Story image

যাঁরা চেনেন না, তাঁদের পক্ষে কলকাতার বইপাড়ায় গিয়ে এই দোকান খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। রাস্তা থেকে দেখা যায় না। সামনের ঘিরে দেওয়া ফুটপাথে ছোটো বইবিক্রেতারা বসেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো ফুটে ওপরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে এঁদের নামফলক। বই নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁরা অবশ্য একডাকে চিনবেন – ‘দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। কলেজ স্ট্রিটের সবথেকে পুরোনো বইয়ের দোকান – যা আজও রমরমিয়ে চলছে।

প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা। যশোরের কালিয়া গ্রামে থাকতেন গিরিশচন্দ্র দাশগুপ্ত। শিক্ষিত আধুনিকমনস্ক পরিবারের সন্তান। পূর্ববঙ্গের বহু মানুষ তখন কলকাতায় আসতেন কাজের খোঁজে। গিরিশচন্দ্রও একদিন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীর দিকে রওনা দিলেন। পথে স্টিমারে মহেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয়। তিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি করতে মহানগরে আসছিলেন। তাঁর পরামর্শেই বইয়ের ব্যবসা বেছে নেন গিরিশচন্দ্র।

শিক্ষক-অধ্যাপক-পড়ুয়াদের নির্ভরযোগ্য বইয়ের দোকান 

বঙ্গীয় নবজাগরণের কেন্দ্র তখন কলকাতা। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ইতিমধ্যেই প্রথিতযশা। ঠাকুর পরিবারকে ঘিরে নতুন রুচিবোধ গড়ে উঠেছে। ব্রাহ্ম আন্দোলন খুবই প্রাণবন্ত। গিরিশচন্দ্র ১৮৮৬ সালে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে চালু করলেন বইয়ের দোকান। বিদেশ থেকে বই আনাতেন। আশেপাশে আরও কয়েকটা বইয়ের দোকান ছিল। যেগুলো পরে বন্ধ হয়ে যায়। 

১৯০২ সালে গিরিশচন্দ্র দোকান সরিয়ে আনেন এখনকার জায়গায়। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে ক্ষিতীশচন্দ্র। দোকানের পাশাপাশি খুললেন প্রকাশনা এবং ছাপাখানা। দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি হয়ে উঠল বাংলা, বিহার, ওড়িশা সরকারের বই বিক্রেতা। সরকারের নানা দপ্তর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগারে তাঁদের বই যেত। 

দোতলায় সাজানো থরে থরে বই 

ক্ষিতীশচন্দ্রের দুই ছেলে অমূল্যচন্দ্র এবং বিজন দাশগুপ্তের সময় ব্যবসা আরও ফুলেফেঁপে ওঠে। তখন বইয়ের জগতে অনেক প্রকাশক। অমূল্যচন্দ্র তাই প্রকাশনা এবং ছাপাখানা বন্ধ করে দেন। বিদেশ থেকে প্রচুর বই আনাতেন। সেগুলো পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশার বিভিন্ন কলেজে সরবরাহ হত। শিক্ষক-অধ্যাপক-পড়ুয়াদের  আস্থা অর্জন করেন। ইউরোপ-আমেরিকার বেশ কিছু প্রকাশকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। 

অমূল্যচন্দ্রের ছেলে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানির বর্তমান কর্ণধার অরবিন্দ আবার শুরু করেছেন বাংলা এবং ইংরেজি বইয়ের প্রকাশনা। তবে অনলাইন প্রযুক্তির কুফল নিয়ে খুব চিন্তিত তিনি। বললেন, “প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে, ছাপা বইয়ের প্রকাশনায় ধাক্কা আসছে। এটাকে কাটিয়ে ওঠাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ”। তা হলে উপায় কী? অরবিন্দবাবুর মতে, “সারা ভারতে এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশ মানুষ ছাপা বই পড়ে। সেটাকে অন্তত ১৫ থেকে ২০ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। সরকারেরও তাতে উদ্যোগী হওয়া দরকার। প্রকাশনার জগতে আরেক সমস্যা বই পাইরেসি। সরকারের উচিত কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেওয়া। নইলে অনেক বড়ো বড়ো লেখক আজকাল লিখতে চান না।”

এখনকার কর্ণধার অরবিন্দ দাশগুপ্ত 

প্রত্যেক বছর ‘ইতিবৃত্ত’ নামের একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করছে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। যার সম্পাদক বিশিষ্ট সাহিত্যিক রামচন্দ্র প্রামাণিক। গবেষণামূলক নিবন্ধের সঙ্গে নামি-অনামি কবি-লেখকদের গল্প-কবিতাও থাকে সেখানে। অরবিন্দবাবু বললেন, “নতুন লেখকদের তৈরি করতে হবে। এখন ভালো লিটল ম্যাগাজিন বেরোয় না। টিভি চ্যানেলেও নতুন লেখকদের গল্প, কবিতা পাঠে জোর দিতে হবে”।

কলকাতায় বইয়ের জগতে এক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। আরও বহু বছর তাঁরা লেখক ও পাঠকের মিলন ঘটাতে নতুন নতুন উদ্যোগ নিন, আরও বিকশিত হয়ে উঠুন। এই আমাদের কামনা। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.