তিনি মাঝেমধ্যেই বলেন, ‘‘আমার বেডিং বাঁধা আছে। যে দিন যেখানে যেতে বলবে চলে যাব। এটা শিখেই সংগঠন করতে এসেছি।’’ দিলীপ ঘোষের মুখে এমন সংলাপ ঘনিষ্ঠেরা বার বার শুনেছেন। তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে যত বার প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর কাজকর্ম, মন্তব্য নিয়ে যত বার দিলীপকে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে, তিনি তত বারই বলেছেন, ‘‘আমি সোজা কথা সোজা করে বলতে ভালবাসি। আমার মধ্যে কোনও ন্যাকামি নেই। সেটা যাঁর পোষাবে না তাঁর বিষয়। আমার কিছু নয়। আমি সঙ্ঘের প্রচারক ছিলাম, আছি, থাকব। সংগঠন রাজনীতিতে পাঠিয়েছে, এসেছি। বললে, পুরনো কাজে ফিরে যাব।’’
শনিবার সকালে যখন তাঁকে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, তখন দিলীপ প্রকাশ্যে এমন কিছু বলেননি। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, এখনও সেই একই বক্তব্যে অটল তিনি।
কেন দিলীপকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, তা নিয়ে বিজেপির অন্দরে জল্পনা আছে বৈকি। তার মধ্যে সবচেয়ে জোরালো হল— সুকান্ত মজুমদার এবং শুভেন্দু অধিকারীকে ‘স্বস্তি’ দিতেই দিলীপকে সংগঠনের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজ্য বিজেপির একাংশের বক্তব্য, সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি হওয়ার সুবাদে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে নাকি দিলীপ বার বারই বলেছেন, রাজ্যে সে ভাবে কোনও কোনও আন্দোলন দলীয় স্তরে দানা বাঁধছে না। সংগঠন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এক কথায়— রাজ্যে ‘যোগ্য’ নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। যদিও এ সবই ‘অসমর্থিত’ সূত্রের দাবি। এমনিতে দিলীপের সঙ্গে দলের ভিতরে অনেকের লড়াই থাকলেও তবে বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্তের সঙ্গে তাঁর কোনও মতবিরোধ নেই বলেই অনেকের বক্তব্য। যদিও দিলীপ এক বার মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘সুকান্তের অভিজ্ঞতা কম!’’
সুকান্ত-ঘনিষ্ঠদের দাবি, রাজ্যে দিলীপের জনপ্রিয়তা যে আছে, তা রাজ্য সভাপতিও মানেন। তাই তিনি দিলীপকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে চান। সব কর্মসূচিতে তাঁকে রাখতে চান। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও দিলীপকে ‘গুরুত্ব’ দেওয়া হয়েছে। তবে এ-ও অনেকে বলেন যে, বিজেপিকে একটি ‘দেশ’ মনে করা হলে দিলীপ ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’। অনেক ক্ষেত্রেই নিজের মতো কাজ করেন। নিজের মতো সফর করেন। যা নিয়ে রাজ্য নেতৃত্বকে সাম্প্রতিক কালেও বেশ কয়েক বার ‘বিড়ম্বনায়’ পড়তে হয়েছে। এ সব নিয়ে নানা মহল থেকে দিলীপের নামে নালিশ পৌঁছেছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে।
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর সঙ্গেও দলের অন্দরে দিলীপের সম্পর্ক বরাবরই ‘মধুর’। তবে প্রকাশ্যে তার কোনও ছাপ পড়েনি। বরং একই মঞ্চে দু’জনকে পরস্পরের পিঠ চাপড়াতেই দেখা গিয়েছে বেশি। অবশ্য সেটাই প্রত্যাশিত।
তবে মনে কি একটুও চাপ পড়ে না? বার বার তাঁকে নিয়ে দলের এমন সিদ্ধান্ত কি একটুও হতাশ করে না? ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, ‘‘মনের কথা তো সবটা পড়া যায় না। তবে ওঁর মুখে এ নিয়ে কোনও আক্ষেপ শোনা যায় না। কে কোথায় কলকাঠি নাড়ছেন, তা নিয়ে কোনও নালিশও নয়। শনিবার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরেও শোনা যায়নি।’’
শনিবারের রদবদল নিয়ে দিলীপের বক্তব্য, ‘‘লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের সাংসদদের সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সাংসদেরা যাতে নিজের নিজের এলাকায় বেশি করে সময় দিতে পারেন, তাই এই পদক্ষেপ।’’ এটা ঠিক যে, নতুন কমিটিতে যে সাংসদেরা রয়েছেন, এক জন ছাড়া তাঁরা সকলেই রাজ্যসভার সাংসদ। তেলঙ্গানার করিমনগর লোকসভা থেকে জয়ী সঞ্জয় বন্দিকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। তবে বিজেপি শিবিরের দাবি, সামনে তেলঙ্গানা বিধানসভা নির্বাচন থাকাতেই রাজ্যের প্রাক্তন সভাপতিকে এই পদ দেওয়া হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচনে তিনি প্রার্থীও হতে পারেন। একই ভাবে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন থাকায় দলের রোষের তালিকায় থেকেও সাধারণ সম্পাদক পদ খোয়াতে হয়নি কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে।
