তোমার নামে “তাসের দেশ” নাটিকা উৎসর্গ করলুম’ — নেতাজির প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আশ্চর্য সময় ছিল বটে উনিশ শতক। একের পর এক সেরা মানুষের আবির্ভাব হয়েছিল সেই সময়। এতটা সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর এই দুই বাঙালি মনীষীর জীবনের গল্প বিস্ময় হয়ে এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। একজন হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র আর অন্যজন কলম। অসি আর মসীর এই বৈপরীত্যও কোথায় যেন মিলে গিয়েছে বাঙালির মনে ও মননে। কেমন ছিল রবি ও সুভাষের কথালাপ? তাদের মত ও পথ? আজকের কথকতার কথামুখ থাক সেই দিশাতেই।

সুভাষচন্দ্র আর রবি ঠাকুরের প্রথম দেখা শান্তিনিকেতনে। ১৯১৪ সাল নাগাদ একদল ছাত্রের সঙ্গে মিলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। ছাত্রদের কর্তব্য সম্পর্কে উপদেশ চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বলা পল্লী উন্নয়নের কাজে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব একটুও পছন্দ হয়নি সুভাষচন্দ্রের। তার চেয়ে ‘আমার জীবনে লভিয়া জনম জাগোরে সকল দেশ’— এই গানটি অনেক বেশি সত্য হয়ে উঠেছিল সুভাষচন্দ্রের জীবনে। বিলেত থেকে আইসিএস হয়ে ফেরার পথে সুভাষচন্দ্রের কাছে আসে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠি। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গান্ধিজির কাছ থেকে উপদেশ নিতে বলেছিলেন সুভাষচন্দ্রকে। তেমনটাই করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। গান্ধিজির কথামতো চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে দেখা করে শুরু হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এমনি কোনো এক সময় জোড়াসাঁকোয় উপস্থিত হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা, নিজের জীবনে দেশবন্ধুর প্রভাব ব্যক্তিগত কোনো নৈকট্য তৈরি করেনি এই দুই মনীষীর মধ্যে। ১৯২৪ সালে কারাবন্দি সুভাষচন্দ্র মন্ত্রের মতো জপ করেছিলেন রবি ঠাকুরের কবিতা, গান তথা শব্দগুলি। জেল থেকে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পত্রালাপ চলতো সুভাষচন্দ্রের। ‘কথা ও কাহিনি’, ‘চয়নিকা’, ‘গীতাঞ্জলি’, ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গোরা’ ছিল সুভাষচন্দ্রের পছন্দের বইয়ের তালিকায়। ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন বয়কটের সূত্রে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজীর মতপার্থক্য শুরু হয়। সুভাষ তখন তরুণ সমাজে দৃপ্ত অগ্নিকণা । এই সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ ও সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক গভীর হতে শুরু করে। পত্রালাপ হয় বেশ কয়েকবার।

১৯৩১ সালে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। সেই সূত্রে সুভাষচন্দ্র একটি রিলিফ ফান্ড তৈরি করেন। প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে সভাপতি করে এলবার্ট হলে একটি সভাও হয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্র ও প্রফুল্লচন্দ্রের হঠাৎ বাদানুবাদ হয় এবং তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং দেশবাসীর উদ্দেশে কয়েক ছত্র লিখে তহবিলে দান করার আবেদন জানান। —

‘অন্নহারা গৃহহারা চায় ঊর্ধ্বপানে
ডাকে ভগবানে। 
যে দেশে সে ভগবান মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ৈ 
সাড়া দেন বীর্যরূপে, দয়া রূপে, দুঃখে, কষ্টে, ভয়ে
সে দেশের দৈন্য হবে ক্ষয়
হবে তার জয়।’

সুভাষচন্দ্র এই কবিতাটি ৬ সেপ্টেম্বর ‘লিবার্টি’ পত্রিকায় প্রকাশ করে লিখেছিলেন— ‘Dr Rabindranath Tagore, who has kindly consented to become the President of the Bengal Congress Flood and Famine Releif Committee, has addressed the following appeal to the people.’ এরপর হিজলি জেলের রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা আজ স্বর্ণস্মৃতি।

