ভাঙড়ে গন্ডগোলের রাতে আরাবুলকে মেঝেতে বসিয়ে, ফোন কেড়ে শাসানি পুলিশের

পঞ্চায়েত ভোটের গণনা কেন্দ্রের বাইরে তখন মুহুর্মুহু বোমা আর গুলির শব্দ। ভিতরে দোতলার কন্ট্রোল রুমে মেঝের উপরে সস্ত্রীক বসে রয়েছেন শাসক দলের ডাকসাইটে নেতা। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁর ও দেহরক্ষীদের মোবাইল ফোনও। তাঁর উদ্দেশে অবিরাম ছুটে আসছে গালিগালাজ আর হুঁশিয়ারি। যার সারবত্তা, নিখোঁজ সহকর্মীদের খোঁজ পাওয়া না গেলে তাঁদের কপালে দুর্ভোগ আছে।

ভাঙড়-২ পঞ্চায়েতের অধীন কাঁঠালিয়া হাইস্কুলের দোতলার কন্ট্রোল রুমে এই ছবি মঙ্গলবার রাতের। মেঝের উপরে বসে আরাবুল ইসলাম। কার্যত তাঁকে ঘিরে ধরেছেন রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের বাহিনী ও র‌্যাফের কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, আরাবুলের কারণেই ভাঙড়ে এত অশান্তি হচ্ছে আর দুই পুলিশকর্মী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন। আরাবুলের ‘গড়’ হিসাবে পরিচিত পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। তার উপরে ভাঙড়ের মতো জায়গায় রাজ্য পুলিশের কর্মীদের একাংশ তাঁকে ঘেরাও করে মেঝেতে বসিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ঢঙে সহকর্মীদের খোঁজ নিচ্ছেন। এই ঘটনায় অপ্রস্তুত আরাবুল বৃহস্পতিবার বললেন, ‘‘পুলিশের ওই দুই কর্মীকে তো আমিই নিমকুড়িয়া থেকে উদ্ধার করিয়েছি। ওঁদের তো আইএসএফ তুলে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা রাজনীতির মানুষ। পুলিশ সুযোগ পেলেই অসম্মান করে। আমি দলকে সব ঘটনা জানিয়েছি। পুলিশ বেশি রকম বাড়াবাড়ি করেছে।’’

কী ঘটেছিল? সেই রাতে ওই কন্ট্রোল রুমে আটকে পড়া ভোটকর্মীরা জানাচ্ছেন, রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ স্ত্রীর সঙ্গে কন্ট্রোল রুমে এসে একটি বেঞ্চের উপরে বসেন আরাবুল। এক ভোটকর্মীর কথায়, ‘‘কন্ট্রোল রুমে গিয়েছিলাম খাবার নিতে। স্কুলের পিছনে তখন দুটো বোমা পড়েছে। ওই সময়ে আরাবুল তাঁর স্ত্রী ও নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে এসে বসেন। এর পরেই দেখি, ওঁর উদ্দেশে কয়েক জন আইএসএফ সমর্থক কন্ট্রোল রুমের বাইরে থেকে জানলা দিয়ে গালিগালাজ শুরু করেছেন।’’ এর খানিক বাদেই কন্ট্রোল রুমের পরিস্থিতি বদলে যায়। ওই ভোটকর্মীরা জানান, আইএসএফের লোকজন চলে যাওয়ার পরেই সেখানে সশস্ত্র পুলিশ ও র‌্যাফের সাত-আট জন কর্মী ঢুকে আরাবুলদের উপরে চড়াও হন। প্রাক্তন বিধায়ক ও তাঁর লোকজনকে তাঁরা জানান, তাঁদের দুই সহকর্মী দীর্ঘক্ষণ নিখোঁজ এবং তার জন্য আরাবুল ও তাঁর সঙ্গীরাই দায়ী। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্য পুলিশ বা বারুইপুর পুলিশ জেলার আধিকারিকেরা মন্তব্য করতে চাননি।

এক ভোটকর্মীর কথায়, ‘‘আরাবুলকে বেঞ্চ থেকে নামিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়। আর শাসানি দেওয়া শুরু হয়। ওই পুলিশকর্মীরা বিডিও-র খোঁজ করতে থাকেন আমাদের কাছে। আমাদের ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়।’’ ওই কর্মীরা জানান, ইতিমধ্যে ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার এক আধিকারিক কন্ট্রোল রুমে ঢুকে আরাবুলকে সামগ্রিক গোলমালের জন্য দায়ী করে নিখোঁজ পুলিশকর্মীদের খুঁজে বার করার ব্যবস্থা করতে বলেন। এক ভোটকর্মীর কথায়, ‘‘ওই পুলিশ আধিকারিক সাফ জানান, তিনি কারও পায়ে তেল দেন না। তাঁর সহকর্মীদের খোঁজ না মিললে আরাবুলদেরও রক্ষা নেই। যদিও ওই কর্মীদের তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করতে।’’ ওই বাহিনীর লোকজন এসে দফায় দফায় আরাবুলদের উপরে চাপ বাড়াতে থাকেন, নিখোঁজ সহকর্মীদের খোঁজ পেতে। এর মধ্যে সেখানে আইএসএফের এক সমর্থক ঢুকে আরাবুলদের উপরে গোলমালের দায় চাপাতে গেলে পুলিশের হাতে চড়-থাপ্পড় খেয়ে যান। খানিক বাদেই স্কুল অন্ধকার হয়ে যায়। আরাবুল ও বাকি ভোটকর্মী-সহ সবাইকে ওই ঘরে তালাবন্ধ করে চলে যায় পুলিশ। ভোর সাড়ে ৪টের পরে অবশেষে দুই পুলিশকর্মীর খোঁজ মেলে। বিডিও কার্তিক রায়, পুলিশ ও আধা সেনাদের প্রহরায় কন্ট্রোল রুম থেকে আরাবুল-সহ ভোটকর্মীরা বেরিয়ে আসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.