এই বিজয়াদশমীর আগে গত প্রায় এক বছর সময় গুরুনানক দেবের আবির্ভাবের ৫৫০তম বর্ষ এবং স্বর্গীয় গান্ধীজীর জন্মের সার্ধশত বর্ষের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই উপলক্ষ্যে পালনীয় কার্যক্রম আরও কিছুদিন চলবে। কিন্তু গত বছরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বছরটিকে আমাদের জন্য আরও স্মরণীয় করে দিয়েছে।
গত মে মাসে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছে। এই নির্বাচন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ভারতবর্ষের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ বিশাল দেশে নির্বাচন। কীভাবে সঠিক সময়ে এবং ব্যবস্থিত ভাবে সম্পন্ন হয়, তা দেখা বিশ্ববাসীর আকর্ষণের প্রথম কারণ ছিল। সেরকমই ২০১৪-তে আসা পরিবর্তন শুধু ২০১৪-র আগেকার সরকারের প্রতি মোহভঙ্গ থেকে উৎপন্ন কোনও নেতিবাচক রাজনৈতিক জোয়ারের পরিণাম নয়, বরং বিশেষ দিশায় যাওয়ার জন্য জনগণ মনঃস্থির করেছে, ২০১৯-এর নির্বাচনে তাও দেখার ছিল। বিশ্বের দৃষ্টি ছিল সেদিকেও। জনগণ তাদের দৃঢ় রায় ব্যক্ত করেছে। ভারতের গণতন্ত্র যে বিদেশ থেকে আমদানি করা নয়, বরং জনমানসে শত শত। বছর ধরে চলে আসা পরম্পরা ও স্বাধীনোত্তর কালে অর্জিত উপলব্ধি এবং তার পরিণাম স্বরূপ গণতন্ত্র বজায় রাখা এবং তাকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করার বিষয়ে জনগণ যে মানসিক ভাবে তৈরি, তা সকলেই বুঝতে পেরেছেন।নতুন সরকারকে আরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা-সহ পুনরায় নির্বাচিত করে জনগণ তার বিগত কার্যকলাপের প্রতি সম্মতি এবং আগামীদিনের জন্য আরও অনেক প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে।
জন ভাবনাকে সম্মান করে, সেই প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করে, তাদের ইচ্ছা পূরণ করার সাহস যে এই দ্বিতীয় বার নির্বাচিত সরকারের আছে, তা আরও একবার সরকারের ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মজ্জায় এই ধরনের কাজ করার ভাবনা আগে থেকেই রয়েছে। কিন্তু এরা সুকৌশলে সংসদের উভয় কক্ষে ভিন্ন মতাবলম্বী কয়েকটি দলের সমর্থন নিয়ে জনসাধারণের ভাবনার অনুরূপ এবং দৃঢ় যুক্তির সঙ্গে এই যে কাজ হয়েছে, তার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সমেত শাসকদল ও এই জন ভাবনাকে সমর্থনকারী অন্য দলগুলিও অভিনন্দনের যোগ্য।
এই উদ্যোগ তখনই সম্পূর্ণ হবে যখন ৩৭০ ধারার প্রভাবে করতে না পারা উচিত কাজগুলো সম্পন্ন হবে। সেটির প্রভাবে চলে আসা অন্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। দেশভক্ত ও হিন্দু হিসেবে থাকার সাপেক্ষে সেখান থেকে অন্যায় ভাবে বিতাড়িত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসন বাস্তবায়িত হবে। কাশ্মীরের অধিবাসীরা অনেক অধিকার, যা থেকে তারা এখনো বঞ্চিত, তা পাবে এবং উপত্যকার বন্ধুদের মনে যে ভুল আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে যে ৩৭০ ধারা বাতিলের ফলে তাদের জমি, চাকরি ইত্যাদির উপর সংকট দেখা দেবে, তা দূর হবে এবং তারা আত্মীয় ভাব