আপোষহীন খাবারের স্বাদ, ১০৮ বছর ধরে বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করছে তরুণ নিকেতন

ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে আজও বাঙালির রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে তরুণ নিকেতন (Pice Hotel Tarun Niketan)। রাসবিহারী মোড় থেকে মাত্র দুই মিনিট হাঁটলেই প্রায় ১০৮ বছরের ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই পাইস হোটেল। আজও এখানে খাবার পরিবেশন করা হয় কলাপাতায়। আপনি চাইলেই পাতে পড়বে ডাল, সবজি, ভাজা, শাক, হাঁসের ডিম, চিকেন, মাটন, মোচার ঘণ্ট, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক আরও কত কী! আর মাছের তালিকা? বেশ দীর্ঘ। প্রতিদিন প্রায় দশ থেকে বারোরকম মাছের পদ পাওয়া যায় এখানে। ইলিশ, পাবদা, চিংড়ি, ভেটকি, চিতল, কই, রুই, কাতলা, তেলাপিয়া তো পাবেনই; ইচ্ছা করলে পেতে পারেন আর কিংবা বোয়াল মাছ। ইলিশের তেল ভাজাও হয় এমন ঘনঘোর বর্ষায়। ভেটকি পাতুরি থেকে পুঁটি মাছের চাটনিও পেয়ে যাবেন কখনও।

১৯১৫ সালে পরাধীন ভারতে পথচলা শুরু করেছিল তরুণ নিকেতন। খাবারের স্বাদ এবং হোটেল কর্মীদের আন্তরিকতায় দ্রুতই খাদ্যরসিকমহলে সমাদৃত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ যখন ভালো পাইস হোটেল বিলুপ্তপ্রায়, চুটিয়ে ব্যবসা করছে কস্তুরি, ওহ্‌ ক্যালকাটা, ভজহরি মান্না-রা; তখন কেমন চলছে পাইস হোটেল তরুণ নিকেতন? এই দোকানের তৃতীয় প্রজন্মের একজন বঙ্গদর্শন.কম-কে জানান, “এই দোকান প্রথমে পাইস হোটেল হিসাবেই শুরু হয়েছিল। সেই হিসাবেই বেশ রমরমিয়ে চলছে এখনও। এখন অনেক নামীদামী দোকান হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতে তরুণ নিকেতনের কোনো ভয় নেই। এর কারণ দোকানের বিশেষত্ব। এখনও বাঙালি চান ঘরোয়া খাবার খেতে। আমরা বেশ গর্ব করেই বলতে পারি, একবার যারা তরুণ নিকেতনের খাবার খেয়েছেন, কখনোই তা ভুলতে পারেননি। সেই টানেই বারবার তরুণ নিকেতনে ফিরে আসেন তাঁরা।”

তরুণ নিকেতনের কর্মকর্তারা চেষ্টা করেন ভেজালহীন, বিশুদ্ধ গুঁড়ো ও গোটা মশলা সহযোগে রান্না এবং পাত সাজিয়ে খাওয়াতে। বলাই বাহুল্য, শুধুমাত্র এর টানে পুরোনো খাদ্যরসিকেরা ফিরে ফিরে আসেন তরুণে। ১৯৭১ সাল থেকে এখানে খেতে আসছেন প্রবীণ জোয়ারদার। যুবক বয়সে মায়ের সঙ্গে এসে মোচার ঘণ্ট খেতেন। এখনও সেই স্বাদের টানে ফিরে আসেন। আর কলাপাতায় ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। তিনি বলেন, “আমার হারিয়ে যাওয়া পূর্ব বাংলার কথা মনে পড়ে যায়। এখন আমার বয়স ৮২ বছর। এই দোকানে খেয়ে গ্যাস-অম্বলের জন্য কোনোদিন জেলুসিল খেতে হয়নি।” শুভাশিস গাঙ্গুলি নামক আরও একজন জানালেন, “আমার এক বস্ টার্গেট দিয়ে বলতেন, অ্যাচিভ করলে তরুণ নিকেতনে লাঞ্চ। আমাদের এতটাই লোভনীয় প্রস্তাব ছিল তা।”নতুন প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয় তরুণ নিকেতন। তরুণরাও রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করেন আরেক তরুণকে। সনাতন খাবার, সাবেকি পরিবেশনের কায়দা সবমিলিয়ে তরুণ নিকেতনে বসে খাওয়া মানে তিলোত্তমা কলকাতার একচিলতে ইতিহাসের স্বাদ পাওয়া। ছুঁয়ে দেখা নিজের শিকড় এবং ঐতিহ্যকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.