লোকসভা নির্বাচনের আগে সংগঠনকে নতুন করে সাজাতে চাইছে রাজ্য বিজেপি। তারই অঙ্গ হিসাবে সাংগঠনিক মানচিত্রেও বেশ কিছু বদল আনতে চায় গেরুয়া শিবির। ইতিমধ্যেই জেলা পুনর্বিন্যাসের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন রাজ্য নেতৃত্ব। খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন জেলার নতুন এলাকা ঘোষণা হতে পারে। এর ফলে কিছু জেলা সভাপতির এক্তিয়ারে থাকা এলাকা যেমন বাড়বে, তেমন অনেকের ক্ষেত্রে কমবেও।
২০১৯ সালে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ২ থেকে বেড়ে ১৮ হয়েছিল। এ বার কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দেওয়া লক্ষ্য ৩৬। তার কাছাকাছি পৌঁছতে রাজ্য বিজেপি বাংলায় সাংগঠনিক জেলা এবং তার সঙ্গে মণ্ডলের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে চায়। বিজেপি বরাবরই ছোট ছোট সাংগঠনিক এলাকার পক্ষপাতি। সেই কারণে প্রশাসনিক জেলার উপরে নির্ভর না করে প্রতিটি লোকসভা এলাকা অনুযায়ী সাংগঠনিক জেলা বানায়। যেমন, বাঁকুড়া জেলার মধ্যেই আলাদা বিষ্ণুপুর জেলা রয়েছে। হুগলি ছাড়াও ওই জেলারই শ্রীরামপুর ও আরামবাগ আলাদা আলাদা সাংগঠনিক জেলা। এখন সর্বত্রই সেই ‘ফর্মুলা’ কাজে লাগাতে চায় বিজেপি। এর ফলে বর্তমানের তুলনায় একটি জেলা বাড়তে পারে। এখন মুর্শিদাবাদ উত্তর ও দক্ষিণ নামে দু’টি জেলা রয়েছে। বিজেপি সূত্রে খবর, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গিপুরকে আলাদা তিনটি জেলা হবে। তবে তাতে রাজ্য ৪২টি লোকসভা আসন হলেও বিজেপির জেলা হবে ৪৩। কারণ, দার্জিলিং লোকসভা এলাকার জন্য বিজেপি পাহাড় ও সমতলকে আলাদা সাংগঠনিক জেলা হিসাবে দেখে। দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি জেলা বলা হয়। সেটা একই থাকতে পারে।
বাংলার যে প্রশাসনিক জেলা ভাগ তাতে উত্তরে কোচবিহার জেলায় ন’টি বিধানসভা এলাকা। এর মধ্যে সাতটি কোচবিহার লোকসভা আসনের অন্তর্গত। জেলারই তুফানগঞ্জ বিধানসভা আলিপুরদুয়ার লোকসভার মধ্যে এবং মেখলিগঞ্জ জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে পড়ে। এমনটা অন্য লোকসভা এলাকাতেও রয়েছে। বিজেপি অতীতেও লোকসভা এলাকা অনুযায়ী সাংগঠনিক জেলা গঠনের উদ্যোগ নিলেও সর্বত্র সেটা হয়নি। এ বার সর্বত্র লোকসভা আসনের অন্তর্গত সব বিধানসভাকে একটি জেলার মধ্যে রাখার পরিকল্পনা গেরুয়া শিবিরের।
দুই দিনাজপুরের মধ্যেও এমন কিছু এলাকা রয়েছে। প্রশাসনিক উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া আদতে দার্জিলিং লোকসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। এখন প্রশাসনিক ভাগেই রয়েছে বিজেপির দিনাজপুরের জেলা সংগঠন। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর আলাদা দু’টি জেলা। উত্তরের লোকসভা এলাকা রায়গঞ্জ আর দক্ষিণের বালুরঘাট। কিন্তু বালুরঘাট লোকসভা এলাকার মধ্যেই রয়েছে উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার। মালদহ দক্ষিণের দু’টি বিধানসভা এলাকা ফরাক্কা এবং শমসেরগঞ্জ আবার মুর্শিদাবাদ দক্ষিণের মধ্যে রয়েছে। বিজেপি সূত্রে যা খবর পাওয়া গিয়েছে, আগামী লোকসভা নির্বাচনে আগে এখনই বিজেপি এই ধরনের ভাগগুলি মিটিয়ে ফেলবে। যাতে একটি লোকসভা এলাকার জন্য এক জন জেলা সভাপতিকেই দায়িত্ব দেওয়া যায়।