নিয়ে অবশিষ্ট ভারতের জনগণের সঙ্গে দেশের উন্নতিতে নিজেদের দায়িত্ব সমান ভাবে পালন করবে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে নিজেদের প্রতিভা দিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের প্রশংসা ও সহানুভূতি লাভ করে আমাদের বিজ্ঞানীরা চাঁদের অদেখা দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান ‘বিক্রমকে পাঠিয়েছে। যদিও প্রত্যাশামতো সাফল্য আসেনি, কিন্তু প্রথম প্রচেষ্টাতেই এতটা করা কিছু কম নয়। আমাদের বিজ্ঞানীদের এই অভিযানের ফলে আমাদের দেশের বৌদ্ধিক প্রতিভা ও বিজ্ঞান চেতনা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে সংকল্প পূর্ণ করার প্রতি সারা বিশ্ব সম্মান দেখিয়েছে। জনগণের পরিপক্ক বুদ্ধি ও কাজ, দেশে স্বাভিমানের জাগরণ, সরকারের দৃঢ় সংকল্প এবং তার সঙ্গেই আমাদের বিজ্ঞানীদের সামর্থ্যের ধারণা— এই সব সুখানুভবের জন্য বিগত বছরটি আমাদের কাছে চিরকাল স্মরণীয় থাকবে।
কিন্তু এই সুখের পরিবেশে অলস হয়ে নিজেদের সচেতনতা ও উৎসাহ ভুলে, সবকিছু সরকারের উপর ছেড়ে দিয়ে, নিষ্ক্রিয় হয়ে বিলাসিতা ও স্বার্থে মগ্ন হলে চলবে না। যে দিশাতে আমরা চলা শুরু করেছি, সেই অন্তিম লক্ষ্য ‘পরম বৈভবশালী ভারত’ এখনো দূরে রয়েছে। পথের কাঠিন্য, বাধা এবং আমাদের প্রতিহত করার ইচ্ছা পোষণকারী শক্তির কার্যকলাপ এখনো শেষ হয়নি। আমাদের সামনে কিছু সংকট আছে যা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে। কিছু প্রশ্ন আছে যার উত্তর আমাদের দিতে হবে এবং কিছু সমস্যা আছে যার সমাধান করতে হবে।
সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দেশের সুরক্ষার স্থিতি, সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি, আমাদের সরকারের সুরক্ষা নীতি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কুশলী অবস্থান থেকে প্রমাণিত যে এ বিষয়ে আমরা সজাগ ও আশ্বস্ত। আমাদের স্থল ও জল সীমান্তে সতর্কতা আগে থেকেই আছে। শুধু স্থল সীমান্তরক্ষী ও সীমা চৌকির সংখ্যা এবং জল সীমান্তে বিশেষভাবে দ্বীপগুলির উপর সতর্কতা আরও বাড়াতে হবে। দেশের ভিতর সন্ত্রাসবাদী হিংসা কম হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের আত্মসমর্পণের সংখ্যাও বেড়েছে।
ব্যক্তি জীবনে বা বিশ্বে সংকটের পরিস্থিতি সবসময়ই থাকে। কিছু সংকট সামনে দেখা যায়। কিছু সংকট পরবর্তী সময়ে সামনে আসে। নিজের শরীর মন বুদ্ধি যত সজাগ, সুস্থ ও প্রতিকারক্ষম থাকবে ততই সংকট থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু মানুষের মনে সংকটের ভয় থেকেই যায়। অনেক ধরনের সংকটের উপাদান আমাদের শরীরের মধ্যেই বাস করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলেই সেগুলি মাথাচাড়া দেয়, না হলে কোনো উৎপাত হয় না।
