লন্ডনবাসী রুশ ‘বান্ধবীর’ ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এ রাজ্যের এক ‘প্রভাবশালী’র কালো টাকার ‘খোঁজ মেলার’ অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে ইডি সূত্রে। সেই তদন্তে আরও এক ধাপ এগিয়ে এ বার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটির অভিযোগ, একা ওই রুশ ‘বান্ধবীর’ কাছে নয়, ‘প্রভাবশালী’র দুর্নীতির টাকা পাচার হয়েছে আরও অন্তত জনা পনেরো বিদেশিনির অ্যাকাউন্টে। যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন ফিলিপিন্সের বাসিন্দা। তদন্তকারীদের দাবি, এই একই ধাঁচে টাকা রেখেছেন রাজ্যের আর এক ‘প্রভাবশালী’ও।
ইডি সূত্রে দাবি, সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ছোট-ছোট দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশের কমবয়সি অনেক মহিলা দুবাই-সহ পশ্চিম এশিয়ায় বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। মূলত পাঁচতারা হোটেলে নাচ-গানের আসরে সেখানে আসা ধনীদের অনেকের সঙ্গে এঁদের পরিচয়। এঁদেরই অনেকে আবার এই ধনীদের কালো টাকা রাখতে ‘ভাড়া দেন’ নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। কমিশনের বিনিময়ে। অল্প সময়ে ধনীদের সঙ্গে এ জাতীয় ‘গা-ঘেঁষাঘেঁষির’ সূত্রে মোটা অর্থ কামিয়ে নেওয়ার হাতছানি থাকে বলেই ওই সমস্ত জায়গার ভিসা পেতে মরিয়া হন অনেকে।
এ ক্ষেত্রে ইডি-র অভিযোগ, যে ‘প্রভাবশালী’র রুশ বান্ধবী-যোগের কথা ইতিমধ্যেই তারা জানিয়েছে, তাঁর টাকার একটি মোটা অংশ জমা পড়েছে হংকং, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স-সহ বেশ কয়েকটি দেশের অ্যাকাউন্টে। যাঁদের অ্যাকাউন্ট, পেশাগত পরিচয়ে তাঁরা অনেকেই মডেল। বেশির ভাগেরই জন্ম ফিলিপিন্স এবং সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে তৈরি হওয়া বিভিন্ন দেশে। পেশাগত সূত্রে তাঁরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন বিভিন্ন দেশে। এ ক্ষেত্রে ওই রুশ বান্ধবীই তাঁদের সঙ্গে ‘প্রভাবশালী’র যোগসূত্র বলে তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে দাবি। ইডি-র আরও দাবি, ওই সমস্ত বিদেশিনির অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত বেশ কিছু নথি ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে তাদের। তেমন বেশ কিছু নথি জমা রেখেছিলেন ‘প্রভাবশালীর ঘনিষ্ঠ’ও।
প্রাথমিক তদন্তের সূত্রে ইডি-র অভিযোগ, দুর্নীতির কালো টাকা রাখতে ওই সমস্ত মহিলার অ্যাকাউন্ট কমিশনের ভিত্তিতে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এক তদন্তকারীর কথায়, “ধরুন, শর্ত হল, অ্যাকাউন্টে ১০০ টাকা রাখলে, মহিলা পাবেন ৫ টাকা। এবং এই চুক্তিও মৌখিক। মূলত পারস্পরিক বিশ্বাসে ভর করে চলা। হাওয়ালায় যেমনটা হয়।” কিন্তু টাকা নিয়ে যে কেউ চম্পট দেবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? ইডি সূত্রে দাবি, এ সব ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্টের পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকে