১৩ অগস্ট ১৯৬৫, সোমবার।
প্রায় সত্তর বছরের এক বৃদ্ধ একটি ছাতা, দুটি ট্রাংক, এক কপি চৈতন্যচরিতামৃত, কিছু চিঁড়ে মুড়কি এবং সেই সঙ্গে আটটি ডলার এবং পাসপোর্ট-ভিসা ও পি-ফর্ম সম্বল করে একটি ট্যাক্সি চড়ে দুপুরবেলায় খিদিরপুর ডকের দিকে এগিয়ে চললেন। তিনি একটি জাহাজে করে আমেরিকায় যাবেন। সেই জলযানের নাম জলদূত, সেটি সিন্ধিয়া কোম্পানির মালবাহী জাহাজ। বৃদ্ধ যাত্রীর সঙ্গে রয়েছে একটা বিনামূল্যের টিকিট এবং সেই সঙ্গে জাহাজে বিনামূল্যে নিরামিষ খাওয়া-দাওয়ার অনুমতি।

“পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম,
সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর নাম।”
(চৈতন্যভাগবত, অন্ত্য খন্ড ৪.১২৬)

এই কথা নাকি বলে গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। আর তা বাস্তবায়িত করার জন্য সেদিন এই বঙ্গীয় বৃদ্ধের মনে ছিল অনমনীয় জেদ। তিনি জাহাজ থেকে যখন তীরের দিকে তাকালেন তখন একজন অনুরাগীকেও বিদায় জানাতে দেখলেন না। এই বৃদ্ধই অভয়চরণ।

কলকাতার এক সোনার বেনে পরিবারে অভয়চরণ দে’র জন্ম। (১ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬)

মায়ের নাম রজনী, বাবা গৌরাঙ্গমোহন দে, অত্যন্ত সাধারণ এই পরিবার ছিল বস্ত্রব্যবসায়ী।

গৌরমোহন শুদ্ধ বৈষ্ণব, তিনি চেয়েছিলেন ছেলে হয়ে উঠুক কৃষ্ণভক্ত, যদিও মায়ের ইচ্ছা,তাঁর ছেলে বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টার হোক।

এ বিষয়ে পিতৃদেবের প্রবল আপত্তি, কারণ বিদেশ গেলেই সে কোটপ্যান্ট পরবে, মদ খাবে এবং মেমসাহেবদের সঙ্গে মেলামেশা করবে। তিনি ছোট্ট ছেলেকে মৃদঙ্গ বাজানো শেখার ব্যবস্থা করলেন যাতে সে ভজন-কীর্তনে দক্ষ হয়ে উঠে শ্রীমদ্ভাগবতের বাণী প্রচার করতে পারে।

শেষ পর্যন্ত মতিলাল শীল ফ্রি স্কুলে ঢুকলেন অভয়চরণ দে। তারও অনেক পরে সময়ের স্রোতে একসময় পুরো নাম হয়েছিল — কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়াচরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ। তিনি একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। সারা বিশ্বে তার নাম ‘ইসকন’। ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনসাসনেস। বাংলায় বলে ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ’ ।

ছোটবেলায় অভয়চরণ একবার কঠিন অসুখে পড়েছিলেন। গৃহ-চিকিৎসক খ্যাতনামা ডাক্তার কার্তিক বসু চিকেন খাবার প্রেসক্রিপশন দিলেন, সেই সঙ্গে বললেন, তিনি নিজেই পথ্য তৈরি করে আনবেন।

সেই পথ্য মুখে দিয়েই শিশুর বমি শুরু হল, এই শরীরে আমিষ চলবে না তা বিখ্যাত ডাক্তার বুঝে গেলেন। পরবর্তী কালে ইসকনের নিরামিষ যেন নীতির যেন একটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল।
অভয়চরণ আজন্ম সন্ন্যাসী নন তাঁর বৈষ্ণবগুরু ভক্তিসিদ্ধান্তের মতন। সে কালের নিয়ম মতো কলেজে পড়তে পড়তেই ২২ বছর বয়সেই বিবাহ, কন্যার নাম রাধারানী দত্ত এবং পরবর্তী সময়ে পাঁচ পুত্র ও কন্যার পিতা।