বিজেপিতে এমন একটা জল্পনা রয়েছে যে, সংসদের বাদল অধিবেশনের পরে দিলীপকে কেন্দ্রের মন্ত্রিত্ব দেওয়া হতে পারে। আবার অনেকে বলছেন, রাজ্যের জনপ্রিয় নেতা হিসাবে তাঁকে আবার রাজ্য সভাপতি করা হতে পারে! কিন্তু তেমন সম্ভাবনা ক্ষীণতম। কারণ, দলের দাবি, দিলীপকে দায়িত্ব থেকে ‘মুক্ত’ করা হয়েছে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জয় নিশ্চিত করতে। যে কথা বলছেন দিলীপও। সুতরাং, তার আগে মন্ত্রী করার সম্ভাবনা কম। বিজেপি শিবিরে জল্পনা থাকলেও দিলীপকে ফের রাজ্য সভাপতি করাও সম্ভব নয়। কারণ, দলীয় সংবিধান বলছে, পর পর দুই মেয়াদ কোনও স্তরে সভাপতি থাকার পরে মাঝে কমপক্ষে তিন বছরের ব্যবধান থাকতে হবে। আর সুকান্তের প্রথম মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে।
তবে তাঁর হিতৈষীরা মনে করেন, দিলীপের কাছে এখন বড় ‘চ্যালেঞ্জ’ মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রে ফের টিকিট পাওয়া এবং আবার সেখান থেকে জিতে আসা। কারণ, দিলীপ মানেন, রাজনীতিতে ‘যো জিতা ওহি সিকন্দর।’ তিনি নিজেও অতীতে বলেছেন, ‘‘আমি রাজ্য সভাপতি হওয়ার পরে নিজে আগে ভোটে জিতেছি। সেটা না হলে অন্যকে জিততে বলা যায় না।’’
তবে দিলীপের রাজ্য সভাপতি হওয়াটাও অনেকটা আকস্মিকই ছিল। সেই সময়ের একটা গল্প বিজেপির অনেকের মুখে মুখে ঘোরে। তখন সদ্য সঙ্ঘের (আরএসএস) দায়িত্ব থেকে রাজনীতিতে এসেছেন দিলীপ। হয়েছেন রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। রাহুল সিংহের পরবর্তী রাজ্য সভাপতি হিসাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বাঁকুড়ার সাংসদ সুভাষ সরকারের নাম প্রায় পাকা। সেই সময়ে বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) রাম লাল তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের কাছে দিলীপের নাম রাজ্য সভাপতি হিসাবে প্রস্তাব করেন। শুনে শাহ নাকি বলেছিলেন, যাঁকে তিনি চেনেন না, কখনও দেখেননি, তাঁকে প্রদেশ সভাপতি করা যায় নাকি!
এর পরে দিলীপকে দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়। সেটা ২০১৫ সাল। তখন দিল্লিতে তাঁর থাকার জায়গাও ছিল না। বিজেপিরই এক নেতার বাড়িতে ওঠেন। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেলেও শাহের সাক্ষাৎ পাননি। দিন সাতেক অপেক্ষার পরে দিলীপ সটান কলকাতায় ফিরে আসেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেন, তিনি আর রাজ্যের কাজকর্ম ফেলে অপেক্ষা করতে পারছেন না। পরে আবার তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। যাওয়ামাত্র শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়। বিজেপির নেতারা জানেন, সে দিনই বাংলার পরবর্তী রাজ্য সভাপতির নাম ঠিক হয়ে গিয়েছিল— দিলীপ ঘোষ।
রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর থেকে অনেক ঝড় গিয়েছে তাঁর উপরে। গাড়ির উপর একাধিক বার হামলা হয়েছে। তবে দিলীপ তাঁর নিজের কথায় ‘একরোখা’ হয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন। দলে তখন তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘গেছোদাদা’। আজ কোচবিহারে তো কাল কাকদ্বীপে। বিজেপি নেতারা মানেন, দিলীপের জন্যই রাজ্যে দলের শক্তি বেড়েছে। একটা সময়ে তাঁর ‘গরম’ বক্তব্যকে দলের কর্মীদের চাঙ্গা করার ‘মহৌষধ’ মনে করা হত। আবার দিলীপের পদ চলে যাওয়ার পরে অনেকে বলেছেন, ‘‘দিলীপের গরম গরম কথা দলের ক্ষতি করেছে।’’