আমরা জানি যে, বিগত কিছু বছরে ভারতের চিন্তাধারার দিশায় এক পরিবর্তন এসেছে। সেটি পছন্দ না করার মতো ব্যক্তি বিশ্বেও আছে, আর ভারতেও আছে। ভারতের অগ্রগতি যাদের স্বার্থের পক্ষে হানিকর সেই সব শক্তি ভারতকে দৃঢ় ও শক্তিশালী হতে দিতে চায় না। দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতের সমাজের একাত্মতা, সততা ও সমরসতার স্থিতি যেরকম হওয়া উচিত বর্তমানে সেইরকম নয়। এর লাভ উঠিয়ে সেসব শক্তি যে অপকর্ম চালায় তা আমরা দেখছি। জাতপাত, মত-পথ, ভাষা, প্রান্ত ইত্যাদির ভিত্তিতে পরস্পরকে পৃথক করা; পারস্পরিক মতভেদকে উস্কে দিয়ে আগে থেকেই চলে আসা বিভদের ফাটল আরও বাড়িয়ে তোলা, মনগড়া কৃত্রিম পরিচয়ের ভিত্তিতে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে এই দেশের অভিন্ন সামাজিক ধারায় ভিন্ন ভিন্ন পরস্পর-বিরোধী প্রবাহ উৎপন্ন করার চেষ্টা চলছে। সজাগ থেকে এসব কুচক্রকে শনাক্ত করে বৌদ্ধিক ও সামাজিক স্তরে তার প্রতিকার করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনে কার্যরত ব্যক্তিদের দ্বারা সৎ উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত নীতি, প্রচারিত বক্তব্য এবং গৃহীত সিদ্ধান্তকে বিকৃত করে বা ভুল মানে করে প্রচার করে নিজেদের ঘৃণ্য উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য এসব শক্তি উপদ্রব করে। তার জন্য সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। এরকম সমস্ত গতিবিধির মাধ্যমে কোথাও না কোথাও দেশের আইন, নাগরিক অনুশাসন ইত্যাদির প্রতি বিতৃষ্ণা উৎপন্ন করার গোপন অথবা প্রকাশ্য প্রয়াস চলতে থাকে। সব স্তরে এর ভালোমতো প্রতিকার হওয়া উচিত।
আজকাল সংবাদপত্রে এরকম খবর প্রায়ই আসে যে আমাদের এই সমাজের একটি গোষ্ঠী অন্য এক গোষ্ঠীর লোককে আক্রমণ করে তাকে গণহিংসার বলি করেছে। এরকম ঘটনা শুধু এক পক্ষের নয়। উভয় পক্ষের কাছ থেকেই এই রকম ঘটনা শোনা যায় অর্থাৎ অভিযোগ পালটা-অভিযোগ চলতেই থাকে। কিছু ঘটনা যে জেনে বুঝে সংঘঠিত ও কিছু ঘটনা যে অসংলগ্ন ভাবে প্রকাশিত, এ ব্যাপারটাও সামনে এসেছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও আইনি ব্যবস্থার সীমা লঙ্ঘন করে হিংসক প্রবৃত্তি যে সমাজে পারস্পরিক সম্বন্ধ নষ্ট করে নিজেদের দাপট দেখাচ্ছে এটা মানতেই হবে। এই প্রকৃতি আমাদের দেশের পরম্পরা নয় এবং আমাদের সংবিধান সম্মতও নয়। যতই মতভেদ হোক, যতই উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটুক, আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে, পুলিশি ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে ও বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থা রেখে আমাদের চলতে হবে। স্বাধীন দেশের নাগরিকের এটাই কর্তব্য। এরকম ঘটনায় লিপ্ত লোকেদের সঙ্ কখনোই সমর্থন করেনি এবংসঙ্ এরকম ঘটনার ঘোর বিরোধী। এরকম ঘটনা যাতে না ঘটে তা জন্য স্বয়ংসেবকেরা সচেষ্ট থাকে। কিন্তু এরকম ঘটনা যা আমাদের পরম্পরা নয়, ‘লিঞ্চিং’ নাম দিয়ে তাকে পরম্পরা রূপে দেখিয়ে সম্পূর্ণ দেশ ও হিন্দু সমাজকে সর্বত্র বদনাম করার চেষ্টা, তথাকথিত সংখ্যালঘুদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টার যে ষড়যন্ত্র চলছে এটা আমাদের বুঝতে হবে। উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভাষা ও কাজ সকলকেই এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য ওকালতির আড়ালে পরস্পরকে লড়িয়ে দিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে উদ্যোগী তথাকথিত নেতাদের প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এরকম ঘটনায় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মতো আইনি ব্যবস্থা এই দেশে রয়েছে। সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার করতে হবে।