রাজ্যের আদিবাসীপ্রধান যেসব এলাকার সঙ্গে কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের যোগ রয়েছে, সেইসব গ্রামে শহরের মতো সুযোগ-সুবিধা দিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় এই তালিকায় শুধু যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-ক্ষুদিরাম বসুদের গ্রাম আছে তা নয়, এই তালিকায় রয়েছে চুনী কোটালের গ্রাম গোয়ালডিহিও। লোধা সম্প্রদায়ের মধ্যে চুনী কোটালই প্রথম স্নাতক হয়েছিলেন।
১৯৮৫ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক চুনী কোটাল আত্মহত্যা করেন ১৯৯২ সালে। তখন অভিযোগ উঠেছিল, ক্রমাগত জাতিবৈষম্যের শিকার হয়েই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
মৃত্যুর সাতাশ বছর পরে কেন চুনী কোটালকে মনে পড়েছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের? এর জবাব এড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বলছে, এই প্রকল্প তৃণমূল কংগ্রেসের নয়, রাজ্য সরকারের। যদিও অনেকেই এর মধ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের অঙ্ক দেখতে পাচ্ছেন।
২০১৮ সালে রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ভোটে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৩৪ শতাংশ আসনে ও পঞ্চায়েত সমিতিতে ২৬ শতাংশ আসনে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। একটি পঞ্চায়েত আসনে ব্যতিক্রম ছাড়া এই সব আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস। তার পরেও বিভিন্ন জায়গায় বিজেপি বোর্ড গঠন করে ফেলে।
এবছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়ী হয়েছে বিজেপি। উত্তরবঙ্গ ও রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে ভরাডুবি হয়েছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের। জঙ্গলমহলে দারুণ ফল হয় বিজেপির। ভোটের ফলের জন্য ইভিএম-কে দুষলেও দলীয় ও প্রশাসনিক স্তরে বেশ কয়েকটি রদবদল করে তৃণমূল কংগ্রেস। তাতে দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোষের মুখে পড়েন আঞ্চলিক নেতারা।
দায়িত্বে নতুন মুখ এলেও তাতে কাজের কাজ হচ্ছে কিনা তা বোঝার উপায় আর বিশেষ নেই। এবার একেবারে বিধানসভা ভোট। এই অবস্থায় রাজ্যের আদিবাসীদের মন পেতে তৎপর হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
চুনী কোটালের জন্ম ১৯৬৫ সালে। ১৯৮৫ সালে লোধা সম্প্রদায়ের প্রথম মহিলা হিসাবে নৃতত্ত্বে তিনি স্নাতক হন। তারপরে বিদ্যাসাগর কলেজেই হস্টেল সুপারের চাকরি পান। সম্প্রদায় নিয়ে নানারকম কথা তাঁকে শুনতে হচ্ছিল। অভিযোগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে তিনি ভর্তি হওয়ার পরে এই আক্রমণ তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের কাছ থেকেই তিনি বেশি আক্রান্ত হচ্ছিলেন বলে অভিযোগ। এ ব্যাপারে তখন অভিযোগের আঙুল উঠেছিল বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ফাল্গুনী চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে।
লোকসভা ভোটের আগেই নমঃশূদ্র উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করেছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরেও মতুয়া সম্প্রদায়ের সব ভোট ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল কংগ্রেস। তাই ভোটের এক বছরেরও বেশি সময় হাতে থাকতে আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কের দিকে নজর দিচ্ছে রাজ্যের শাসকদল। বিরোধীরা অন্তত তাই মনে করছেন।
তখন শুধু রাজ্য জুড়ে নয়, পুরো পূর্বভারত জুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়। চাপে পড়ে কমিটিও গঠন করে রাজ্য সরকার। পরে তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করে ভারত সরকার। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অফ আমস্টারডমের দুই অধ্যাপক ভারতের জাতপাত বিন্যাস নিয়ে চুনী কোটালকে ধরে তখন গবেষণাও করেছিলেন।
শালবনি ব্লকের গোয়ালডিহি গ্রামে হস্টেল হবে, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে একেবারে শহরের মতো। অন্য সুযোগ সুবিধাও হবে একবারে শহরের মতোই। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমল বলেন, “এই জেলায় তিনটি প্রকল্পের জন্য আমরা তিনটি আলাদা জায়গা বেছেছি। এর মধ্যে দু’টি জায়গার সঙ্গে ইতিহাসের যোগ রয়েছে, আর এটি একমাত্র আদিবাসী গ্রাম। শহরে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও পথঘাট রয়েছে, এখানে আমরা সেই ধরনের ব্যবস্থা করতে চাই। কাউকে বঞ্চিত না করাই আমাদের লক্ষ্য।”
অন্য দু’টি গ্রাম হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বীরসিংহ ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর গ্রাম মোহবনি।