দিলীপ যখন সংগঠনের কাজ শুরু করেন, তখন ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর অখণ্ড মেদিনীপুরের মধ্যে ছিল। কুলিয়ানা এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আরএসএস নেতারা বলেন, সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক দিলীপের মধ্যে যে বড় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে, সেটা শুরুর দিন থেকেই বোঝা গিয়েছিল। একটা সময়ে সংসার ছেড়ে পুরোপুরি সংগঠন করার জন্য বেরিয়ে পড়েন দিলীপ। একের পর এক দায়িত্ব পালন করে সঙ্ঘের আসানসোল জেলা প্রচারক হন। এর পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং ১৯৯৮ সালে আন্দামানের দায়িত্ব পান। ২০০৪ সালে সুনামিতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আন্দামান। দিলীপ আন্দামানের পুনর্নির্মাণ পর্ব কাটিয়ে ২০০৬ সালে কলকাতায় ফেরেন। বিধাননগরের দায়িত্ব পান। এর পরে সঙ্ঘ পরিবার ‘হিন্দু জাগরণ মঞ্চ’ গঠন করার সময় তাঁকে নতুন সংগঠনের প্রধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা বলেন, এখন রাজ্যে রামনবমীর মিছিল যে বড় আকার নিয়েছে, তার সূচনা দিলীপের হাতেই।
২০১৪ সালের পুজোর পরে পরে নবদ্বীপে আরএসএস-এর প্রচারক বৈঠক থেকে ঠিক হয় দিলীপকে রাজনৈতিক পরিসরে নিয়ে আসা হবে। সাধারণ ভাবে সঙ্ঘ প্রচারকদের বিজেপির সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) করা হয়। তখন সেই পদে ছিলেন অমলেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তাঁকে না সরিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে দিলীপকে রাজ্যের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সেই বছরেরই নভেম্বরে দিলীপ রাজ্য সভাপতি হন। প্রথম বারের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। কিন্তু সেই মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। তার মধ্যে দিলীপ খড়্গপুর সদর থেকে বিধায়ক এবং পরে মেদিনীপুর থেকে সাংসদ হয়েছেন। ২০১৯ সালে নিজে জেতেন এবং দলকেও ভাল ফল দেন। সে বার ১৮টি লোকসভা আসনে জিতেছিল দিলীপ। পুরস্কারও পান। ২০১৯ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় দফায় তাঁকে তিন বছরের জন্য রাজ্য সভাপতি করা হয়।
সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু এক বছর বাকি থাকতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে দিলীপকে সরিয়ে রাজ্য সভাপতি করা হয় বালুরঘাটের সাংসদ সুকান্ত মজুমদারকে। তবে হিসাবমতো ছ’বছরই দিলীপ রাজ্য সভাপতি থেকেছেন।
আরও পড়ুন:
দল ব্যবস্থা নিচ্ছে জানিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের খবরের এক ঘণ্টার মধ্যেই হুমায়ুনকে চিঠি তৃণমূলের
দিলীপ রাজ্য সভাপতি থাকার সময়েও নিয়মিত ‘ধমক’ খেতেন কেন্দ্রীয় নেতাদের থেকে। এ কথা তিনি নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন একাধিক বার। কিন্তু ২০২২ সালের ৩১ জুন দিলীপকে ‘সেন্সর’ করেন বিজেপি নেতৃত্ব। সেই চিঠি দিলীপকে পাঠানোর আগে প্রকাশ্যে চলে আসে। তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন দিলীপ। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অনুগামীদের কাছে তা গোপন করেননি। তবে একই সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘যে দিন প্রচারক হতে বেরিয়েছি, সে দিন থেকেই আমার লক্ষ্য স্থির। এক জীবন, এক লক্ষ্য। তাই পদ থাকল কি থাকল না, কেউ ভাল বলল কি বলল না, সেটা না ভেবে নিজের মন যা চাইবে, তেমন করে সংগঠনের কাজ চালিয়ে যাব। আমি বিশ্বাস করি, দলের অনুশাসন কখনও ভাঙিনি।’’
গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আশানুরূপ ফল না হওয়ায় অনেকে দিলীপকে দুষেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায়। সেই তালিকায় ছিলেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়, শিবপ্রকাশও। কিন্তু শনিবারের রদবদলে কৈলাস এবং শিবপ্রকাশ নিজপদেই বহাল রয়েছেন। বার বার তবে দিলীপের পদলোপ কেন? এক দিলীপ-অনুগামীর বক্তব্য, ‘‘দিলীপদা ‘ঘরের ছেলে’। তিনি ‘পদলোভী’ নন। এটা জানা আছেই বলে তাঁকে বার বার এমনটা করা হয়।’’
তবে রাজ্য বিজেপির একটি অংশের দাবি, এই রদবদলে দিলীপের মধ্যে আহামরি কোনও পরিবর্তন আসবে না। নামের আগে ‘সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি’ লেখা থাকবে না শুধু। এখন বরং রাজ্য নেতৃত্ব চাইলে আগের মতোই তাঁকে কাজে লাগাতে পারবেন। লোকসভা নির্বাচনে দিলীপকে সংগঠনের কাজে এবং প্রচারে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু দিলীপকে কি কাজে লাগাতে চাইবেন সুকান্তেরা?