জঙ্গল। অরণ্য। আর অরণ্যের অধিকার। অরণ্যের অধিকার আর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ নিয়ে বিতর্ক বহুযুগের। সেই সংক্রান্ত লড়াইও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠীরা কখনোই অরণ্যে বসবাসকারীদের মূলধারার বলে স্বীকার করেননি। চিরকালই তাঁদের প্রান্তিক করেই রাখা হয়েছে। স্বাধীনতার আগে তো বটেই, তারপরেও প্রশাসনের তরফেও তাদের প্রতি রয়ে গিয়েছে গাফিলতি আর অবহেলা। কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি নেওয়া হলেও বৃহৎ অর্থে তাঁরা আজও বঞ্চিতই। “I walk to the depths of the deepest black forest/where the people are many and their hands are all empty”। তবুও তস্য গরিব, পেটভরে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর একমাত্র আশ্রয় অরণ্য। সব বঞ্চনা, হতাশা আর বংশপরম্পরায় কিছুই না পাওয়ার ক্লেদ যেখানে সর্বগ্রাসী শ্মশানের মতো ঘিরে ধরে, সেখানে সেই ভারমুক্তির একমাত্র স্থান বোধহয় কোনও গাছের ছায়া বা বুনো ফুলের গন্ধ। তাদের জীবিকা আর আহার, সেও তো অরণ্যকে জুড়েই। কিন্তু যতবারই আধুনিক সভ্যতা তার রংচঙে মোড়ক নিয়ে ঢুকে পড়ে সেখানে, জঙ্গল ফিকে হয়ে আসে, মৃত গাছের ‘শহর’ জুড়ে আঁধার নেমে আসে আরও। আবার হয়তো তেমন আঁধার নেমে আসতে পারে অরণ্য আর অরণ্যচারীদের জীবনে। ‘সৌজন্যে’ কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিতর্কিত বনসংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল। যা সম্প্রতি পাশ হয়ে গেলো লোকসভার বাদল অধিবেশন-এ। আর পাশ হয়ে গেলো কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই। সেই বিল আইনে রূপান্তরিত হলে প্রভূত ক্ষতি হবে ভারতের অরণ্যগুলির এবং অরণ্যবাসী আদিবাসীদের, আশঙ্কা করছেন বিরোধীপক্ষ এবং বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কী বলা আছে নতুন বিলে? ভারতের সীমান্ত থেকে ভারতের অভ্যন্তরের ১০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত জঙ্গলগুলিতে চালানো যাবে জরিপের কাজ। চালানো যাবে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, যেমন রাস্তা আর ব্রিজ তৈরির কাজ। এছাড়া দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে করা যাবে জঙ্গল অধিগ্রহণ। করা যাবে ইকো-ট্যুরিজমের প্রকল্প, জঙ্গল সাফারি, কোনও খনিজের জন্য চালানো যাবে খননের কাজ। আগে এইসব কাজ করার জন্য নিতে হত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি। অধিবাসীদের দিতে হত পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ। নতুন বিলে সেই সংক্রান্ত নিয়মাবলী শিথিল করা হয়েছে।
১৮৭১ সালে ইংরেজ সরকার অরণ্যের ভূমিপুত্রদের জঙ্গলে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ঘোষণা করে জমিগুলি ইজারাদার আর জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়ার। বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে শুরু হয় উলগুলান। কয়েকবছর তীর-ধনুক নিয়ে ইংরেজ শাসকের বন্দুকধারীদের সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করার পর ফাঁসি হয় কিংবদন্তি নেতার। কিন্তু ইংরেজ সরকার ভূমিপুত্রদের কিছু অধিকার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। মাঝে আবার দীর্ঘ বঞ্চনাকালের পর ২০০৫ সাল। আদিবাসীদের জঙ্গলে বসবাস করার এবং চাষবাস করার জন্য তৈরি হয় অরণ্যের অধিকার আইন। ইউপিএ-১ সরকারের অধীনে। সেই আইনেও কিছু বিতর্কিত বিষয় ছিল, তবে অরণ্যের উপর আদিবাসীদের অধিকার কিছুটা হলেও সুরক্ষিত হয়েছিল। তবে বন্ধ হয়নি নির্বিচারে জঙ্গল ধ্বংসের অভ্যাস। সেই বিতর্কের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে বনসংরক্ষণ সংশোধনী বিল ২০২৩ (Forest Conservation Amendment Bill 2023)। যা ১৯৮০ সালের বনসংরক্ষণ আইন (Forest Conservation Act 1980)-এর সংশোধনী।