সংগঠন যে ভাবে রাজ্যে বেড়েছে, সেই ভাবে জেলা ভাগেও পরিবর্তন এনেছে রাজ্য বিজেপি। উত্তরের পাশাপাশি দক্ষিণবঙ্গেও বিজেপির সাংগঠনিক জেলার ভাগ বদলাবে। এখনকার উত্তর ও দক্ষিণ নদিয়া জেলা হয়ে যাবে রানাঘাট ও কৃষ্ণনগর লোকসভা অনুযায়ী। আগে বিজেপির বারাসত জেলার মধ্যেই ছিল বনগাঁ। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বনগাঁকে আলাদা জেলা করা হয়। এখন আবার কলকাতা উত্তর শহরতলি নামে বিজেপির যে জেলা রয়েছে সেটি শুধুই দমদম লোকসভা নিয়ে গঠিত হবে। এই জেলাতেই থাকা রাজারহাট ও নিউটাউন এলাকা যাবে বারাসতের মধ্যে। হাওড়া, হুগলির ক্ষেত্রে বিজেপি আগেই ভাগ করেছে। হাওড়া লোকসভার গোটা এলাকাই হাওড়া শহর জেলার মধ্যে পড়ে। আর উলুবেড়িয়াকে নিয়ে হাওড়া গ্রামীণ জেলা। হাওড়ার জগৎবল্লভপুর আবার শ্রীরামপুর সাংগঠনিক জেলার মধ্যে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বরাবরই বিজেপির সংগঠন দুর্বল। দীর্ঘ দিন পূর্ব ও পশ্চিম নামে দু’টিই ভাগ ছিল। পরে ডায়মন্ড হারবার, জয়নগর, মথুরাপুর আলাদা জেলা হয়। তবে যাদবপুর আলাদা জেলা ছিল না। এই লোকসভা এলাকার পাঁচটি বিধানসভা ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা (পূর্ব) জেলার মধ্যে। যাদবপুর ও টালিগঞ্জ ছিল কলকাতা দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলায়। এ বার এই দু’টি বিধানসভা এলাকা নিয়ে যাদবপুর লোকসভা এলাকার জন্য আলাদা জেলা হবে।
বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, স্বাধীনতা দিবসের আগেই জেলা পুনর্বিন্যাসের পরিকল্পনা বাস্তাবায়িত হয়ে যেতে পারে। কারণ, এর পরেই রাজ্যে এক গুচ্ছ কর্মসূচি রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। কেন্দ্রীয় নির্দেশেও পুজোর আগে পর্যন্ত কিছু কর্মসূচি শেষ করতে হবে।
বিজেপি সাংগঠনিক ভাবে এক একটি বিধানসভা এলাকাকে বুথসংখ্যা অনুযায়ী তিন বা চারটি মণ্ডলে ভাগ করে। ২৯৪ আসন মিলিয়ে এখন মোট মণ্ডলের সংখ্যা ১,২৬৩টি। যে সব জায়গায় বিজেপির সংগঠন শক্তিশালী, সেখানে মণ্ডলের সংখ্যাও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্য নেতৃত্বের। আবার কোনও কোনও মণ্ডলের এলাকার পুনর্বিন্যাসও হতে পারে। মণ্ডলের সংখ্যা বাড়লে অনেক নেতাকে যেমন পদ দেওয়া যাবে, তেমনই লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সুবিধা মিলবে বলে মনে করছেন রাজ্য নেতারা। কেমন হবে জেলা ভাগ, তা সাধারণত দেখে থাকেন রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন)। ওই পদে এখন অমিতাভ চক্রবর্তীর সঙ্গে যুগ্ম দায়িত্বে রয়েছেন সতীশ ধন্দ। ইতিমধ্যেই তাঁরা সংগঠনের নতুন মানচিত্র তৈরি করে ফেলেছেন এবং তাতে কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডের সহমতও মিলেছে বলে জানা গিয়েছে। ঘোষণা হয়ে গেলেই কোথায় কারা দায়িত্ব পাবেন তা ঘোষণা করে দিতে পারেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।