মন দিয়েই সংসারধর্ম ও কাজকর্ম করছিলেন মেডিক্যাল সেলসম্যান অভয়চরণ, কিন্তু ১৯২২ সালে তাঁর বন্ধু নরেন্দ্র নাথ মিত্র অভয়চরণকে এক অদ্ভুত বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর কাছে নিয়ে গেলেন।

বাগবাজারের গৌড়ীয় মঠে তিনি ভাবী গুরুকে প্রথম দেখলেন এবং প্রথম দর্শনেই ভক্তিভরে মাথা নত করলেন।

ভক্তিসিদ্ধান্ত ছাপাখানার মাধ্যমে বৈষ্ণবগ্রন্থের বিপুল প্রচারে বিশ্বাসী। নিজের মুদ্রণযন্ত্রের নামও দিয়েছিলেন ‘বিপুল মৃদঙ্গ’।

তাঁর বক্তব্য, কীর্তন আর কত দূর শোনা যায়? বৃহৎ মৃদঙ্গের সাহায্যে চৈতন্যদেবের বাণী শোনা যাবে সারা বিশ্বে।

যথাসময়ে অভয়চরণ জানলেন, বৃহন্নারদীয় পুরাণ এবং উপনিষদ থেকে সঞ্চয়িত মন্ত্র :

হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ

কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম, হরে রাম

রাম রাম, হরে হরে।

অভয়চরণ তখন যথেষ্ট ভক্তি ও যথেষ্ট উপার্জনের দ্বৈতপথে যাতায়াত করছেন। তাঁর ইচ্ছা, বিজনেস থেকে প্রভূত উপার্জন হলে তিনি ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতীর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে অর্থসাহায্য করবেন।

ভক্তিসিদ্ধান্ত তাঁর প্রিয় অভয়কে দীক্ষা দিলেন। তাঁর নতুন নাম হল অভয়াচরণারবিন্দ। ইলাহাবাদ ছাড়বার আগে গুরু নির্দেশ দিলেন রূপ গোস্বামী রচিত “ভক্তি-রসামৃত-সিন্ধু” মন দিয়ে পড়তে হবে। গুরুর সঙ্গে অভয়ের যোগাযোগ ক্রমশ নিবিড় হতে লাগল এবং তিনি এক সময় চিঠিতে শিষ্যকে জানালেন, তুমি ইংরিজিতে ভাল প্রচারক হতে পারো, এতে মানুষের মঙ্গল হবে। অভয়চরণ তখনও ভাবছেন বিজনেসকে বিস্তৃত করে আরও উপার্জনের কথা। আর গুরু বলছেন, যদি কখনও টাকা পাও তাহলে কিছু বই ছেপো। গুরু ভক্তিসিদ্ধান্তের দেহাবসান ১৯৩৭ সালের ১ জানুযারি—তার আগে শিষ্যের কাছে বারবার আবেদন, ইংরিজিটার ওপর জোর দাও, অনুবাদে মন দাও, বই ছাপো, না হলে সারা বিশ্বে প্রচার সম্ভব হবে না।

ইতিমধ্যে ব্যবসায়িক সাফল্যের সন্ধানে অভয়চরণ কখনও কানপুরে, কখনও বোম্বাইতে এবং অবশেষে কলকাতায়। সেখানকার ঠিকানা ৬ নম্বর সীতাকান্ত ব্যানার্জি লেন, কোম্পানির নাম অভয়চরণ দে অ্যান্ড সন্স, সেই সঙ্গে বাত-বেদনা থেকে মুক্তির মালিশ দে’জ পেইন লিনিমেন্ট!