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক সদ্ভাব, বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যে সম্ভব, সমরসতা ও সহযোগিতা এবং আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে নিজেদের মতের বহিঃপ্রকাশ ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়ার অনুশাসন পালন আজকের পরিস্থিতিতে একান্তই প্রয়োজন। এই ধরনের মত বিনিময়, সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়াস সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা করে চলেছে। তার পরেও কিছু নির্ণয় ন্যায়ালয়ের মাধ্যমেই হয়।নির্ণয় যাই হোক, দায়িত্বশীল নাগরিকদের ভাষা ও কাজ এমনই হবে যাতে কোনোভাবেই পারস্পরিক সদ্ভাব ক্ষুন্ন না হয়। এই কাজ কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের নয়, এটা সকলের দায়িত্ব। সকলের তা পালন করা উচিত এবং নিজেকে দিয়েই শুরু করতে হবে।
বিশ্বের আর্থিক মন্দার ক্ষতিকর প্রভাব সর্বত্র কিছু পড়ে। আমেরিকা ও চীনের মধ্যেকার আর্থিক রেষারেষির পরিণাম ভারত সমেত অন্য দেশগুলোকেও ভুগতে হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কিছু উপায় সরকার গত দেড়মাসে অবলম্বন করেছে। জনগণের মঙ্গলের প্রতি সরকারের সংবেদনা ও তার সক্রিয়তার পরিচয় এর থেকে অবশ্যই পওয়া যায়। এই তথাকথিত মন্দাবস্থা থেকে আমরা অবশ্যই বেরিয়ে আসব, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বদের অবশ্যই সেই সামর্থ্য আছে। আর্থিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য সরকার প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি দিতে ও শিল্প বাণিজ্যের বেসরকারিকরণে বাধ্য হচ্ছে। তবে সরকারের কিছু লোককল্যাণকর নীতি ও কার্যক্রম নীচের স্তরে লাগু করার ক্ষেত্রে অধিক তৎপরতা, ক্ষমতা অর্থাৎ অনাবশ্যক কঠোরতা লাঘব করলে অনেক কিছু ঠিক হতে পারে।
পরিস্থিতির চাপের কারণে ব্যবস্থা গ্রহণের সময় স্বদেশি ভাবনা বিস্মৃত হলেও ক্ষতি হতে পারে। দৈনন্দিন জীবনে দেশভক্তির অভিব্যক্তিকেই স্বর্গীয় দত্তোপন্ত ঠেংড়িজী ‘স্বদেশি’ মনে করতেন। স্বর্গীয় বিনোবা ভাবেজী এর অর্থ ‘স্বাবলম্বন ও অহিংসা করেছেন। সমস্ত ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও সকলের উপার্জনের ব্যবস্থা করতে সক্ষম শক্তিই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, বাড়াতে পারে এবং স্বয়ং সুরক্ষিত থেকে বিশ্বমানবতাকেও এক সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দিতে পারে। আর্থিক পরিস্থিতি অনুসারে যদি কোনো ঘোরালো দূরের পথও বাছতে হয় তবুও লক্ষ্য তো স্বসামর্থ্য তৈরি করে বাধ্যবাধকতা থেকে চিরকালের জন্য বেরিয়ে আসাই হওয়া উচিত।