কী বলা আছে নতুন বিলে? ভারতের সীমান্ত থেকে ভারতের অভ্যন্তরের ১০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত জঙ্গলগুলিতে চালানো যাবে জরিপের কাজ। চালানো যাবে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, যেমন রাস্তা আর ব্রিজ তৈরির কাজ। এছাড়া দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে করা যাবে জঙ্গল অধিগ্রহণ। করা যাবে ইকো-ট্যুরিজমের প্রকল্প, জঙ্গল সাফারি, কোনও খনিজের জন্য চালানো যাবে খননের কাজ। আগে এইসব কাজ করার জন্য নিতে হত কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি। অধিবাসীদের দিতে হত পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ। নতুন বিলে সেই সংক্রান্ত নিয়মাবলী শিথিল করা হয়েছে। নতুন আইন তৈরি হলে যে সমস্ত নিয়মাবলী প্রযোজ্য হবে, রাজ্য সরকারগুলিকে সেসব পালন করার নির্দেশ দেওয়ার অধিকার থাকবে কেন্দ্রের। অপরদিকে, রাজ্য সরকার কোনও সংস্থাকে অরণ্যের কোনও অংশের জমি দিতে গেলে আগে নিতে হবে কেন্দ্রের অনুমতি। একে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আঘাত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
বন তো শুধু বনবাসীদের নয়, সেখানে থাকা অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদেরও। তাদের কল্যাণেই টিকে রয়েছে বাস্তুতন্ত্র, বজায় রয়েছে খাদ্যশৃঙ্খল। বর্তমান সময়ে যখন পরিবেশদূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ধাক্কায় পর্যদুস্ত হচ্ছে মানবসভ্যতা, তখন অনেকেই বুঝতে পারছেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা আর বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্ব। রাজ্য বনদপ্তরের এক অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং পরিবেশকর্মী জানান, “জঙ্গল হলো অক্সিজেনের ভাণ্ডার। গাছ না থাকলে সম্ভব হবে না ভূমিক্ষয় রোধ করা। গাছপালা, পশুপাখি না বাঁচলে বাঁচবে না মানুষও।” তিনি আরও বলেন, “সীমান্ত থেকে অভ্যন্তরের ১০০ কিমি পর্যন্ত এলাকার মধ্যে পড়ছে হিমালয়ের পাদদেশের প্রায় সমস্ত জঙ্গলগুলি। সেখানে বর্তমানে অনেকবারই ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। জঙ্গল কেটে বিভিন্ন প্রকল্প চললে তার মাত্রা আরও বাড়তে পারে”। নতুন প্রস্তাবিত আইনের ফাঁক গলে যদি উন্নয়নের নামে অবাধে অরণ্য ধ্বংস করার পরিমাণ বাড়ে, ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন ভূমিপুত্ররা, তা নিয়েই প্রমাদ গুনছেন ওয়াকিবহাল মহলের অনেকেই। দুই ধরনের অরণ্যকে এই বিলের বাইরে রাখা হয়েছে। ফলে সেখানে চালানো যেতে পারে যে কোনও প্রকল্প, যার জন্য নিতে হবে না কোনও অনুমতিই। ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে চিড়িয়াখানা তৈরি করা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেখানে এই বিলে কেন ন্যাশনাল পার্কে চিড়িয়াখানা তৈরি করার জন্য, কেন্দ্রের অনুমতি আদায়ের নিয়মটি শিথিল করা হল, তাও স্পষ্ট নয়। থাকছে বিরোধীদের অন্ধকারে রাখার প্রসঙ্গটিও। বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনার জন্যও পাঠানো হয়নি বিলটিকে। এই কমিটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলের সাংসদ জয়রাম রমেশ সেসময় অভিযোগ করেছিলেন, তিনি স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান বলেই ঐ কমিটিতে বিলটি পাঠানো হয়নি। তাছাড়া, দেশের বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে সরকারি সম্পত্তির বেসরকারিকরণ করার। বিরোধীদের যুক্তি, এই বিলের মাধ্যমে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে অরণ্যগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করল কেন্দ্র।
অন্যদিকে, কেন্দ্রের যুক্তি, এর ফলে বাড়বে সাস্টেনেবল উন্নয়ন। হবে প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। অরণ্য, অরণ্যের প্রাণী আর অরণ্যের ভূমিপুত্রদের উপর আঁচ পড়বে না বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা। কে ঠিক, তা সময়ই বলবে। কিন্তু অরণ্য না বাঁচলে বাঁচবে না মানবসভ্যতাও। বিশিষ্ট লেখক রাস্কিন বন্ড বলেছিলেন, “And when all the wars are over, a butterfly will still be beautiful”। এ-ও তো এক যুদ্ধই। অরণ্যের অধিকারের যুদ্ধ, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধের শেষে বেঁচে থাকবে কি জংলি প্রজাপতির দল, আর রঙিন ডানায় ভর করে সূর্যের দিকে তাদের দৃশ্য দেখার জন্য খোলা থাকবে কি আমাদের চোখ, প্রশ্ন সেটাই।