১৯৩৮-৩৯-এর কথা। অভয়চরণ পরের বছর ইংরিজিতে বই লিখলেন “ইনট্রোডাকশন টু গীতোপনিষদ”। পরিচিতজনরা তাঁকে ‘ভক্তিসিদ্ধান্ত’ নামে আখ্যায়িত করতে চাইলেন। কিন্তু তিনি গুরুর নাম নিলেন না, বেছে নিলেন ‘ভক্তিবেদান্ত’ নামটি।

এ সব মহাযুদ্ধের আগের কথা। এই সময়য়েই পরবর্তী কালে বিশ্ববিখ্যাত ইংরিজি সাময়িকপত্র ‘ব্যাক টু গড্ হেড্’ প্রকাশ। যুদ্ধের পর ভাগ্যসন্ধানে কলকাতার ব্যবসা তুলে দিয়ে ৬০০ মাইল দূরে লখনউতে চল্লিশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে অভয়চরণ ওষুধের কারখানা খুললেন। কিন্তু তা চলল না। তিন বছর পরে অভয়চরণ আবার ইলাহাবাদে ফিরে এলেন। সেখান থেকে আবার কলকাতার চেতলায়।

শাস্ত্রমতে বিশ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য, একুশ বছরে গার্হস্থ্যে প্রবেশ ও একান্ন বছরে বানপ্রস্থে যাওয়া ভাল। এই ধারা মেনেই যেন ১৯৫৪ সালে ৫৮ বছর বয়সে অভয়চরণ সংসার থেকে বেরিয়ে আসেন এবং পাঁচ বছর পর ৬৩ বছর বয়সে মথুরায় কেশব মহারাজের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

ইতিমধ্যেই নানা পথ ঘুরে বৃন্দাবনের সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো রাধারমণ মন্দিরের ছোট্ট একটি ঘরে তিনি আশ্রয়লাভ করেছেন। ঘরটির মাসিক ভাড়া পাঁচ টাকা।

ছোট্ট এইটুকু ঘরে গুরুর ইচ্ছাপূরণের জন্য শ্রীমদ্ভাগবতমের ইংরিজি অনুবাদের ম্যারাথন যাত্রা শুরু। আকারে বিশাল এই বই, কাজের সুবিধার জন্যে অভয়চরণ একটি পোর্টেবল টাইপরাইটার সংগ্রহ করলেন। খণ্ডে খণ্ডে এই বই প্রকাশ একজন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, কিন্তু গুরুর স্বপ্নকে সম্ভব করে তুলবার জন্য দুঃসাহসী শিষ্য সম্পূর্ণ তৈরি।

অভয়চরণ একসময় ভাবলেন, অনুবাদের কাজ শেষ করে তার পর মুদ্রণের চেষ্টা করলে ভাল হবে না, তার থেকে ধৈর্য ধরে এক একটা খণ্ড প্রকাশ করো, বিক্রি করো, তারপর আবার ছাপো।

