ঝুলিতে এত দিন একটিই গ্র্যান্ড স্ল্যাম ছিল। সবে দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে উঠেছিলেন। নোভাক জোকোভিচের টানা চার বার উইম্বলডন জয়ের রথ থামিয়ে সেন্টার কোর্টে নতুন চ্যাম্পিয়ন কার্লোস আলকারাজ। জোকোভিচের এ হেন প্রতিপক্ষকে নিয়েই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে টেনিস বিশ্ব।
স্বপ্ন দেখা শুরু বছর খানেক আগেই। তখনও একটিও গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনাল খেলেননি আলকারাজ। রজার ফেডেরার অবসর নিয়েছেন। রাফায়েল নাদাল চোটে জর্জরিত। সেই অর্থে পুরুষদের টেনিসে মহাতারকা বলতে জোকোভিচ একা। প্রায় দু’দশক ধরে তিন তারকার রুদ্ধশ্বাস লড়াই দেখে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা টেনিসপ্রেমীদের একাংশ মানিয়ে নিতে পারছিলেন না এই শূন্যতার সঙ্গে। এর পর কে? তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন-ই বা কে? ফেডেরার-নাদাল-জোকোভিচ উত্তর টেনিস বিশ্বকে এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত এক জনই দিচ্ছেন, তিনি আলকারাজ। উজ্জ্বলতম।
ট্রফির সংখ্যার বিচারে পেশাদার সার্কিটে এখনও দারুণ নজর কাড়া সাফল্য নেই। সবে দ্বিতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম, প্রথম উইম্বলডন জিতলেন। আসলে নজর কাড়ছে তাঁর টেনিস। ২০২২ সাল আলকারাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে টেনিস বিশ্বের। সব থেকে কম বয়সি খেলোয়াড় হিসাবে মায়ামি ওপেন, মাদ্রিদ ওপেন জিতেছেন। সব থেকে কম বয়সে এটিপি ক্রমতালিকায় এক নম্বর হয়েছেন। সব থেকে কম বয়সি খেলোয়াড় হিসাবে এক নম্বরে থেকে বছর শেষ করেছেন। শুধু আলকারাজ নন। ইয়ানিক সিনার, ক্যাসপার রুড, হোলগার রুনের মতো খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। আছেন বয়সে চার-পাঁচ বছরের বড় আলেকজান্ডার জেরেভ, দানিল মেদভেদেভ, স্টেফানো চিচিপাস, আন্দ্রে রুবলেভেরা। কিন্তু আলকারাজের মতো ধারাবাহিকতা নেই কারও।
এ বারের উইম্বলডনের আগেই এটিপি ক্রমতালিকায় শীর্ষে উঠেছেন আলকারাজ। প্রথম বার এক নম্বর হয়েছিলেন ১৯ বছর ৪ মাস বয়সে। এটিপি-র বিচারে গত বছর তিনি জিতেছেন নতুন উঠে আসা খেলোয়াড়, বছরের সেরা খেলোয়াড় এবং সব থেকে উন্নতি করা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। যিনি নতুন এসেছেন তিনিই সেরা। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া স্পেনের তরুণের হাত ধরেই কি শুরু হল পুরুষদের টেনিসের নতুন যুগ?
আলকারাজ এখন বিশ্বের এক নম্বর। আর নাদাল স্পেনের ১০ নম্বর! দক্ষিণ-পূর্ব স্পেনে এল পালমারে নামের একটি গ্রামে জন্ম আলকারাজের। পাহাড় ঘেরা যে গ্রামের বাসিন্দারা এক সময় শিকার করে দিন যাপন করতেন। না, হাজার বছর আগের কথা নয়। ঠিক ১০০ বছর আগে গ্রামবাসীরা তৈরি করেছিলেন একটি ক্লাব। নাম রিয়াল সোসিয়েদাদ ক্লাব ডে ক্যাম্পো। স্থানীয় শিকারিদের জন্যই তৈরি হয়েছিল এই ক্লাব। যেখানে গিয়ে শিকারিরা পায়রা এবং অন্যান্য পাখি শিকার করতেন। সেই ক্লাবই পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠেছে টেনিস প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ক্লাবের টেনিস ডিরেক্টর ছিলেন আলকারাজের বাবা কার্লোস আলকারাজ গঞ্জালেস। বাবার হাত ধরেই ক্লাবে চলে যেতেন ছোট্ট আলকারাজ। টেনিস ডিরেক্টরের ছেলে হওয়ায় একটু আধটু খাতির, যত্নও পেতেন। সেই সুযোগের অপব্যবহার করেননি ২০ বছরের তরুণ। ছোট বয়সেই তাঁর মধ্যে বড় খেলোয়াড় হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছিলেন ক্লাবের কোচেরা।
শুরুটা তেমন ঝকঝকে ছিল না আলকারাজের। জুনিয়র পর্যায়ে আলকারাজের সেরা আইটিএফ র্যাঙ্কিং ছিল ২২। শরীরে শিকারির রক্ত থাকা আলকারাজ ২০২০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পেশাদার টেনিসে নাম লিখিয়ে ফেলেন। শিকারির কি আর বাগানে শিকার ধরে আশ মেটে! নেমে পড়েছিলেন রিয়ো ওপেনে। ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মূলপর্বে খেলেন। সেটাই তাঁর প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম প্রতিযোগিতা। প্রথম কয়েক বছর নিজেকে তৈরি করেছেন পেশাদার সার্কিটে ঘুরে। প্রথম খেতাব ২০২১ সালের ক্রোয়েশিয়া ওপেন। তার পর থেকে এগোচ্ছেন আলকারাজ। বাড়ছে ট্রফি শিকার। ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন শিকারি আলকারাজ।