কিন্তু সাময়িক সংকট অর্থাৎ বিশ্বজোড়া আর্থিক উত্থান-পতনের পরিমাণ আমাদের অর্থ ব্যবস্থার উপর যতটা সম্ভব কম হওয়ার জন্য আমাদের একেবারে গোড়ায় গিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের নিজস্ব দৃষ্টি নিয়ে, আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে তার কথা মনে রেখে আমাদের জনগণের স্বরূপ ও পরিবেশ মনে রেখে, আমাদের নিজস্ব সম্পদ ও জনগণের কথা চিন্তা করে, আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে সফল করতে সক্ষম আর্থিক দৃষ্টিকে সামনে রেখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিশ্বে প্রচলিত আর্থিক মতবাদ অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। সেগুলো অনেক দিক থেকে অসম্পূর্ণ একথা বহু অর্থনীতিবিদ বলছেন। এরকম অবস্থায় যতটা সম্ভব কম শক্তি ব্যবহার করে যতটা সম্ভব বেশি উপার্জন দিতে সক্ষম পরিবেশের পক্ষে উপকারী, আমাদেরকে সব বিষয়ে স্বনির্ভর করতে সক্ষম এবং নিজের ক্ষমতা বলে সারা বিশ্বের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে পারে এরকম সামর্থ্য আমাদের মধ্যে জাগাতে পারে—এরকম আর্থিক দৃষ্টি, নীতি ও ব্যবস্থা নির্মাণ করার দিশায় আমাদের এগোতেই হবে।
স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই ‘স্ব’-এর চিন্তা করার জন্য আমরা কম পড়ে যাচ্ছি। এর মূলে, পরাধীনতার সময় যোজনাবদ্ধ ভাবে আমাদের দাস তৈরি করার জন্য যে শিক্ষার প্রচলন করা হয়েছিল তা স্বাধীনতার পরেও আমরা বলবৎ রেখেছি। আমাদের নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থার গঠনও ভারতীয় দৃষ্টিতে করতে হবে। বিশ্বে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনা করলে ‘স্ব’-ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থাই যে সেই সব দেশের শিক্ষায় উন্নতির কারণ, তা স্পষ্ট হয়। স্বভাষা, স্বভূষা, স্বসংস্কৃতির সম্যক পরিচয় অর্থাৎ সেই বিষয়ে গৌরব প্রদানকারী কালোপযোগী, তর্কশুদ্ধ, সত্যনিষ্ঠ, কর্তব্যবোধ এবং বিশ্বের প্রতি আত্মীয়তার দৃষ্টিকোণ ও জীবের প্রতি করুণা ভাব প্রদানকারী শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের চাই। পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সব কিছুরই আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু কাঠামোগত পরিবর্তনে কাজ হবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে এই সব বিষয়ের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশে চলে আসা পারিবারিক সংস্কারের স্থলন এবং সামাজিক জীবনে মূল্যবোধ বর্জিত আচরণ—খুব বড় সমস্যা সৃষ্টির কারণ। যে দেশে ‘মাতৃবৎ পদারেষু’র ভাবনা ছিল, মহিলাদের সম্মান রক্ষার জন্য রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যিক সংগ্রাম হয়েছিল, আত্মসম্মান রক্ষার জন্য জহরব্রতের মতো বলিদান হয়েছিল, সেই দেশে আজ মহিলারা না সমাজে, না পরিবারে কোথাও সুরক্ষিত নয়। সেখানে নানা ধরনের ইঙ্গিতবাহী ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের পক্ষে লজ্জাকর। আমাদের মাতৃশক্তিকে প্রবুদ্ধ, স্বাবলম্বী ও আত্মরক্ষায় সক্ষম করে তুলতে হবেই। মহিলাদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদের সংস্কৃতির পবিত্রতা ও শালীনতার সংস্কার অবশ্যই যুক্ত করতে হবে।