এই অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টার শুরু বৃন্দাবনে, ছাপাবার জন্যে যাতায়াত দিল্লিতে। দিল্লিতে থাকার কোনও জায়গা নেই, তাই ওখানকার কাজ শেষ করে প্রতিদিন আবার বৃন্দাবনে ফিরে আসা।
ইংরেজি শ্রীমদ্ভাগবতমের প্রথম খণ্ডের প্রকাশ ১৯৬২ সালের শেষ দিকে।
তারপর দরজায় দরজায়, অফিসে অফিসে ঘুরে ১৫ টাকায় সেট বিক্রি করা। খুব
কঠিন কাজ, কিন্তু না করলে পরের খণ্ডের অর্থ পাওয়া যাবে না। ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রকাশ এবং জানুয়ারি ১৯৬৫-তে শ্রীমদ্ভাগবতমের তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ। কিন্তু এখনও অনেক খণ্ড বাকি।
মাথায় মস্ত চিন্তা, ইংরিজি বইকে কী ভাবে সাগরপারে প্রচার করা হবে? কৃষ্ণনামের সর্বত্র প্রচার যে তাঁর গুরুর ইচ্ছা। দ্বারে দ্বারে প্রচারের জন্য সন্ন্যাসী ভক্তিবেদান্ত একসময় বোম্বাইতে হাজির—এখানে ধনী জনের সংখ্যা কম নয়।
বোম্বাইতে গৌড়ীয় মঠের কৃপাসিন্ধুর সাহায্যপ্রার্থী হলেন, আমেরিকায় যাবার একটা পথ খুঁজে বের করতেই হবে।
কৃপাসিন্ধু সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশনের ধর্মপ্রাণা সুমতি মোরারজির কথা বললেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা সহজ নয়। ভক্তিবেদান্ত বলতে চান, ভাগবতে ১৮০০০ স্তোত্র, ইংরিজিতে অন্তত ৬০ খণ্ড লাগবে, অনুবাদ শেষ হতেও যে সাত বছর লাগবে, তত দিন কৃষ্ণ যেন তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন।
বম্বের সুমতি মোরারজির সঙ্গে দেখা করবার জন্য একদিন সন্ন্যাসী ভক্তিবেদান্ত অফিসে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা বসে রইলেন এবং অবশেষে তাঁকে ধরতে পারলেন।
ভক্তিবেদান্ত বললেন, ভাগবতের শুরু পাঁচ হাজার বছর আগে নৈমিষারণ্যের গুণিজন সম্মেলনে, এর রচয়িতা ব্যাসদেব, পরামর্শদাতা তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু নারদ মুনি।
তিনি জানালেন, শুধু অনুবাদ করলেই হবে না, তাঁকে বিদেশে গিয়ে অনুবাদের প্রচার করতে হবে, গুরু ভক্তিসিদ্ধান্তের তাই ইচ্ছা ছিল। তিনি মন্দির রচনার থেকে গ্রন্থ রচনাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের কাছে কৃষ্ণের বাণী প্রচার বিশেষ প্রয়োজনীয়, তাঁদের জয় করতে পারলেই বিশ্ববিজয় হবে।

সুমতি মোরারজি তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন, আপনার বয়স ৬৯, আপনি ওই দেশের কিছুই জানেন না, আপনার বিদেশে যাওয়া মোটেই নিরাপদ হবে না। কিন্তু সন্ন্যাসী নাছোড়বান্দা, গুরুনির্দেশে তাঁকে যে করেই হোক আমেরিকায় যেতে হবে।

সুমতি মোরারজি তাঁকে একটা ফ্রি টিকিট এবং সেই সঙ্গে ট্রাম্প কোম্পানির জাহাজে বিনামূল্যে নিরামিষ খাবার দিতে রাজি হলেন। জাহাজের নাম জলদূত, ছাড়বে কলকাতা থেকে ১৩ অগস্ট ১৯৬৫।

সন্ন্যাসী দ্রুত পাসপোর্ট জোগাড় করে ফেললেন। বৃন্দাবনের এক ব্যবসায়ী (মিস্টার আগরওয়াল) তাঁর মার্কিন প্রবাসী ছেলেকে অনুরোধ করলেন স্পনসরশিপ পাঠাতে। ছেলেটি পিতৃ-আজ্ঞা অবহেলা করতে পারল না, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে দিল এবং অবশেষে কলকাতা থেকে যাত্রার দিন সমাগত।

পঞ্চাশ বছর আগের ১৩ অগস্ট ১৯৬৫ ও অর্ধ শতাব্দী পূর্তির ১৩ অগস্ট এক নয়। একজন বৃদ্ধ বৈষ্ণব সন্ন্যাসী বিদেশের মাটিতে শ্রীকৃষ্ণ নামের যে জয়ধ্বনি তুললেন, তা পৃথিবীর আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এক আশ্চর্য ঘটনা।

