগিনী নিবেদিতা বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন এক অসাধারণ নারী ছিলেন। উনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে খুব গভীরভাবেই জড়িত ছিলেন।
ভগিনী নিবেদিতা যখন জানতে পারলেন দামোদর চাপেকর ও তাঁর ভাইদের বলিদানের কথা, উনি ঠিক করলেন সেই বীরদের মায়ের সঙ্গে দেখা করবেন ও তাঁকে শ্রদ্ধা অর্পণ করবেন। তিনি যখন চাপেকরদের বাড়িতে গেলেন, দেখলেন তাঁদের মা সব রকম দুঃখ বা অনুশোচনার অনেক ঊর্ধ্বে।
ভগিনী নিবেদিতা বুঝলেন যে ভারতের আত্মসন্মানবোধ অনেক বেশি এবং তা যেই আত্মোপলব্ধির দিকে এগিয়ে চলেছে তা তাঁর কল্পনাতীত।
১৯০৯ সনে ভগিনী নিবেদিতা যখন ভারতে ফিরলেন, উনি দেখলেন বেশিরভাগ সংগ্রামী কারাগারে রয়েছেন। ঋষি অরবিন্দের ওপরে ব্রিটিশের নজর ছিল তাই উনি নির্বাসনে ছিলেন। তখন দুটি প্রমুখ সংগ্রামী খবরের কাগজ চালানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিবেদিতার ওপরেই এসেছিল, ‘ধর্ম’ ও ‘কর্মযোগিন’।
নিবেদিতা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ভারতের জন্যে ও দীর্ঘদিন মানসিক চাপের মধ্যে থাকার ফলে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। যখন উনি বুঝলেন যে তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না, তখন তিনি মিসেস বুল-এর থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থ দান করে দিলেন।
১৯১১-এর ১৩ই অক্টোবর ভগিনী নিবেদিতা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। ভারত মায়ের নিবেদিত কন্যা চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।
দার্জিলিং এ নিবেদিতার স্মৃতিলিপিতে তাঁর অবদানের কথা খুব পরিষ্কারভাবে ও সংক্ষেপে লেখা রয়েছে। “ইহা ভগিনী নিবেদিতার বিশ্রামস্থান, যিনি তাঁর সবটুকু ভারতের জন্যে ত্যাগ করেছেন” (Here Reposes Sister Nivedita Who Gave Her All to India)।
স্বামী বিবেকানন্দের নিকটস্থ শ্রেষ্ঠ শিষ্যাদের মধ্যে একজন।
মার্গারেট ই নোবেল, আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন, স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন ও ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত হন যার অর্থ হল নিবেদিত।
স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে ১৮৯৫ সনে লন্ডনে ভগিনী নিবেদিতার পরিচয় হয় এবং উনি ১৮৯৮ সনে কোলকাতায় আসেন।
বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে ২৫ মার্চ ১৮৯৮ সনে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দেন।
স্বামীজি চেয়েছিলেন নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে ভারতের নারীর, বিশেষতঃ বাংলার নারী সমাজের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উত্থান হোক। তিনি তাঁর গুরুর ইচ্ছেপূরণ করেছিলেন।
স্থানীয় মানুষের কাছে ভগিনী নিবেদিতার পরিচয় করানোর সময় স্বামীজি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “ইংল্যান্ড আমাদের মার্গারেট ই নোবেল-এর মাধ্যমে আরেকটি উপহার পাঠিয়েছে”।
মিশনারি নিবেদিতা
নিবেদিতা কোলকাতার বাগবাজার অঞ্চলে মেয়েদের জন্য একটি বিদ্যালয় খোলেন, মেয়েদের শিক্ষিত করার এক দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। তাঁর দৃঢ়তা এতটাই যে সে নিজে বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে বলতেন।
নিবেদিতা সারদা দেবীর খুব নিকটস্থ ছিলেন। সারদা দেবী শ্রী রামকৃষ্ণের স্ত্রী ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
নিবেদিত সমাজসেবী
কোলকাতায় প্লেগের মহামারির সময় নিবেদিতার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি নিজে রুগীদের সেবা করতেন ও গরিব রুগীদের যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন এবং নিজে রাস্তাঘাট এলাকা পরিষ্কার করার কাজে নেমে পড়েছিলেন। তিনি অনেক যুব ও তরুণকে এই কাজে যুক্ত করেন।
তিনি একজন বিশিষ্ট সমাজসেবীকা, একজন শিক্ষিকা ও একজন লেখিকাও ছিলেন। আদপে তিনি তাঁর পিতার কাছে ও কলেজে শিক্ষকদের কাছে শিখেছিলেন যে মানবসেবাই হলো ঈশ্বরের প্রকৃত সেবা।
“আমি বিশ্বাস করি ভারত এক, অচ্ছেদ্য, অবিভাজ্য” – ভগিনী নিবেদিতা।
আমাদের সম্পূর্ণ অতীত বিশ্বের জীবনের এক অভিন্ন অংশ হওয়া উচিত। সেটাই হবে জাতীয়তাবোধের জাগরণ। কিন্তু সেটা সর্বত্র হওয়া উচিত – ভগিনী নিবেদিতা
আমাদের দৈনন্দিন জীবনই আমাদের ঈশ্বরের প্রতীক। দুটি মত কখনই এক ধারণায় আচ্ছাদিত হয় না – ভগিনী নিবেদিতা
ভগিনী নিবেদিতা বেদান্ত ও ভারতের দর্শনকে এমন ভাবে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেন যে বি্পিন চন্দ্র পাল বলেন, “নিবেদিতা আমাদের কাছে শিক্ষিকার রূপে নয় বরং এক শিক্ষার্থীর ন্যায় এসেছিল, এক পারদর্শী হিসেবে নয়, অনভিজ্ঞ হিসেবে এবং সে ভারতকে এতটাই ভালবেসে ফেলল যে আমরাও এতটা ভালবাসতে পারি না”।