রহস্য, মিথ আর প্রাচীন ইতিহাসের গর্ভ থেকে বয়ে আসে নীলনদ। পশ্চিম থেকে আসা অতিথি মেঘের গায়ে লেগে থাকে সাহারা মরুভূমির বালিঝড়ের গন্ধ। মাস্তাবার পাথর সরিয়ে যুগান্তরের সীমানা দিয়ে হেঁটে আসেন খুফু, তুতানখামেন, দ্বিতীয় রামেসিস। চাঁদের আলোয় হঠাৎ জ্বলে ওঠে শতাব্দীপ্রাচীন ধুলো-হাওয়ায় ক্ষয়ে যাওয়া স্ফিংসের চোখ। স্বপ্নের ভিতর গড়ে ওঠে দেশ। মিশর। এবার সেই মিশরের একখণ্ড উঠে এলো কলকাতায়। নেপথ্যে এক মিশর-পাগল বাঙালি। রৌণক দত্ত (Raunak Dutta)। দক্ষিণ কলকাতার কসবার বোসপুকুরের তালবাগানে খুলে ফেলেছেন মিশরের বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকান। নাম আই অফ হোরাস (Eye of Horus)। দোকানটি বড়ো রাস্তার উপরেই। ফিস্ট রেস্তোরাঁর পাশে এবং এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের বিপরীতে। দোকান খোলা থাকে বেলা ১২টা থেকে রাত ৯টা (রোববার বন্ধ)।
দোকানের কর্ণধার রৌণক দত্ত বঙ্গদর্শন.কম-কে জানালেন, “সারা ভারতে মিশরের খাঁটি জিনিসপত্রের প্রথম দোকান এটাই। এ বিষয়ে আমি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বীকৃতিও পেয়েছি।” এরকম অভিনব বিষয়ে ব্যবসা করার ভাবনা কীভাবে মনে এল? উত্তরে তিনি বলেন, “আমি এই দোকান শুরু করি ২০১৭ সাল থেকে। তার আগে একটি বেসরকারি সংস্থায় ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে চাকরি করতাম। কিন্তু কাজে তৃপ্তি পাচ্ছিলাম না। তখনই ভাবি নতুন কিছু করতে হবে, নিজের পছন্দের কাজ করতে হবে। সেখান থেকেই এই ভাবনা।” তাঁর কথায় জানা গেল, নতুন কাজে পরিবার বাধা তো দেয়ই নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছিল উৎসাহ আর ভরসার হাত। কিন্তু মিশর সম্পর্কে এতটা আগ্রহ জন্মালো কীভাবে? রৌণক বললেন, “ছোটোবেলা থেকেই আমার পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের একটা বিষয়ই ভালো লাগতো। সেটা মিশর। সবসময়েই মনে হতো মিশরের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির কোথাও মিল আছে। প্রাচীন মিশর আমাকে টানতো। স্কুলে পড়ার সময় বাবা-মায়ের সঙ্গে ‘দ্য মমি’ (The Mummy) সিনেমাটি দেখতে গিয়েছিলাম। স্কুলে পড়াকালীন একবার মিশরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। তখনই ঠিক করে ফেলেছিলাম, জীবনে কখনও মিশর নিয়ে কিছু কাজ করবোই। সেসবেরই প্রতিফলন এই দোকান।” বড়ো হওয়া এবং চর্চা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই বিশ্বাস আর বোধ আরও দৃঢ় হয়েছে যে মিশর আর আমাদের হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র আছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে জানালেন, ওসাইরিস-হোরাস এবং বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি বেশ কিছু ক্ষেত্রে একধরনের। হোরাস প্রাচীন মিশরের শক্তি ও সুরক্ষার প্রতীক। এটা তাঁর দোকানের নাম বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি এ-ও জানান, “হোরাসের চোখের প্রতীকটি আমরা আরও বহু জায়গায় দেখতে পাই। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনে যে ‘Rx’ শব্দটি লেখা থাকে, তা এসেছে হোরাসের কাহিনি থেকেই। পুরোনো এক ডলারের নোটে আমরা পিরামিডের উপর একটা চোখের ছবি দেখতে পেতাম। সেটা হোরাসের চোখের প্রতীক।”
রৌণকবাবুর দোকানে পাওয়া যায় মিশরের বিভিন্ন জিনিস। দাম ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত। মিশরীয় সুতির জামা, উটের চামড়ার বেল্ট, মিশরীয় ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট, মিশরীয় আসবাবপত্র, বিভিন্ন মূর্তি, ল্যাপিস লাজুলি পাথরের কিছু জিনিস, বাদ নেই কিছুই। সঙ্গে আছে টার্কিশ ল্যাম্পশেড (Turkish Lampshade)। তিনি বললেন, “মিশরীয় জিনিসের সঙ্গে এই ল্যাম্পশেড বেশ খাপ খায়। প্যাপিরাস পেইন্টিং আছে তাঁর কাছে। মূর্তিগুলি মিউজিয়ামের মূর্তির রেপ্লিকা। তৈরি হয়েছে ব্যাসল্ট, অ্যালাবাস্টার আর স্যান্ডস্টোন দিয়ে। আসবাবের মধ্যে আছে ড্রেসিং টেবিল, চেস্টার ড্রয়ার, টি-টেবিল ইত্যাদি। এছাড়া মিশরের সুগন্ধী আতরও