কবিতা আর লিখতে পারছি না, বলত ছেলে, ১৬ ফর্মার অরিত্রকে কোলে নিয়েই এ বার জন্মদিন পালন মায়ের

ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখত ছেলে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হত। কিন্তু লেখার খিদে ছিল আরও অনেক। সংসারের যা অবস্থা তাতে রোজগারও করতে হবে। বড় দোটানায় থেকে এক দিন মৃত্যুকে বেছে নেন তরুণ কবি অরিত্র সোম। ওঁর পরিচিতেরা বলেন, খারাপ থাকার আরও কিছু কারণ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মূল অবসাদ ছিল লেখা নিয়ে অতৃপ্তি। বড় শখ ছিল এক দিন একটা মোটা বই হবে ওঁর। মায়ের হাতে এনে দেবেন। সেই বই এল অরিত্রর ২৭তম জন্মদিনের আগে আগে। কিন্তু অরিত্র নেই। ছেলের ১৬ ফর্মার কবিতার বইয়ের মধ্যেই তাই সন্তানকে খুঁজছেন বেলঘরিয়ার চিত্রা সোম। সোমবার ৭ অগস্ট অরিত্রর জন্মদিন পালন হবে সেই বইকে ঘিরেই।

‘কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা।’ গেয়েছেন কবীর সুমন। কিন্তু অরিত্রের ক্ষেত্রে একেবারে তেমনটা নয়। বললেন ওঁর মা চিত্রা। ছেলের একটা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছিল আগেই। কিন্তু ইচ্ছা ছিল, অনেক বড় হওয়ার। খ্যাতি পাওয়ার। কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করা বাবা অবসর নেওয়ার পরে অরিত্রকে চাকরি করতেই হয়। আর তাতেই নাকি ও লিখতে পারছিল না। পেশা আর নেশার দ্বন্দ্ব নিয়ে লড়াইটা টেনে যেতে পারেনি।

শনিবার বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে মা চিত্রা সোম।

অরিত্রর মৃত্যুর পরে ওঁর বন্ধুরা দেখেন, অনেক অনেক লেখা অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে। সেই সব কবিতা দিয়েই ১৬ ফর্মার ‘অরিত্র সোমের কবিতা’ নামে বই প্রকাশিত হয়েছে। শনিবার প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল কলেজ স্ট্রিটের একটি ক্যাফেতে। অরিত্রর বন্ধুরা তো বটেই, এসেছিলেন ওঁর কবিতায় মুগ্ধরাও। এসেছিলেন অরিত্রর শিক্ষকরা। ভিড় দেখে চমকে ওঠেন ‘কবির মা’ চিত্রা। সবার কথা যত না শুনেছেন তার চেয়ে বেশি কেঁদেছেন। কেঁদেই গেছেন। ছেলের ছবিতে হাত বুলিয়ে আদর করেছেন। সেই সব কথা বলতে গিয়েও কান্না থামছে না। বললেন, ‘‘আমি জানতাম না ওঁর এত গুণ। ওঁকে সবাই এত ভালবাসে। ছেলেটা খালি বলত, মাগো আমি আর কবিতা লিখতে পারছি না। তবে তার জন্য নিজেকে শেষ করে ফেলবে বুঝতে পারিনি।’’ চিত্রা জানতেও পারেননি ছেলে লিখেছে, ‘‘আমি আমার জন্ম দেখতে চাই / আমি আমার মৃত্যু দেখব না বলে।’’

অরিত্রর বন্ধু তথা বইটির প্রকাশে বড় ভূমিকা নেওয়া আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ও যে এত কবিতা লিখেছে আমরাও জানতাম না। এখনও অনেক কবিতাই অগ্রন্থিত রয়ে গিয়েছে। ও কবিতা লেখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে চাইত।’’ এমনিতে চুপচাপ থাকলেও অরিত্র সমস্যার কথা বলতেন বন্ধুদের। মা, বাবার সঙ্গে থাকা এক কামরার ফ্ল্যাটে নিজের জন্য, কবিতার জন্য জায়গা মিলত না বলেও আক্ষেপ করতেন। তবে তার জন্য আচমকা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত অবশ্য মানতে পারেন না অরিত্রর বন্ধুরা। সদ্য প্রকাশিত বইটির সম্পাদনা করা বন্ধু তন্ময় ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘ও তো চলে গিয়েছে। ধরে রাখা যায়নি। তার পরেও ওকে ধরে রাখার কঠিন কাজটা আমরা করলাম। ওঁর মায়ের হাতে ছেলেকে তুলে দেওয়া তো সম্ভব নয়, ছেলের সৃষ্টির সংকলন রইল।’’ ছোটখাট চেহারার শান্ত অরিত্রকে বন্ধুরা ‘বাচ্চা’ বলে ডাকতেন। আকাশের আক্ষেপ, ‘‘খুব বড় হওয়ার ইচ্ছা ছিল বাচ্চার। কিন্তু বাচ্চার বড় বই যে দিন প্রকাশিত হল, তার আগেই বাচ্চা নিরুদ্দেশের দেশে।’’

গত পয়লা বৈশাখের দিন বাড়িতেই খুব কষ্টের মৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন অরিত্র। রথতলার এই ফ্ল্যাটটায় আর থাকতে চান না চিত্রাদেবী। রবিবার বললেন, ‘‘ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেব। এই ঘর, এই খাট সব জুড়ে রয়ে গিয়েছে ও।’’ ঘরে অরিত্রর ছবির পাশেই রেখে দিয়েছেন কবিতার বইটা। কথা বলার মাঝে মাঝেই বইটাকে আদর করলেন। বললেন, ‘‘প্রকাশনা সংস্থা কিছুটা টাকা দিয়েছে প্রথমেই। কাল (সোমবার) ওর জন্মদিন। ঠিক করেছি, দক্ষিণেশ্বরে একটা অনাথ আশ্রমে যাব। ছেলেকে হারানোর কষ্ট ভুলতে অনেক ছেলেকে খাওয়াব। ভুলতে পারব না জানি। যেমন ভুলতে পারব না আমার ছেলের সৃষ্টিকে দুই মলাটে সাজিয়ে দেওয়া ছেলেগুলোকেও।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.