আমরা সবাই জানি যে, বাল্য বয়স থেকেই বাড়ির পরিবেশে এই শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু আজকের ‘অতি ছোটো পরিবারে তার একান্তই অভাব। এর আরও এক ভয়ংকর লক্ষণ হলো নবীন প্রজন্মে মধ্যে ক্রমবর্ধমান মাদকাসক্তি। এক সময় চীনের মতো সাংস্কৃতিক ভাবে সমৃদ্ধ দেশের তরুণদের নেশাগ্রস্ত করে বিদেশি শক্তি তাদের নিঃস্ব করে দিয়েছিল। এই ধরনের নেশায় আসক্ত না হওয়ার, সচ্চরিত্রের প্রতি আগ্রহ ও মোহগ্রস্ত না হয়ে, এর বিপদ থেকে দূরে থাকার দৃঢ় মানসিকতা যদি পরিবারে তৈরি না হয়, তবে নেশার প্রকোপ ঠেকানো খুবই কঠিন হবে। এই দৃষ্টিতে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে সকল অভিভাবকের সজাগ ও সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
সমাজে সর্বত্র অনুভূত আর্থিক ভ্রষ্টাচার ও চরিত্রভ্রষ্ট আচরণ মূলত এই সংস্কারহীনতার কারণেই উৎপন্ন হয়। মাঝে মধ্যে একে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন তৈরি হয়, কতিপয় ভ্রষ্টাচারীকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়। কিন্তু উপরের এই স্বচ্ছ ও পরিষ্কার স্তরের নীচে সাধারণ স্তরে দুর্নীতি চলতেই থাকে। আর কোথাও কোথাও তারা এই সব উপায়কেই আশ্রয় করে রসেবশেই আছে, এরকম দেখা যায়। সৎ ব্যক্তি এসব কড়া আইন পালনের জাঁতাকলে পড়ে ছটপট করে, আর যাদের আইন ও লাজ-লজ্জার কোনও ভ্রক্ষেপ নেই, এরকম নির্লজ্জ ও উদ্ধত লোকেরা এই ব্যবস্থাকে ধোঁকা দিয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে। এটা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়। বিনা শ্রমে বা কম শ্রমে ও বিনা যোগ্যতায় অধিক পাওয়ার লালসা আমাদের মনে বসে গিয়েছে। এটি এরকম ভ্রষ্ট আচরণের মূল কারণ। সামাজিক পরিবেশে, পরিবারে সব ধরনের প্রবচন ও নিজের আচরণের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এই পরিস্থিতিকে পাল্টানো, এই দেশের স্বাস্থ্য ও সুব্যবস্থার জন্য অনিবার্য কর্তব্য।
সমাজে প্রবচন বা সমাজে পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিক লক্ষ্য নিয়ে শুধু মুখরোচক ও শিহরণ জাগানো বিষয় উপস্থাপনের মোহ থেকে বেরিয়ে, যদি মাধ্যমগুলিও এই পরিবেশ সৃষ্টির কাজে যুক্ত হয়, তবে এই কাজ আরও গতি পেতে পারে।
আমাদের সমাজের ভিতরকার পরিবেশ, যেরকম আমরা সবাই সজাগ হয়ে সেই পরিবেশ সুস্থ রাখার চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পৃথকভাবে চিহ্নিত করি, সেরকমই সম্পূর্ণ বিশ্বের বাহ্যিক পরিবেশের সমস্যা মানব সমাজের ব্যাপক মনোযোগের দাবি করছে। পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য বড়ো নীতিগত উপায়ের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি তো সব দেশেরই পরিবেশ নীতিতে গুরুত্বও এই দিশাতে পরিণামদায়ক হতে পারে। সঙ্রে স্বয়ংসেবকেরা এই ক্ষেত্রে এরকম অনেক কাজ আগে থেকেই করছে। তাদের এই সমস্ত প্রচেষ্টাকে সুব্যবস্থিত রূপ দিয়ে, সামাজিক গতিবিধি হিসাবে আরও এগিয়ে যাওয়ার কাজও পরিবেশ গতিবিধি’ নামে শুরু হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ গত ৯ দশক ধরে সমাজে একাত্মতা, সম্ভাবনা, সদাচরণ ও সদ্ব্যবহার এবং এই ভাবনা নিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি স্পষ্ট দৃষ্টি ও শ্রদ্ধা উৎপন্নের কাজ করে আসছে। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের সেবা ভাবনা ও সমর্পণের বিষয়ে দেশে সর্বত্র বিশ্বাস জেগেছে, এরকম মনে হয়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সঙ্ঘের সংস্পর্শে যাঁরা আসেননি তাঁদের মধ্যে সঙ্ঘের প্রতি অবিশ্বাস, ভয় ও শত্রুতা তৈরির চেষ্টা করা হয়। সদ্য হিন্দু সমাজের সংগঠন করে এর অর্থ যে নিজেকে হিন্দু বলে না এমন শ্রেণী, বিশেষভাবে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন— এরকম নিতান্তই অসত্য ও অবান্তর প্রচার চালানো হয়। হিন্দু সমাজ, হিন্দুত্বের সম্বন্ধে অনেক প্রমাণহীন, বিকৃত অভিযোগ এনে তাদেরকেও বদনাম করার চেষ্টা করা হয়। এসব কুচক্রের পিছনে আমাদের সমাজে নিরন্তর বিভাজন হতে থাকুক এবং সেটার ব্যবহার নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হোক, এই ভাবনা কাজ করে। বিষয়টি এতটাই স্পষ্ট যে জেনে-বুঝে চোখ বন্ধ করে রাখা ব্যক্তিই একমাত্র তা বুঝতে পারেন না।
আমাদের রাষ্ট্রের পরিচয় সম্পর্কে, আমাদের সকলের সামগ্রিক পরিচয় সম্বন্ধে, আমাদের রাষ্ট্রের স্বভাবের পরিচয় সম্পর্কে, আমাদের সকলের সামগ্রিক পরিচয় সম্বন্ধে, আমাদের রাষ্ট্রের স্বভাবের পরিচয় সম্পর্কে সঙ্রে স্পষ্ট দৃষ্টি ও ঘোষণা রয়েছে। সঙ্ঘ বিশ্বাস করে, ভারত হিন্দুস্থান, হিন্দুরাষ্ট্র। সঙ্রে দৃষ্টিতে হিন্দু শব্দ শুধু যাঁরা নিজেদেরকে হিন্দু বলে তাদের জন্য নয়। যাঁরা ভারতের, যাঁরা ভারতীয় পূর্বপুরুষের বংশধর ও সব ধরনের বিভিন্নতাকে স্বীকার, সম্মান ও স্বাগত জানিয়ে পরস্পর মিলেমিশে দেশের বৈভব ও জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত হন তারা সবাই ভারতীয় হিন্দু। তাদের উপাসনাপদ্ধতি, ভাষা, পানাহার, রীতিনীতি, বাসস্থান যাই হোক না কেন তাতে কোনও পার্থক্য হয় না। ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ও সমাজ নির্ভীক হয়। এরকম ক্ষমতাসম্পন্ন লোকেরা চরিত্র সম্পন্ন হলে তারা অন্যকে ভয় দেখায় না। দুর্বল লোকেরাই নিজেদের সুরক্ষা হীনতার ভয়ের কারণে অন্যদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। সদ্য সম্পূর্ণ হিন্দু সমাজকে এরকম বল ও চরিত্র সম্পন্ন এবং সত্তাবে তৈরি করবে, যারা অন্যকে ভয় পাবে না, অন্যকে ভয় দেখাবে না, বরং দুর্বল ও অসহায় লোকেদের রক্ষা করবে।