কলকাতা থেকে বোস্টনের ৩৫ দিনের জলযাত্রার মধ্যেও কিছু অঘটন ঘটেছে। সত্তর বছরের নিঃসঙ্গ যাত্রীর দু’বার হার্ট অ্যাটাক করেছে, কিন্তু কৃষ্ণনামে বিশ্বাসী সন্ন্যাসী হাল ছেড়ে দেননি, পরাজয় মেনে নেননি।

বৃন্দাবনের ব্যবসায়ী মিস্টার আগরওয়ালের বিদেশি পুত্র তাঁকে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছেন, তার পর সন্ন্যাসী ভক্তিবেদান্ত নিউ ইয়র্কে এসে ঘরছাড়া দিকহারা নবীন আমেরিকানদের সঙ্গে পার্কে পার্কে কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা হয়ে মার্কিনি সভ্যতাকে নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ দিয়েছেন। দিকে দিকে বার্তা রটেছে “হরে কৃষ্ণ হরে রাম।”

মার্কিনদেশে প্রভুপাদের আগমন ও প্রাথমিক সংগ্রামের নানা বিবরণ যথাসময়ে গভীর ধৈর্যের সঙ্গে সংগৃহীত হয়েছে। তার বিবরণ অনেক অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিকেও হার মানায়। প্রভুপাদের সুযোগ্য শিষ্য আলফ্রেড ফোর্ড ( ধনী ফোর্ড পরিবারের সদস্য ) অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।

প্রভুপাদ শ্রীমদ্ভাগবতকে ঈশ্বরবিজ্ঞান বলে বর্ণনা করেন এবং ঈশ্বরবিহীন সভ্যতার বিপদের কথা উল্লেখ করেন। কৃষ্ণভাবনামৃতের শুরুতেই রয়েছে চারটি অধঃপতন থেকে দূরে থাকা। এগুলি হল—বিবাহবন্ধনের বাইরে যৌন সম্পর্ক, মাছমাংস ইত্যাদি খাওয়া, সব রকমের নেশাভাঙ এবং জুয়াখেলা। বহু বছর আগে শ্রীচৈতন্য তো এ রকমই চেয়েছিলেন।

প্রচার এবং প্রসারে হিন্দুদের আস্থা কম। হিন্দুরা জড় পদার্থের মত একই অবস্থায় পড়ে থাকতে পছন্দ করে। বহু প্রগতিশীল হিন্দু মনে করেন, ধর্ম কি একটা ব্যবসা নাকি যে মানুষকে ধরে ধরে মুরগির মত খোঁয়াড়ে ভরতে হবে ? যার আসার সে নিজেই আসবে। কিংবা, তাহলে হিন্দু ধর্মের সাথে অন্যদের পার্থক্য কি রইল ?

সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন,আর পাঁচটা জিনিসের মত ধর্মপ্রচারটাও যুথবদ্ধ মানুষের একটা অভ্যাস, একটা অভিব্যক্তি। একদিক থেকে দেখতে গেলে, ধর্মপ্রচার হল বাকপটুতার সব থেকে বড় পরীক্ষা। কোন মানুষকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাঁকে প্রচারকারীর নিজস্ব ধর্মের আওতায় আনা ; এতে দক্ষতা, পরিশ্রম ও ধৈর্য লাগে অনেক বেশি। এতে খরচ‌ও আছে, এবং বিশ্বের সংগঠিত ধর্মগুলি এই বিষয়ে যথেষ্ট বিনিয়োগ করে থাকে।

হিন্দুরা জানেই না, বিশ্বের বড় বড় ধর্মগুলোতে পরিষ্কার ঐশ্বরিক আদেশ রয়েছে অন্য ধর্মের অনুসারীদের নিজের ধর্মে আনার। যে গুটিকয় হিন্দু এই বিষয়টা জানেন তারাও এসব খাটুনির কাজকে ঘৃণার চোখে দেখেন বা ভয় পান। এসব বিষয়ে তো রামকৃষ্ণ মিশন একেবারেই ন্যাদাক্যাবলা।

এই ধরনের ধর্মপ্রচারের কাজ হিন্দুদের মধ্যে একটিই সম্প্রদায় বেশ সফলভাবে করে থাকে। তা হল এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের যে কি বিপুল উৎসাহ রয়েছে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সেই কত আগে শ্রীশান্তিদেব গোঁসাই মণিপুরে ধর্মবিজয় সম্পন্ন করেন বলেই তো পার্বত্য মেইতেই উপজাতি বৈষ্ণব হয়ে গিয়েছিল।

ধর্মপ্রচারের এহেন কাজকে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন “ধর্মদান”!

