একই দেহে শিব-দুর্গা, বাংলার কাঠের পুতুলে অর্ধনারীশ্বরবাদ

Story image

বর্ধমান জেলার স্বল্প পরিচিত এক পল্লী গ্রাম ‘নতুন গ্রাম’। নবদ্বীপের সামান্য উত্তর প্রান্তের জনপদ অগ্রদ্বীপ ঘাট থেকে যদি আর মাইল দু’য়েক চলা যায় তবেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সেখানে। তখন মধ্য যুগের বঙ্গ সীমানায় শ্রীচৈতন্যের ভাব ধারায় শুরু হয়ে গিয়েছে বৈষ্ণব ভাবাশ্রিত বাংলা চালের ভক্তি আন্দোলন। বলতে গেলে সে কাল থেকেই নতুন গ্রামের বাড়বাড়ন্ত আর গ্রাম জুড়ে সূত্রধর শিল্পীদের বসবাস। ওদিকে অগ্রদ্বীপ তখন বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র। ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিতের অষ্টাদশ অধ্যায় জানা গেল যে, শ্রীচৈতন্যের শিষ্য শ্রীগোবিন্দ ঘোষ ঠাকুর অগ্রদ্বীপে গোপীনাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছেন। নতুন গ্রামের সূত্রধর সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন নির্মাণ ভাবনার অন্য জোয়ার। গরুর গাড়ির চাকা, খাট-পালঙ্ক কিংবা ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের খেলার পুতুল- রাজা রানি বা মমি পুতুল তৈরি করার সাথে সাথে তাঁরা মেতে উঠলেন রামায়ণী চরিত্রের পুতুল, গৌর-নিতাই, রাবণ রাজা প্রভৃতি নির্মাণ করতে। সঙ্গে রইল লক্ষ্মী ঠাকুরুনের প্যাঁচা। নতুন গ্রামের কারিগরদের এমন শিল্প সম্ভার নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপের নানা হাঁটে বিকোতে লাগলো পয়সা পয়সা দরে। চৈতন্য ভক্তি আন্দোলন ঘরে ঘরে প্রচার প্রসার পেল পুতুল বাহনে ভর করে। গৌড়-নিতাই কিংবা শ্রীকৃষ্ণকে হৃদ মাঝারে রাখার তখন একমাত্র উপায় ওই কাঠের পুতুল। তেকোণা কাঠের টুকরোতে অমন পুতুল দর্শনে চোখের কোণ ডুবু ডুবু হয়।

সহসা দেখা গেল এক নতুন অনুভবের জোয়ার। জল মাটির নরম দেশ বাংলা- চৈতন্য আন্দোলনের শক্ত পোক্ত বিদ্রোহী মেজাজটিকে গ্রহণ না করে বিরহী রসে ডুবে গেলো। তাঁর চেতনায় তখন অন্য ছবি। ‘হাঁ কৃষ্ণ হাঁ কৃষ্ণ’ বলে নিমাই কেঁদে ফেরে এ পাড়া থেকে ও পাড়া। প্রতিটি মানুষ ‘কৃষ্ণ কোথা গো’ বলে চোখ ভাসায়। বৈষ্ণবী তান ধরে ‘পর জনমে আমারই মতো রাধা হইও তুমি প্রিয়’। কথক ঠাকুর নয়ন ভাসিয়ে গায় ‘সুখ দুখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পিরিতি দুখ যায় তাঁরি ঠাই’। রামায়ণের সীতা – মানে মা জানকী কি নিদারুণ মন কষ্টে একাকী দিন কাটায় রাক্ষস রাজার লঙ্কা মুলুকে। সেই গল্প পাঠ করা হয় কুপির আলোয়, বট গাছের তলায়, ভক্ত জনের মাঝে। করুন রসে গলা ভিজিয়ে বলা হয় সীতাকে খুঁজে ফেরেন শ্রীরামচন্দ্র এ দেশ থেকে ও দেশ। সব মিলিয়ে কেমন এক বিচ্ছেদী ভাবনায় ডুবে গেল বাংলা।কিন্তু এ কেমন হল ? এ কেমন বেদনার বাঁশি বেজে উঠলো বাংলা মুলুকে ? বাংলা তো বিশ্বাস করে গোলা ভরা ধান, কোল ভরা সন্তান আর নয়ন ভরা সুখে। ভরা সংসারে বাঙালি ভালোবাসার নকশি কাঁথা বোনে। সেই ঘর ভরা গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি এ কোন নয়ন ডোবার গান ? এমন যখন চলছে ঠিক তখনই সবার মনে পড়ল এ দেশে তো ঘর ভরা আলোর দিশা দেখায় মা দুর্গা, ভোলা মহেশ্বর আর সঙ্গে তাঁদের সন্তান সন্ততিরা। এমন ভরা সংসারের ছবি দেখা যায় বলেই তো বঙ্গ ভূমে দুর্গা পুজোর এত আদর কদর। ধীরে ধীরে নতুন গ্রামের কাঠের পুতুলেও দেখা গেল এক নয়া পুতুলের হাজিরা। না কোনও ষষ্ঠী পুতুল নয়। রাধারানী আর কৃষ্ণ ঠাকুরের যুগল মূর্তিও নয়। সেই পুতুল হল শিব আর পার্বতীর অর্ধ নারীশ্বর যুগল মূর্তি। বৈষ্ণব তীর্থে আমরা দেখলাম শিব দেহের অর্ধাংশ জুড়ে শাক্ত দেবী চণ্ডী।

মঙ্গল কাব্য যেন রূপ পেলো পুতুলে। যেখানে দেহের অর্ধাংশ জুড়ে শাক্ত দেবী চণ্ডী। সব মিলিয়ে বঙ্গ ভূমে তখন একদিকে রইল মনের ঠাকুরকে হৃদ মাঝারে রাখিবার প্রাণ ভরা আকুতি, দেখে দেখে আঁখি না ভরার মতো ক্ষণে ক্ষণে ঝাঁকি দর্শন আর অন্য দিকে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমির কণ্ঠে শোনা গেলো নতুন টুকরি ‘গৃহস্থের খোকা হোক’। সেই টুকরিই ভাষা পেলো পুতুলে। সব মিলিয়ে শিব পার্বতীর অর্ধনারীশ্বর পুতুলে শিল্পী রূপ দিলেন বঙ্গ মানুষের মানস চেতনকে। আজ নতুন গ্রামের সবাই এই পুতুলের রীতি জানেন এমন নয়। এমন পুতুলের নির্মাণ হদিশ আছে ওই গ্রামের শিল্পী গোপাল ভাস্করের কাছে। সাথে আরেকটু জানিয়ে রাখি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালায় ঠিক এরকম একটি হর- পার্বতীর প্রাচীন পুতুল রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.