ডাক্তারির পরীক্ষায় গণ-টোকাটুকি, প্রশ্নপত্র, এমনকি উত্তরপত্র ফাঁসের অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। সেই সব অভিযোগ নিয়ে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হয়েছে চিকিৎসক সংগঠন। তারই মধ্যে এ বার একটি মেডিক্যাল কলেজের পরীক্ষা কক্ষে ‘বহিরাগত’ এক চিকিৎসকের ঘোরাঘুরি এবং মোবাইল বার করে পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলার ঘটনা ঘৃতাহুতি দিয়েছে গণ-টোকাটুকির অভিযোগে।
উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে গত মে মাসে স্নাতকোত্তর স্তরের পরীক্ষা কক্ষের একটি ভিডিয়ো (সেটির সত্যতা আনন্দবাজার পত্রিকা যাচাই করেনি) চিকিৎসক মহলে ছড়িয়েছে। ২৬ মে-র দুপুরে সিসি ক্যামেরার ওই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, একটি পরীক্ষা কক্ষ পরিদর্শন করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুহৃতা পাল। প্রায় একই সময়ে ওই ঘরেই ঘোরাফেরা করতে দেখা যায় সবুজ ফুলহাতা জামা পরা এক যুবককে। পরবর্তী মুহূর্তে মোবাইল বার করে সেটি হাতে রেখে এক পরীক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় তাঁকে। যাঁর পরিচয়, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের রেডিয়োলজি বিভাগের আরএমও (রেসিডেন্ট মেডিক্যাল অফিসার) অভীক দে। সিনিয়র চিকিৎসকদের অধিকাংশেরই প্রশ্ন, পরীক্ষা কক্ষে আরএমও কী করছেন? নিয়মানুযায়ী, বহিরাগতের পরীক্ষা কক্ষে থাকার কথাই নয়।
রাজ্যের এক মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধানের কথায়, ‘‘শুনেছি, এমডি-এমএসের পরীক্ষা চলাকালীন এমন কাণ্ড ঘটেছে। এর থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে যে ডাক্তারি পরীক্ষাতেও টোকাটুকির রেওয়াজ পুরোদমে চালু হয়েছে।’’ তিনি-সহ অন্যান্য কলেজ কর্তৃপক্ষেরা জানাচ্ছেন, পরীক্ষার সময়ে ইন-চার্জ থাকেন সেই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। তিনি ঠিক করে দেন, কোন কোন শিক্ষক-চিকিৎসক পর্যবেক্ষক হবেন। তবে তাঁরাও পরীক্ষা চলাকালীন মোবাইল নিয়ে ঢুকতে পারেন না। সেখানে মোবাইল হাতে বর্ধমানের আরএমও কী করছিলেন? চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, ‘‘পরীক্ষা কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যেতেই পারেন। কিন্তু অন্য কারও থাকাটা নিয়মবিরুদ্ধ। বিষয়টি নিয়ে জানতে ফোন করা হলে অভীকের দাবি, ‘‘সরকারি অর্ডারে পর্যবেক্ষক ছিলাম। তাই গিয়েছিলাম।’’
অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনও পরীক্ষায় পরিদর্শক নিয়োগ করেন পরীক্ষা নিয়ামক। অন্য কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকদেরই পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ করার নিয়ম। তিনি বলেন, ‘‘উপাচার্যের সঙ্গে যিনি পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, পরিদর্শক হিসাবে তাঁর আদেশনামা ছিল তো? যদি থাকে, তা হলে প্রশ্ন, রাজ্যে কি শিক্ষক-চিকিৎসকের অভাব যে আরএমও পদের কাউকে পরিদর্শক করতে হচ্ছে?’’ সমস্ত বিষয় জানিয়ে গত ১৩ জুন রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠিও দিয়েছে মানসদের সংগঠন।
সূত্রের খবর, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে উপাচার্যের সঙ্গেই গিয়েছিলেন অভীক। তাই তাঁকে প্রবেশে বাধা দেওয়ার সাহস কেউ দেখাননি। জানা যাচ্ছে, আরএমও পদে চাকরি করা সত্ত্বেও ওই চিকিৎসক এখনও শাসকদলের ছাত্র পরিষদের মেডিক্যাল সেলের আহ্বায়ক। আবার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বহুল চর্চিত ‘উত্তরবঙ্গ লবি’-র ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবেও তিনি পরিচিত বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, ‘‘উত্তরবঙ্গের বিশেষ এক চিকিৎসকের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে স্বাস্থ্য দফতর, হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে অবাধ গতিবিধি তাঁর। পোস্টিং, বদলি সবেতেই সেই চিকিৎসক নেতার নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।’’
বিজেপির চিকিৎসক সেলের আহ্বায়ক শারদ্বত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় হয়ে গিয়েছে। সেখানে অভীক ঘুরবেন, সেটাই স্বাভাবিক। প্রশাসনিক স্তরে ওঁকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে মনে হয় না। কারণ, সেই যোগ্যতা নেই। বরং রাজনৈতিক দলের হয়ে ঘুরছিলেন বলেই মনে হচ্ছে।’’ এই বিষয়ে জানতে কয়েক বার ফোন ও মেসেজ করা হলেও উত্তর মেলেনি সুহৃতার।