বাবার সঙ্গে টেনিস খেলতে খেলতেই এক দিন চোখে পড়ে যান কোচ কিকো নাভারোর। আলকারাজের প্রথম কোচ বলেছেন, ‘‘খুব ছোট থেকেই নিখুঁত টেনিস খেলতে চাইত আলকারাজ। তখনই মনে হয়েছিল, ঠিকমতো খেললে এক দিন বিশ্বের একনম্বরও হতে পারে।’’ রত্ন চিনতে ভুল করেনি জহুরির চোখ। সেই চোখকে কখনও ফাঁকি দেননি আলকারাজও। গঞ্জালেসের ব্যবসায়ী বন্ধু অ্যালফ্রেডো সারিরা এক দম প্রথম থেকে দেখছেন আলকারাজকে। তিনি বলেছেন, ‘‘চার বছর বয়স থেকে টেনিস খেলছে আলকারাজ। ও যাতে ভাল খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে, সে জন্যই ক্লাবের টেনিস পরিকাঠামো ধীরে ধীরে ভাল করা হয়েছে। অনেক ছোট বয়সেই ওর প্রতিভা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’’ কী আছে রিয়াল সোসিয়েদাদ ক্লাব ডে ক্যাম্পোর টেনিস অ্যাকাডেমিতে? ১৩টি টেনিস কোর্ট, ৪টে প্যাডল কোর্ট, সুইমিং পুল, জিম, একটা বাস্কেটবল কোর্ট আর একটা ফুটবল মাঠ। পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় হওয়ার জন্য আলকারাজকে কখনও চাপ দেননি তাঁর বাবা। টেনিস শেখার জন্যও নয়। নিজের ইচ্ছাতেই এগিয়েছেন তিনি। ‘পাড়ার ক্লাবে’ টেনিস শেখা আলকারাজ পরে ভর্তি হন নাদালের অ্যাকাডেমিতে। রাফার কাছে শেখেননি কখনও। ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাবের মালিক তাঁর কাছে দ্রোণাচার্যের মতো, আলকারাজ তাঁর একলব্য (দ্রোণাচার্য কখনও একলব্যকে অস্ত্রবিদ্যা শেখাননি)।
বছর দুয়েক আগেও আলকারাজকে চিনত না টেনিস দুনিয়া। কোনও এটিপি প্রতিযোগিতার ফাইনালও খেলেননি। সেই আলকারাজকেই কোর্টে এখন সমঝে চলছেন জোকোভিচেরা। শেষ ২৪ মাসে বদলে গিয়েছে আলকারাজের দুনিয়া। এক ডজন ট্রফি জিতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন আধুনিক টেনিসে। ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচ পরবর্তী টেনিস দুনিয়ার রাজা হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন উল্কার গতিতে। সমকালীন অন্য খেলোয়াড়দের থেকে দক্ষতা, ধারাবাহিকতায় এগিয়ে অনেকটা। কিছুটা পিছিয়ে অভিজ্ঞতায়। সেই খামতি ঢেকে দিচ্ছে আলকারাজের পাওয়ার টেনিস।
আরও পড়ুন:
ভন্দ্রোসোভার জয়ে গ্যালারিতে কাঁদলেন এক জন, তাঁকেও অভিনন্দন জানাল উইম্বলডনের সেন্টার কোর্ট
এক দিন উইম্বলডন জিতবেনই, ‘জীবনের সব থেকে কষ্টের হারের’ পর কথা দিলেন জাবের
১৯ বছর বয়সে ইউএস ওপেন জিতবেন, কখনও ভাবেননি আলকারাজ নিজেই। গত বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর নিজের মুখে সে কথা বলেছিলেন। পেশাদার সার্কিটে ঘাসের কোর্টে মাত্র ১১টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে এ বারের উইম্বলডন খেলতে এসেছিলেন আলকারাজ। তবু নিজেকে খেতাব জয়ের দৌড়ে রাখতে সংকোচ করেননি। এতটাই আত্মবিশ্বাস। বলেছিলেন, ‘‘এই প্রতিযোগিতাটা আমি সত্যিই এক দিন না এক দিন জিততে চাই। হয়তো এ বছরেই।’’
ফেডেরার নেই। নাদালও। ৩৬ বছরের জোকোভিচ এখনই অবসরের কথা না ভাবলেও হয়তো আর দু’-তিন বছর খেলবেন। এখানেই প্রশ্ন, চ্যালেঞ্জারবিহীন সার্কিটে কতটা এগোতে পারবেন আলকারাজ? ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচেরা বার বার বলেছেন, তাঁরা এগিয়েছেন পরস্পরকে দেখে। অন্যের থেকে নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করেছেন ধারাবাহিক ভাবে। ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জ তাঁদের জেদ, খিদে বাড়িয়েছে। আখেরে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে টেনিস। আলকারাজের খিদে বাড়াবেন কে? চ্যালেঞ্জ জানাবেন কে? সিনার, রুড, রুন, জেরেভ, মেদভেদেভ, চিচিপাস, রুবলেভেরা আছেন। এল পালমারের শিকারি যুবক কি ভুলে যাবেন শিকার করতে? জুতসই শিকার না পেলে বাঘও নাকি অলস হয়ে যায়!