অবশ্য স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীঅরবিন্দকে নিয়ে তাঁর মতামত ছিল অনুদার। তিনি বিবেকানন্দের ধূমপান ও আমিষ খাওয়াকে ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর কথোপকথনের নথি থেকে এই বিষয়গুলি জানা যায়।

(“বিবেকানন্দ আদতে একটি রাস্কেল। তার কোন জ্ঞান ছিল না।”

Room Conversation ; December 11,1971, New Delhi.

“বিবেকানন্দ আশি বছর আগে আমেরিকায় গিয়েছিলেন, ১৮৯৩ সালে। রামকৃষ্ণ মিশনের সেখানে আছে সাকুল্যে চার কি পাঁচটি কেন্দ্র, সেই সংখ্যা আর যাই হোক দশের অধিক কখন‌ই নয়। কিন্তু আমার ইউরোপ আমেরিকা মিলিয়ে চল্লিশটি কেন্দ্র রয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনে এত আমেরিকান ছেলে তুমি শিষ্য হিসাবে পাবে না, কিন্তু আমাদের কাছে হাজার হাজার শিষ্য আছে -সবাই অল্পবয়সী ছেলে ও মেয়ে। আমি চলে যাবার পর এরাই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

Room Conversation ; April 18,1972,Hong Kong.)

আবার বিবেকানন্দ‌ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের প্রেমভক্তির বিষয়টি ভাল চোখে দেখতেন না।

“ঐ প্রেম প্রচার করেই তো সমস্ত জাতটা মেয়ে হয়ে গিয়েছে। সমস্ত উড়িষ্যাটা কাপুরুষ ও ভীরুর আবাস হয়ে গিয়েছে। আর এই বাঙলা দেশটায় চারশ বছর ধরে রাধা প্রেম করে কি দাঁড়িয়েছে দেখ! এখানেও পুরুষত্বের ভাব প্রায় লোপ পেয়েছে। লোকগুলো কেবল কাঁদিতেই মজবুত হয়েছে। ভাষাতেই ভাবের পরিচয় পাওয়া যায়- তা চারশ বছর ধরে বাঙলা ভাষায় যা লিখা হয়েছে, সে সব এক কান্নার সুর। প্যানপ্যানানি ছাড়া আর কিছুই নেই। একটা বীরত্ব সূচক কবিতার জম্ম দিতে পারেনি!”

-স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, নবম খন্ড, তিন দিনের স্মৃতি লিপি, পৃষ্ঠা ২৭৫, ২৭৬

ইসকন তথা প্রভুপাদকে নিয়ে কিছু বিতর্ক‌ও আছে। নিরামিষ ভক্ষণে জোর দেওয়া, দুর্গাকে কৃষ্ণের দাসী বলা, শিবঠাকুরকে হেয় করা, অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি নীচু মনোভাব ইত্যাদি বিষয়ে তাঁরা অনেকের বিরাগভাজন হয়েছেন।

কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর “শ্রীমদ্ভগদ্গীতা যথাযথ” বইতে চাণক‍্যকে উদ্ধৃত করে প্রথম অধ‍্যায়ের অর্জুনবিষাদযোগের ৪২ নং শ্লোকের যে ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত নারী অবমাননাকর, misogynist এবং আধুনিক দৃষ্টিতে প্রাচীনপন্থী এবং এটি সঠিক‌ও নয়।

