বেলুড় মঠে স্বামীজির নির্দেশে রাত চারটের সময় ঘণ্টা বাজিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দেওয়া হত। সাধু ব্রহ্মচারীরা সবাই ঘুম থেকে উঠে প্রস্তুত হয়ে এসে ঠাকুর ঘরে ধ্যান-জপ করতেন। স্বামীজির প্রখর শাসনে এই নিয়মের কোনও নড়চড় হওয়ার উপায় ছিলনা। স্বামীজি কঠোর নিয়ম করেছিলেন যে, যে সাধু বা ব্রহ্মচারী নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে আসতে পারবেনা তাকে সেদিন বাইরে থেকে ভিক্ষা করে এনে খেতে হবে, মঠে সে সেদিন খেতে পাবেনা। একদিন মহাপুরুষ মহারাজ স্বামী শিবানন্দ কোনও কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে আসতে পারলেননা। স্বামীজি তাঁর কাছে গিয়ে বললেন , ” তারকদা, (স্বামী শিবানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল তারক) আমরা একটি নিয়ম করেছি যে, নির্দিষ্ট সময়ে ঠাকুর ঘরে এসে সাধন-ভজন না করতে পারলে তাকে সেদিন বাইরে ভিক্ষা করে খেতে হবে। শিবানন্দজী ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। স্বামীজি নীরবে সেই চলে যাওয়া দেখলেন। তারপর খাওয়ার সময়ে দেখা গেল স্বামীজি খাওয়ার ঘরে আসেননি। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও তাঁকে খাওয়ানো গেলনা। সারাদিন তিনি অভুক্ত রইলেন। দিনের শেষে ভিক্ষা করে ফিরে এলেন স্বামী শিবানন্দজী। স্বামীজি ছুটে এসে তাঁকে ধরলেন। সাগ্রহে বললেন, ” দেখি তারকদা, ভিক্ষা করে কী কী এনেছেন। আসুন আমরা দুই ভাই একসাথে এই ভিক্ষান্ন খাই। কতদিন মাধুকরীর অন্ন খাইনি!” স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী বিবেকানন্দ একসাথে সেদিন ভিক্ষান্ন গ্রহণ করলেন।
আরেকদিন স্বামীজি নতুন সন্ন্যাসী ব্রহ্মচারীদের নিয়ে বেদান্ত পাঠ ও ব্যাখ্যা করছেন। বেদান্তের আলোচনায় স্বামীজি মগ্ন হয়ে গেছেন। এরমধ্যে স্বামী প্রেমানন্দ হৈ হৈ করে এসে বললেন, ” সবাই চল ঠাকুরের আরতি করতে হবে।” বেদান্তের আলোচনায় এভাবে ব্যাঘাত ঘটায় স্বামীজির বিশাল নয়ন-প্রান্তে যেন অগ্নি-স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল। তিনি তীব্রভাবে স্বামী প্রেমানন্দজীকে বললেন, ” তুই কী ভেবেছিস? একটি ছবির সামনে সলতে পোড়া নাড়লেই শুধু তাঁর পুজো হয়? আর এখানে যেটা হচ্ছে সেটা তাঁর পুজো নয়? স্বামীজি এরপর আরও কঠোর ভাষায় প্রেমানন্দজীকে তিরস্কার করতে লাগলেন। অবশেষে সান্ধ্য-পূজার পর প্রেমানন্দজীকে কোথাও দেখা গেলনা। যে স্বামীজি এতক্ষণ প্রেমানন্দজীকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন, তিনিই শিশুর মতো ব্যাকুল হয়ে উঠলেন প্রেমানন্দজীকে দেখার জন্য। ব্যাকুল হয়ে অবুঝের মত বিলাপ করতে লাগলেন, ”ওরে বাবুরাম (স্বামী প্রেমানন্দের পূর্বাশ্রমের নাম ছিল বাবুরাম) কোথায় গেল? সে কি আমার গালাগাল খেয়ে গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যা করল?” একদিকে বাবুরাম মহারাজকে পাওয়া যাচ্ছেনা, তার উপর স্বামীজি তাঁকে দেখার জন্য এরকম ছটফট করছেন। মঠের সাধু-ব্রহ্মচারীদের দিশাহারা অবস্থা। অবশেষে একজন দেখেন বাবুরাম মহারাজ ছাদের উপরে অন্ধকারের মধ্যে একা একা বসে আছেন। তাঁকে ধরে আনা হল স্বামীজির কাছে। স্বামীজি বাবুরাম মহারাজকে দেখতে পেয়েই ব্যাকুল হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। বাবুরাম মহারাজ এভাবে স্বামীজির আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে কেঁদে ফেললেন। স্বামীজিরও চোখে জল। দুই গুরুভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
