রবি, দ্বিজেন, অতুল — তিন গায়কের জমজমাট পরিবেশন ঠাকুরবাড়ির ‘খামখেয়ালি সভায়’

খামখেয়ালি লোকজনের ভিড় হলে যা হয়, সবসময় অসংখ্য হুজুগ আর হুল্লোড়! এই খামখেয়ালি মানুষজন যদি হন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বাসিন্দা, তাহলে প্রতিটা হুল্লোড় যে সৃজনশীল হবে, সেকথা বলাই বাহুল্য। ঠাকুরবাড়িতে অনেকরকম মজাদার আসর বসতো, সেগুলির মধ্যে একটি হল খামখেয়ালি সভা। ড্রামাটিক ক্লাব নামের একটি নাটকীয় আসরে জমজমাট নাট্যাভিনয়, সাহিত্যপাঠের আসর বসতো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘অলীকবাবু’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। অভিনয়ের চরিত্রটিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তাঁদেরই পরিচিত এক মদ্যপ বৃদ্ধের নকল করেছিলেন। তখন খুব অশান্তি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেন ড্রামাটিক ক্লাব তুলে দেবেন। তখনই ক্লাবের সঞ্চিত অর্থে অনুষ্ঠিত হয়, ড্রামাটিক ক্লাবের শ্রাদ্ধ আর খামখেয়ালি সভার অন্নপ্রাশন। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ২৪ মাঘ এই আশ্চর্য সভার শুভ সূচনা হল। 

উনিশ শতকের অনেক পণ্ডিত মানুষ এই সভার সদস্য ছিলেন। গান বাজনা, আবৃত্তি, নাটকে এই সভা ছিল শিল্পের উদযাপন। সভার প্রাণকেন্দ্রে অবশ্যই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ আর গগনেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে এই সভার প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়। এক এক সময় এক একজন সদস্য সভা ডাকতেন। বলাই বাহুল্য প্রত্যেকটা সভাই ছিল অত্যন্ত সংস্কৃতিমনস্ক। সবচেয়ে মজার ছিল আমন্ত্রণ পত্রগুলি। সভার আহ্বান করতেন যে সদস্য, তাঁর নাম দিয়ে রবি ঠাকুর ছড়ায়, ছন্দে নিমন্ত্রণের চিঠি লিখতেন। সভার প্রতিবেদনের খসড়া লেখা ছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরোয়া’-য় চারটি আমন্ত্রণ লিপি উদ্ধার হয়েছে। একটি উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবেঃ

এতদ্বারায়
খামখেয়ালি সভাধিবেশন—
চৌঠা শ্রাবণ —শুভ সোমবার —
জোড়াসাঁকো গলি ৬ নম্বার —
ঠিক ঘড়ি ধরা রাত সাড়ে সাত
সত্যপ্রসাদ করে জোড় হাত। 
যিনি রাজি আর যিনি গররাজি
অনুগ্রহ করে লিখে দিন আজই।

প্রত্যেক সভ্যের বাড়িতে মাসে একবার করে সভা বসতো। প্রত্যেক অধিবেশনের শেষে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে বিবরণী লিখে রাখতেন। সেই সব মজলিশে খাওয়া দাওয়াও পরিকল্পনা মাফিক হতো। ‘ফরাসে বসিয়া প্লেটপত্রে মোগলাই খানা’, ‘টেবিলে জলপান’, ‘সাদাসিদে বাংলা জলপান’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণপত্রগুলি লিখতেন একটি স্লেটে। সেই স্লেট নিয়ে সকলের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নিমন্ত্রণ করা হত। এই সভার জন্য রবীন্দ্রনাথ নতুন অনেক লেখা লিখেছেন। ‘বিনি পয়সার ভোজ’, ‘বৈকুন্ঠের খাতা’র মতো নাটকও লিখেছিলেন। ‘বৈকুন্ঠের খাতা’য়  খামখেয়ালির সদস্যদের অভিনয় দেখে গিরিশ ঘোষ বলেছিলেন, এরকম অ্যাক্টর সব যদি আমার হাতে পেতুম তবে আগুন ছিটিয়ে দিতে পারতুম। মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ এই সভায় কবিতার সঙ্গে পাখোয়াজ বাজাতেন। প্রত্যেক অধিবেশনের জন্য গান বাঁধতেন রবীন্দ্রনাথ। গাইতেন দরাজ গলায়।

একবার খামখেয়ালি সভার উদ্যোক্তা হলেন রবীন্দ্রনাথ। খাওয়ানোর দায়িত্বও তাঁর। রথীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সেবার তাঁদের বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছিল। মৃণালিনীদেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন মামুলি কিছুই থাকবে না। প্রত্যেকটি রান্না বিশিষ্ট হওয়া চাই। শুধু ফরমাশ নয়, রন্ধণকৌশলও বলতে শুরু করেছিলেন। আবার রান্নার পাত্র থেকে পরিবেশন, ঘর সাজানো সব মনোরম, শৈল্পিক হতে হবে। বলেন্দ্রনাথ জয়পুর থেকে শ্বেতপাথরের বাসন আনিয়েছিলেন। মাটিতে বসে খাওয়ার সময় সকলের সামনে থাকবে শ্বেতপাথরের জলচৌকি। মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় বানানো হয়েছিল গ্রামের দৃশ্য। কৃষ্ণনগর থেকে কারিগর আনিয়ে খড়ের ঘর, ছোটো ছোটো মানুষ, গরু, ছাগল বানিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। এমন খামখেয়ালি সদস্যদের জন্যই খামখেয়ালি সভা। তবে সাহিত্য আলোচনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সমস্যার আলোচনাও হত খামখেয়ালি সভায়। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ — এই তিন গায়কের গান শোনা যেত সভায়। দ্বিজেন্দ্রলাল বেশিরভাগ সময় গাইতেন হাসির গান। সকলে কোরাসে যোগ দিতেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোরাসের নেতা। দ্বিজেন্দ্রলাল যখন গাইতেন, ‘হোতে পাত্তেম আমি একজন মস্ত বড় বীর’, রবীন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে বলতেন, ‘বটেই তো, তা বটেই তো।’ দ্বিজেন্দ্রলাল গাইতেন, ‘নন্দলাল একদা করিল ভীষণ পণ’, রবি ঠাকুর গেয়ে উঠতেন, ‘বাহারে নন্দ বাহারে নন্দলাল’। এমন অন্তরঙ্গতাও পরে বিরোধে বদলে যাবে। এ-ও এক খামখেয়াল।

এই সভাও বন্ধ হয়ে যায়। এক বিলেত ফিরত সদস্যের বাড়িতে সকলে সভা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর শীতল আতিথেয়তা সকলকে হতাশ করে। কোনোমতে সভা সেরে গভীর রাতে ফিরতি পথে খামখেয়ালি সভার জন্য কমিটি তৈরি হয়। এতটা শীতল খামখেয়াল রবীন্দ্রনাথকেও নিরুৎসাহ করে। এরপর রবীন্দ্রনাথ চলে যান শিলাইদহে। খামখেয়ালি সভার আসল খামখেয়ালি মানুষটির প্রত্যক্ষ উদ্যোগের অভাবে সত্যিই একদিন বন্ধ হয়ে যায় এই খামখেয়ালি সভা। 

শিল্পী মাত্রেই খেয়ালী, আর শিল্প মানেই খামখেয়ালের ফসল। এইসব সভা ঠাকুরবাড়ির সৃষ্টিশীল মনের প্রাণবন্ত প্রকাশ, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.