তবে সবসময় দুজনের মত মিলেছে এমন নয়। বাংলার বিভিন্ন জেলে থাকার সময় সুভাষচন্দ্রের স্বাস্থ্যহানি  হয়। সেই সময় তিনি বিদেশ যাওয়ার অনুমতি পেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি পরিচয় পত্র চেয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সংক্ষিপ্ত পরিচয় পত্র একেবারেই পছন্দ হয়নি সুভাষচন্দ্রের। তারপর ভিয়েনাতে থাকার সময় সুভাষচন্দ্র সেই বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Indian Struggle’ রচনা করেছিলেন। এই বইয়ের ভূমিকা লেখার জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন বার্নাড শ’ অথবা এইচ জি ওয়েলসকে অনুরোধ করতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সরাসরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সুভাষচন্দ্রকে লিখেছিলেন, ‘Bernard Shaw-কে আমি ভালো মতো জানি, তোমার বইয়ের পূর্বভাষণ লেখবার জন্য তাঁকে অনুরোধ করতে আমি সাহস করিনে। করলেও  ফল হবে না এই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’ এই চিঠি পেয়ে সুভাষচন্দ্র সন্তুষ্ট হতে পারেননি।

এরপর সুভাষচন্দ্র রাজনীতির বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেপ্তার  হন। সুভাষচন্দ্রের মুক্তির দাবিতে ১৯৩৬ সালের ১০ মে কংগ্রেস ‘সুভাষ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই উপলক্ষ্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। সুভাষচন্দ্রের মুক্তির পর শান্তিনিকেতন থেকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মহাজাতি সদনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সুভাষচন্দ্র। মহাজাতি সদন নামটি রবীন্দ্রনাথের দেওয়া।

এরপর সেই বিতর্কের কথা বলি— বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গান নিয়ে যা হয়েছিল। এই গানটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। বলা হয় গানে যে মাতৃমূর্তি আঁকা আছে, তা পৌত্তলিকতার পক্ষে। বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলমান বিদ্বেষের ইঙ্গিতবাহী। আবার একদল হিন্দু দাবি করেন এই গানটিকেই জাতীয় সংগীত করা হোক। সুভাষচন্দ্র প্রমুখ নেতারা বেশ বিব্রত হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বলেছিলেন, বিতর্ক এড়াবার জন্য ‘বন্দেমাতরম’-এর পরিবর্তে ‘বন্দেভ্রাতরম’ স্লোগান গ্রহণ করা হোক। আন্দোলন যখন তীব্র আকার ধারণ করেছে, তখন Dr.J.H .cousins রবীন্দ্রনাথের ‘জন-গণ-মন’ সংগীতকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব দেন। সে এক নতুন বিতর্ক তৈরি  হয়। রবীন্দ্রনাথ নীরব হয়ে যান। এরপর অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয় সামনে আসায় এইসব বিতর্ক চাপা পড়ে যায়। কিন্তু ১৯৪২ সালেহামবুর্গে অনুষ্ঠিত ‘ইন্দো জার্মান কালচারাল সোসাইটির অনুষ্ঠানে যখন প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়, তখন সুভাষচন্দ্র ‘জন-গণ-মন’ গানটিকেই প্রথম জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দিয়েছিলেন। এর আগে সুভাষচন্দ্র যখন ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করেছিলেন, তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি, বাঙলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি।’ ‘তাসের দেশ’ নাটকটিও রবীন্দ্রনাথ উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষচন্দ্রকেই। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন,

‘কল্যাণীয় শ্রীমান সুভাষচন্দ্র,

স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ করে তোমার নামে “তাসের দেশ” নাটিকা উৎসর্গ করলুম।’ সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের পর রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে সুভাষচন্দ্রের দাদা বৌদি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। ততদিনে সুভাষচন্দ্রের জার্মান পৌঁছনোর সংবাদ এসেছে। রবীন্দ্রনাথের উদ্বিগ্ন অবস্থা দেখে তাঁরা কবিকে সত্য জানিয়ে আসেন। মৃত্যুর আড়াই মাস আগে লেখা গল্প ‘বদনাম’ গল্পের নায়ক পলাতক বিপ্লবী। সে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায় আফগানিস্তানের পথে। ঠিক সুভাষচন্দ্রের মতো। দেশত্যাগ করার ছয়দিন আগে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র। 

বাংলার ইতিহাসের দুই প্রবাদপ্রতিম অসমবয়সী পুরুষ যে অচেনা টানে যুক্ত ছিলেন পরস্পরের সঙ্গে সে এক আশ্চর্য অনুভূতি। হয়তো সেই টানের নাম ভারতবর্ষ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.