যাইহোক, এসব অতি স্পর্শকাতর বিষয়। আরো অনেক কিছুই আছে যা নিয়ে বিশদে আলোচনা না করাই ভালো।

১৩ অগস্টের ঐতিহাসিক জলযাত্রার পরে প্রভুপাদ এগারো বছরে চোদ্দো বার বিশ্ব প্রদক্ষিণ করেন—ছ’টি মহাদেশে হাজার হাজার ভক্তের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। এর মধ্যে কয়েক বার তিনি ভারতে, বিশেষ করে কলকাতাতেও আসেন। এ দেশেও বেশ কয়েকটি মন্দির স্থাপিত হয়।

বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘের নানা পরিচালন পত্র ও আইনি সমস্যা তাঁর অসুস্থ শরীরকে আরও জর্জরিত করে রেখেছিল। অসুস্থ শরীর সম্বন্ধে প্রভুপাদ বলতেন, এটা পুরনো মেশিন, যতই সারানো যায়, ততই এটা খারাপ হয়।

তিনি বলতেন, আমরা কখনও মগজ ধোলাই করার চেষ্টা চালাইনি। সবই করেছি শাস্ত্রের নির্দেশে।

তিনি চৈতন্য জন্মভূমি মায়াপুরের নবনির্মিত মন্দির দেখে বললেন, ‘‘এখন যদি আমার মৃত্যু হয় কিছু এসে যায় না।’’

লেখক প্রভুপাদের ইতিমধ্যেই বিশ্বজোড়া স্বীকৃতি— শুধু মাত্র ইংরেজিতেই চার কোটি চৌত্রিশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবত তখনও সম্পূর্ণ হয়নি— বেঁচে থাকার শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত অনুবাদের কাজ অব্যাহত। মৃত্যুপথযাত্রী অনুবাদককে এক জন শ্লোকটি পড়ে শোনাত। আর এক জন মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরত। কী বলছেন, তা শুনতে অসুবিধে হত। কিন্তু অনুবাদকর্ম ব্যাহত হত না।

১৪ নভেম্বর ১৯৭৭ কার্তিক মাসে গৌরচতুর্থীর দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কৃষ্ণ-বলরাম মন্দিরে জগৎসংসার থেকে চিরবিদায় নিলেন। রেখে গেলেন অগণিত মন্দির, হরে কৃষ্ণ ভাব আন্দোলন, তিরিশ খণ্ডে শ্রীমদ্ভাগবতম এবং সতেরো খণ্ডের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। ছিয়াত্তরটি ভাষায় এই সব বই অনূদিত হয়েছে এবং ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট পৃথিবীর বৃহত্তম বৈষ্ণব সাহিত্য প্রকাশকের বিশিষ্টতা অর্জন করেছে।

যে কৃষ্ণভক্ত বিদেশীদের পুরীর পান্ডারা হিন্দু হিসেবেই স্বীকার করেনি, মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি, সেই বিদেশীদের সংগঠিত করে ইসকনের নিজস্ব রথযাত্রার মধ্যে দিয়েই পুরীর কথা,জগন্নাথদেবের কথা বিশ্ববাসী জেনেছে। ভারত-বাংলাদেশের বাইরে গোটা পৃথিবী রথযাত্রা চিনেছে ইসকনের মাধ্যমে। ভারতের মধ্যেও বেশিরভাগ জায়গাতে যে রথযাত্রা উৎসব হয়ে থাকে, তাও ইসকনেরই আয়োজন। এত সহজ ভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারতেন বলেই প্রভুপাদ অনন্য।

প্রভুপাদের চ্যালাচামুন্ডা “তরুবৎ সহিষ্ণু, তৃণবৎ কোমল” নিরামিষভোজী বোষ্টুমরা সারা পৃথিবী জুড়ে একটা বিরাট কান্ড‌ই করে ফেলেছে বলতে হবে !