রাখেন তিনি। রৌণক দত্তের কথায়, “মিশরের পিরামিড আর মমি ছাড়া আর সবই আছে এখানে। মানুষ এই দোকানে এলে মিশরের আঘ্রাণ পাবে।” তাঁর দোকানের প্রতিটি জিনিসই খাঁটি, কারণ তিনি সব জিনিসই আনান মিশর থেকে। তিনি বহুবার মিশরে গেছেন, এখনও নিয়মিত যান। মিশরের মানুষরা তাঁর এই উদ্যোগে সাহায্য করেন সবসময়। রৌনক বলেন, “ভারত সম্পর্কে মিশরীয়দের আগ্রহ, ভালোবাসা অফুরন্ত। বলিউড, বিশেষত শাহরুখ-অমিতাভকে নিয়ে মেতে থাকেন সবাই। সেই দেশের একজন তাঁদের দেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে নিজের দেশে, নিজের শহরে, এটা তাদের কাছে দারুণ উৎসাহব্যাঞ্জক ঘটনা।” তিনি আরও জানান, “আমি মিশরীয় পুরাতাত্ত্বিক জিনিস (Egyptian Antique Items) রাখি না, কারণ সেগুলি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ, যাদের ক্রয়-বিক্রয় আইনত নিষিদ্ধ।”
ক্রেতাদের সাড়া কেমন? প্রশ্ন করায় তাঁর উত্তর, “দোকান খোলার পরে ক্রেতাদের অভাবনীয় সাড়া পেয়েছিলাম। মাঝে কোভিডের সময় খানিকটা খারাপ সময় গিয়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। এখন আবার সব আগের মতোই ঠিকঠাক।” তাঁর দোকানে আসেন বিভিন্ন ধরনের ক্রেতারা। ঘর সাজাবার জন্য শৌখিন জিনিস কেনেন অনেকে। আধ্যাত্মিক চর্চা করেন, এমন মানুষেরাও তাঁর খদ্দের। মিশর-উৎসাহীরা (Egypt Enthusiasts) ভিড় করেন দোকানে। এছাড়া সাধারণ ক্রেতারাও আছেন। দোকান থেকে জিনিস যায় ভিনরাজ্যেও। গত দুবছর ধরে ভিনদেশেও জিনিস পাঠাচ্ছেন রৌণক। দোকানের সাজসজ্জাও করেছেন মিশরীয় দ্রব্য দিয়েই। দোকানে মিশর সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর বই আছে। রৌণক বললেন, “এর মধ্যে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই আছে, যা এখন আর ছাপা হয় না।” পাঠক-পাঠিকারা দোকানে বসে পড়তে পারেন সেগুলি। কিছু বই জেরক্সও করা যায়। তবে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় না। তিনি ব্যবসা শুরু করার আগে বাজার নিরীক্ষণ করার জন্য মিশরের স্টল দিয়েছিলেন ভারতের আন্তর্জাতিক মেগা ট্রেড মেলা-র (India International Mega Trade Fare) আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়ানে। এখনও সেখানে স্টল দেন নিয়মিত।
তবে শুধু মিশরই নয়, রৌণকের চর্চা এবং উৎসাহ বহুধাবিস্তৃত। তিনি একজন নামকরা ডাকটিকিট সংগ্রাহক। পাঁচ বছর বয়স থেকেই তাঁর ডাকটিকিট জমানোর (Philately) নেশা। সে অভ্যাস রয়ে গেছে এখনও। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন ফিলাটেলিক এক্সিবিশনে পুরস্কার জিতেছেন। ভারতীয় ডাকবিভাগের সহযোগিতায় বিভিন্ন জায়গাতে এই বিষয়ের উপর ওয়ার্কশপ করান রৌণক দত্ত। জেলাস্তরের বিভিন্ন এক্সিবিশনে বিচারক হয়ে যান। তিনি দশাবতার তাস সংগ্রাহকও। তাঁর কথায়, “এই ধরনের তাস ভারতের অতি পুরোনো ঐতিহ্য। দেশের চার জায়গায় এই কার্ড তৈরি হতো। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, মাইসোর (তাঞ্জাভুর চিত্রকলা ঘরানা), ওড়িশার রঘুরাজপুর, মহারাষ্ট্রের সাভান্তওয়ারি। এই কার্ডগুলিকে গঞ্জিফা কার্ড (Ganjifa Card) বলে। মাইসোরের কার্ডগুলি তৈরি করতেন রঘুপতি ভট্ট নামের একজন শিল্পী। তিনি মারা যাওয়ার পর মাইসোরের ঘরানাটি আপাতত লোপ পেয়েছে। বাকি তিনটি কোনওক্রমে টিকে আছে।” রৌণকবাবু এই কার্ডের পুনরুজ্জীবন নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার সদস্য। তাঁর কথায়, “এই কার্ডগুলির কথা বেশিরভাগ মানুষই জানেন না। নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও এই শিল্পে উৎসাহী নন। আমরা চেষ্টা করছি এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার।”
ফিরে আসা যাক রৌণকের দোকানে। তাঁর নতুন পরিকল্পনা দোকানের সংলগ্ন মিশরীয় খাবারের ক্যাফে খোলার। “মানুষ এখানে এলে যাতে খুঁজে পায় একটুকরো মিশর, সেটাই আমার উদ্দেশ্য।” ‘এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা।’ খুঁজলে পাওয়া যায় অসংখ্য মণিমাণিক্য। সেই সম্ভারে আরেকটি সংযোজন ভারতের প্রথম মিশরীয় জিনিসের দোকান Eye Of Horus।