যিনি টাকা রাখছেন, তাঁর হাতে। ডেবিট কার্ড, চেকবই, ব্যাঙ্কের যাবতীয় নথি তাঁর জিম্মায়। এমনকি নেট-ব্যাঙ্কিংয়েও ওই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে সব কিছু যিনি টাকা রেখেছেন, তাঁর নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু বেআইনি ভাবে এই টাকা রাখার ‘বহু পুরনো’ ব্যবসায় বিশ্বাসই যে মূল পুঁজি, তা স্পষ্ট বলছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। ইডি সূত্রে দাবি, শুধু এ রাজ্যের এক-দু’জন ‘প্রভাবশালী’ নন, এ দেশ থেকে এই পন্থায় টাকা বিদেশে পাঠানোর উদাহরণ ভূরি-ভূরি। তদন্তে যুক্ত এক আধিকারিকের অভিযোগ, ‘‘গত কয়েক বছরে ভারত থেকে মোটা টাকা নিয়ে যাঁদের বিরুদ্ধে বিদেশে পালানোর অভিযোগ উঠেছে, এই বন্দোবস্ত ব্যবহার করেছেন তাঁদের অনেকেও। বিভিন্ন সময়ে তদন্তে তা উঠেও এসেছে। এক ইডি কর্তার কথায়, “দুর্নীতির কয়েকশো কোটি টাকা তো নস্যি। বিশ্ব জুড়ে মাদক পাচারের যে চক্র চলে, যেখানে শ’য়ে শ’য়ে কোটি ডলারের কারবার হয়, সেখানেও তার একটি অংশ এ ভাবেই লেনদেন করা হয় বিভিন্ন দেশের অ্যাকাউন্ট ভাড়া নিয়ে।”
তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি, বছর দেড়েক ধরে ‘প্রভাবশালী’র বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টির উপরে নজরদারি চালানো হয়েছে। সেই সূত্রে অভিযোগ, প্রথমে রুশ ‘বান্ধবী’র অ্যাকাউন্টে ধাপে ধাপে কয়েকশো কোটি টাকা জমা হয়েছে। তার পরে সেখান থেকেও সেই টাকার অংশ ছড়িয়ে গিয়েছে পেশায় মডেল ওই বিদেশিনিদের অ্যাকাউন্টে। ইডি সূত্রে দাবি, টাকা জমা পড়ার পরে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মোট অঙ্কের ২-৩ শতাংশ টাকা ওই সব অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়েছে। তদন্তকারীদের অনুমান, যাঁর অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়েছে, প্রাথমিক কমিশন বাবদ তাঁকেই ওই ২-৩ শতাংশ টাকা দেওয়া হয়েছে।
মূলত ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুর্নীতির কয়েকশো কোটি টাকা ধাপে ধাপে এই বিদেশিনিদের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে বলে ইডি সূত্রে অভিযোগ। তাদের দাবি, প্রথমে হাওয়ালা মারফত টাকা পশ্চিম এশিয়ায় পাঠানো হয়েছে। সেখানে ভুয়ো সংস্থা খুলে, বিদেশিনিদের অ্যাকাউন্ট মারফত কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা হয়েছে। পরে আবার তার একাংশ ‘ফিরে এসে’ ঢুকেছে রাজ্যেরই কয়েকটি সংস্থায়।এই প্রসঙ্গে উঠছে ‘প্রভাবশালী’র এক ‘ঘনিষ্ঠের’ নামও। ইডি সূত্রে দাবি, এই ‘ঘনিষ্ঠের’ বাড়ি ও অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বহু নথি পেয়েছে সিবিআই ও ইডি। মূলত সেই সূত্রেই দুর্নীতির টাকা দেশে-বিদেশে বিনিয়োগের নানা সন্ধান মিলেছে। জানা গিয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ওই ‘ঘনিষ্ঠ হিসাবরক্ষক’ নিয়মিত বিদেশে যাতায়াত করেছেন। সাম্প্রতিক তদন্তে উঠে আসা বিভিন্ন নথির ভিত্তিতে শীঘ্রই তাঁকে ফের তলব করা হতে পারে বলেই ইডি সূত্রের খবর।