একদিন লাটু মহারাজ (স্বামী অদ্ভুতানন্দজী) স্বামীজিকে বললেন, ”তুমি এখন বিলেত থেকে এসেছ, মঠে কতরকম নতুন নতুন নিয়ম করেছ, আমি ওসব মানতে পারবনা। আমার মন এখনও ওরকম ঘড়ি-ধরা হয়নি যে তুমি ঘণ্টা বাজালেই আমি ধ্যানে বসে পড়ব। সুতরাং আমি এখানে আর থাকবনা, আমি চললাম।” স্বামীজি তখন তাঁর চলে যাবার ব্যাপারে সম্মতি দিলেন। কিন্তু লাটু মহারাজ সত্যিই চলে যাচ্ছেন দেখে স্বামীজি ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ” দেখ লাটু, কত নতুন ছেলেরা এখন মঠে যোগ দিচ্ছে, একটা নিয়মের মধ্যে না রাখলে এরা সব বিগড়ে যাবে। এসব নিয়ম কানুন তোর জন্যে নয়।” লাটু মহারাজ নিশ্চিন্ত হয়ে মঠে থেকে গেলেন।
বাঘা নামে একটি নেড়ি কুকুর মঠে থাকত। স্বামীজির সাথে তার ছিল ভালবাসার সম্পর্ক। একদিন কুকুরটি ঠাকুরের ভোগে মুখ দিয়ে ফেলায় মঠের সন্ন্যাসীরা তাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন। স্বামীজি তখন মঠে ছিলেননা। স্বামীজি সন্ধ্যায় মঠে ফিরে শুনলেন সবাই মিলে বাঘাকে বেঁধে নিয়ে গিয়ে গঙ্গার ওপারে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। এদিকে মঠ বাঘাকে ছাড়লেও বাঘা কিন্তু মঠকে ছাড়বার পাত্র নয়। সাধুরা তাকে গঙ্গা পার করে দিয়ে ফিরে গেলে বাঘাও কিছুক্ষণ বাদে আরেকটি ফিরতি নৌকায় উঠে বসল। মাঝিরা তাকে নামাতে গেলে সে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে। অবশেষে নৌকার অন্য যাত্রীরা মাঝিদেরকে বলল,” কুকুরটা যখন কোনও ক্ষতি করছেনা, চুপ করেই বসে আছে; তখন নিয়েই চল ওকে।” বাঘা এভাবে ফিরে এসে সারারাত বেলুড় মঠের আশেপাশেই লুকিয়ে রইল। বাঘা জানত স্বামীজি ভোর হবার আগেই স্নান-ঘরে আসেন। বাঘা সেখানে লুকিয়ে স্বামীজির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। স্বামীজি এলে বাঘা তাঁর পায়ে মুখ ঘষতে ঘষতে কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগল। স্বামীজি বাঘাকে নিয়ে বেরিয়ে এসে মঠের সকলকে ডেকে বললেন, ” বাঘাকে আর এভাবে যেন কেউ তাড়িয়ে না দেয়। ও চিরদিন মঠেই থাকবে।” তখন বাঘার আনন্দ দেখে কে! লেজ নাড়তে নাড়তে গর্বের সঙ্গে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাঘা ভৌ ভৌ করে আনন্দ করতে লাগল। বাঘার মৃত্যুর পর তার মৃতদেহটাকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। পরেরদিন দেখা গেল ভাঁটার টানে বাঘার নশ্বর দেহটি আবার মঠ-ভূমিতে ফিরে এসেছে। তখন বাঘার দেহ সসম্মানে মঠের জমিতেই সমাহিত করা হয়েছিল।
রামকৃষ্ণ সংঘ নামক যে সংগঠনটি স্বামীজি তৈরি করেছিলেন সেই সংগঠনের ভিত্তি ছিল এই অকৃত্রিম ভালবাসা, পরস্পরের প্রতি নিখাদ টান। আর এই ভালবাসার কারণ হলেন ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। মঠের সবাই, সবকিছুই ঠাকুরের — এই বোধের সঞ্চার ঘটিয়ে স্বামীজি সকলকে দুর্নিবার ভালবাসায় আবদ্ধ রেখেছিলেন। মঠের সাধুদেরকে তিনি বলতেন, ” ঠাকুর যেমন আমাকে ভালবাসতেন, আমি যেমন তোদেরকে ভালবাসি; তোরাও তেমনি জগৎটাকে ভালবাস দেখি।” স্বামীজি যেন ছিলেন এই ভালবাসার মূর্তিমান বিগ্রহ। তিনি ভালবাসা দিয়ে সংগঠন তৈরি করেছিলেন, ভালবাসা দিয়ে সংগঠনকে শাসন করতেন, ভালবাসা দিয়ে সংগঠনকে বেঁধে রেখেছিলেন।