এই হিন্দু শব্দের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা আসলে তাকে একটি সম্প্রদায়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ করার কল্পনা যা ইংরেজদের সময় থেকে আমাদের বুদ্ধি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই শব্দ অস্বীকার করে এমন শ্রেণীও সমাজে রয়েছে। তারা নিজেদের জন্য ভারতীয় শব্দ প্রয়োগ করেন। ভারতীয় স্বভাব, ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে চলা সভ্যতাগুলিকে কিছু মানুষ ইংরেজিতে ‘ইন্ডিক’ শব্দে সম্মোধন। করেন। যারা হিন্দু শব্দকে ভয় বা ভ্রমবশত অস্বীকার করে, তাদের জন্য সঙ্ঘের কাছে এই শব্দের বিকল্প ব্যবহার স্বীকার্য। শব্দ পৃথক হলে, পন্থ সম্প্রদায় ভিন্ন হলে, পানাহার, রীতিনীতি ভিন্ন হলে, বসবাসের স্থান ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায়, প্রান্ত বা ভাষা ভিন্ন হলে আমরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীকে পরস্পর পৃথক মনে করি না। এদের সকলকে আপন মনে করেই সঙ্ঘ কাজ করে। আমাদের এই আপনত্ব, যুক্ত করার ভাবনাই রাষ্ট্রভাবনা। সেটাই হিন্দুত্ব। আমাদের এই প্রাচীন। রাষ্ট্র কালোপযোগী, পরম বৈভব সম্পন্ন রূপ বাস্তবে সাকার করার লক্ষ্য, এর ধর্মপ্রাণ প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সংবর্ধনই এই আপনত্বের কেন্দ্র ও লক্ষ্য।
ভারতকে বিশ্বের একান্তভাবে প্রয়োজন। ভারতকে নিজের প্রকৃতি, সংস্কৃতির সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর অবশ্যই দাঁড়াতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র সম্বন্ধে স্পষ্ট কল্পনা ও গৌরবের ভাব মনে নিয়ে সমাজের সর্বত্র সদ্ভাব, সদাচার ও সমরসতার ভাবনা সুদৃঢ় করা প্রয়োজন। এইসব প্রচেষ্টায় সঙ্রে স্বয়ংসেবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এবং থাকবে। এর জন্য উপযোগী অনেক যোজনাকে যশস্বী করার জন্য সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা সচেষ্ট। প্রত্যেক স্বয়ংসেবককেই সময়ের আহ্বান স্বীকার করে কাজ করতে হবে। কিন্তু এই সময়ের চাহিদা। তখনই সময় মতো পূরণ হবে যখন আমরা এই কাজের দায়িত্ব কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের উপর দিয়ে, স্বয়ং দূর থেকে দেখার স্বভাব ত্যাগ করব। রাষ্ট্রের উন্নতি, সমাজের সমস্যার সমাধান ও সংকটের উপশম করার কাজ অন্যের উপর চাপানো যায় না। মাঝে মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ অবশ্যই কেউ-না-কেউ করবেন, কিন্তু যতদিন না জাগ্রত জনগণ, স্পষ্ট দৃষ্টি, নিঃস্বার্থ প্রকৃত পরিশ্রম ও দুর্ভেদ্য একতার সঙ্গে বজ্রশক্তি সম্পন্ন হয়ে এরকম প্রয়াসে স্বয়ং লিপ্ত হয়, ততদিন সম্পূর্ণ ও চিরস্থায়ী সাফল্য অর্জন সম্ভব হবে না।
এই কাজের জন্য সমাজে পরিবেশ সৃষ্টিতে কার্যকর্তা নির্মাণের কাজ সঙ্ করে চলেছে। সেই কার্যকর্তাদের দ্বারা সমাজে চলা সমস্ত কার্যকলাপ ও তার পরিণাম আজ এটা প্রমাণ করছে যে, আমাদের আত্মীয়-পরিজন, আমাদের এই দেশ তথা বিশ্বকে সুখী করার এটাই সঠিক পথ। আপনাদের সকলের প্রতি এই আহ্বান যে সাম্প্রতিক সময়ের চাহিদাকে ভালো ভাবে আত্মস্থ করে আমরা সবাই যেন এই সুন্দর ও পবিত্র কর্মের সহযোগী হই।
“যুগ পরিবর্তন কী বেলা মে হম সব মিলকর সাথ চলেঁ
দেশধর্ম কী রক্ষা কে হিত সহতে সব আঘাত চলেঁ
মিলকর সাথ চলেঁ মিলকর সাথ চলেঁ”।
।। ভারত মাতা কী জয়।।
(বিজয়াদশমী উৎসব উপলক্ষ্যে নাগপুরে প্রদত্ত ভাষণ)
2019-10-18