তথ্যসূত্র ও ভাষা অনুসরণ ; আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৫ ও ২২অগষ্ট,২০১৫, প্রভুপাদকে নিয়ে শংকরের প্রবন্ধ।

✍ঋতুপর্ণ বসু ঋতুপর্ণ বসু

শংকর, সাহিত্যিক ; মানব সাগরতীরে

“ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের কৃতিত্ব এখনও অসাধারণ। …….মাপের দিক থেকে বলতে গেলে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যা করে গিয়েছেন তা অন্য সমস্ত ভারতীয় প্রচারকদের থেকে বেশী। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দও এই বিপুল সাফল্য ও স্বীকৃতি বিদেশে অর্জন করেননি।”

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যিক ; পূর্ব-পশ্চিম, দেশ, ১৭-১২-১৯৮৮

“এটা কিন্তু একটা বিরাট ফেনোমেনান, আমাদের জানা দরকার। এ যুগে এ রকম রিয়েল লাইফ অ্যাডভেঞ্চার স্টোরি কল্পনাও করা যায় না।”
“প্রভুপাদের সমস্ত কেরিয়ারটা স্টাডি করে আমার একটা অদ্ভুত ফিলিং হয়েছে। একজন মানুষ নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে এতদূর উঠতে পেরেছেন? আর আমরা কী করছি?”
“প্রভুপাদ একলা নিঃসম্বল অবস্থায় এসেছিলেন এদেশে। কিন্তু নিজের স্ট্যাণ্ডপয়েন্ট থেকে এক চুলও নড়েননি। এই মাংসাশী জাতকে ইনি বাধ্য করেছেন নিরামিষ খেতে। এদেশে এত সেকসুয়াল পারমিসিভনেস্, অথচ ইনি ভক্তদের আদেশ দিয়ে রেখেছেন, অবৈধ যৌন সংসর্গ চলবে না। …….এগুলো তো শুধু হুজুগ নয়। আমেরিকান হুজুগ দু-চার মাস, বড় জোর এক বছর থাকে। শুধু হুজুগে এতখানি আত্মত্যাগ কি সম্ভব? সেই তুলনায় আমরা কি করছি? আমরা এদেশে এসেই নিজের নামটা বদলাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ……অথচ ঐ বুড়ো লোকটি পুরো ভারতীয় কালচার চাপিয়ে দিচ্ছে এদেশের হাজার-হাজার ছেলেমেয়েদের মধ্যে।”

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক; বাঙালের আমেরিকা দর্শন, আনন্দবাজার পত্রিকা

“ভক্তিবেদান্ত স্বামী যা করেছেন তা কেবল হুজুগের ব্যাপার নয়। কৃষ্ণভক্তিকে তিনি গভীরে সঞ্চার করতে পেরেছেন। কতখানি ভক্তি, নিষ্ঠা আর মনের জোর থাকলে আমেরিকার মতো দেশে এ কান্ড ঘটানো যায় সেটা ভেবে অবাক হয়েছি।”

অমিতাভ চৌধুরী, সাংবাদিক ; যুগান্তর, ২৭-০৪-১৯৮৩

“শ্রীল প্রভুপাদ বিংশ শতাব্দীর বিস্ময়। জীবনের শেষ প্রান্তে অকুতোভয় এই পরম বৈষ্ণব সম্পূর্ণ নিঃসম্বল অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিপ্লব ঘটিয়ে গেলেন। বিশ্ব জুড়ে অগণিত কৃষ্ণভক্ত ও গৌরভক্তের সৃষ্টি তাঁর অসাধারণ কীর্তি। শ্রীল প্রভুপাদের এই দিগ্বিজয় ধর্মপ্রচারের ইতিহাসে তুলনারহিত। ……স্বামী বিবেকানন্দের মার্কিন দেশ বিজয়ের কাহিনীর চেয়ে এই কাহিনী কম আকর্ষক নয়। বিদেশে পরিস্থিতি ও সময়ের দিক থেকে বিচার করলে শ্রীল প্রভুপাদের কীর্তি বরং একটু বেশিই।”

দেবাশীষ আইয়ার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.