হার্ভার্ডের ল্যামন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ১৯৯৮ সালে অর্থনীতির জন্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। পুরষ্কারটির উদ্ধৃতিতে বলা হয় যে তাঁর গবেষণাটি ছিল “কীভাবে ব্যক্তিদের মূল্যবোধকে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিবেচনা করা যায় এবং কল্যাণ ও দারিদ্র্য কীভাবে পরিমাপ করা যায়? তার গবেষণা ছিলো বিতরণ ব্যবস্থা সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে। বিশেষত সমাজের দরিদ্রতম অংশগুলির বিষয়ে তার আগ্রহ থেকেই তার এই প্রচেষ্টা আসে। তাঁর নোবেল পুরষ্কার জয়ের বিষয়ে হার্ভার্ড গেজেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করার জন্য তিনি এই পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। পুরষ্কারের মোট মূল্য এখন ১৬ মিলিয়ন ডলার হিসাবে ধরা হয়েছে, আমরা তাই অনুমান করতে পারি যে দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা বেশ ভাল ফলদায়ক । এই আয়ের পরিপূরক হিসাবে, তিনি এখন হার্ভার্ডের ইতিহাসের অধ্যাপক এবং আনুমানিক পরিমাণ ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অধিকারী রথসচাইল্ড পরিবারের অন্যতম উত্তরাধিকারী এমা জর্জিনা রথসচাইল্ডকে বিবাহ করেছেন।
৮৫ বছরের প্রবীন অধ্যাপক সেনের নিউ ইয়ার্কার কে দেওয়া “ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্যে অমর্ত্য সেনের আশা এবং ভয় “শীর্ষক সাক্ষাৎকারে এবং আরও কিছু প্রবন্ধ বেশ প্রচলিত। ঘনিষ্ঠ ইউরোপীয় বা শেতাঙ্গ বন্ধু /স্ত্রী বা ফ্যানেদের কাছে তিনি একজন স্মার্ট -সুদর্শন -বাকচতুর বাদামি সাহেব। যিনি ইউরোপ -আমেরিকার শিক্ষাজগৎ চষে ফেলেছেন এবং যিনি পাশ্চাত্যে পাওয়া মর্যাদাকে ভারতে কাজে লাগান ক্ষমতা ও অর্থ উপার্জনের কাজে। যদি তিনি এখনো ভারতের পাসপোর্ট ছাড়েননি এবং বিজেপির উপর তার ক্ষোভ সর্বজন বিদিত।
তখনো আমার সাথে প্রোফেসর সেনের দেখা হয়নি ‚ তবে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা সহযোগী মার্থা নসবাউম আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। আমার (মিসৌরির একটি আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া দরিদ্র অধ্যাপক‚ যার বাৎসরিক আয় ৫০,০০০ ডলার )ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় একটি সাঙ্ঘাতিক তথ্য দিয়েছিলেন যে “মার্টি (অর্থাৎ প্রোফেসর সেন ) নিউ ইয়র্ক সিটিতে তার মেয়ের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট সাজাতে ব্যস্ত আছেন‚ যার জন্য তিনি এক মিলিয়ন ডলার ব্যায় করেছেন।(১৬ বছর আগে ডেস মাইনস বিমানবন্দর হিল্টন হোটেলেরসাক্ষাৎকার থেকে যা মনে রেখেছিলাম তা থেকে আমি পএখানে উদ্ধৃতি করলাম)! আমি জানিনা এটি আমায় মুগ্ধ করার জন্যে নাকি আঘাত করার জন্যে ‚তবে প্রফেসর মার্থা নুসবাউম ভারতীয় রাজনীতি এবং গণতন্ত্র বিষয়ক একটি বইয়ের ক্যারিকেচার লিখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল, “গণতন্ত্রের মধ্যে সংঘর্ষ ‚ ধর্মীয় সহিংসতা এবং ভারতের ভবিষ্যৎ ” ! তিনি ছিলেন প্রোফেসর সেনের একজন কট্টর প্রশংসক এবং তার সাথে দারিদ্র্য বিষয়ক অনেকগুলো কাজে সহায়তা করেছিলেন। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্রতা পশ্চিমে ভালো দামে বিক্রি হয় !
আমার এক বন্ধু যাকে আমি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে জানি এবং যিনি ভারতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রফেসর সেনের জুনিয়র সহকর্মী ছিলেন এবং ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে তাকে চিনতেন‚তিনি আমায় বলেছিলেন প্রোফেসর সেন তার স্ত্রীকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছিলেন যখন তিনি তার বাম বা মার্ক্সবাদী দের প্রতি সহানুভূতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনে থাকার সময় তার অনেক আচরণে আমার বন্ধুটি ব্যাথিত হয়েছিলো। ”তবে এই ভাষ্যটি অধ্যাপক সেনের ব্যক্তিগত মিথ্যাচার ও প্রচার সম্পর্কে নয়, বরং তিনি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা, অর্ধ-সত্য এবং বিস্ময়কর প্রচার চালাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে।
আমি নিউ ইয়র্ককারে প্রকাশিত সর্বশেষ সাক্ষাত্কারে প্রফেসর সেনের কয়েকটি বক্তব্য তুলে ধরব।
১. “হিন্দুদের বেশিরভাগ অংশই হলো সংশয়যুক্ত। তাদের মধ্যে অনেক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাদের অনেককে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে।
২.“ গান্ধীকে আরএসএস [রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, ফ্যাসিস্ট হিন্দু আন্দোলন] সদস্যর হাতে নিহত হতে হয়েছিল! এই আরএসএস যার প্রভাব বর্তমানে বিজেপর উপর সাঙ্ঘাতিক। তবে তারা অফিসে ছিলেন না। আমরা হুমকির মুখোমুখি হইনি কারণ তারা ছিলো ঝাঁকুনির মতো।”
৩.” আমি কীভাবে বিস্মিত হয়েছিলাম যে তারা কিভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, কেবল দু’তিনজন মাত্র নয়‚ যারা প্রায়ই বড় দাতা হিসাবে সুনাম পায় ‚ সমগ্র ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সর্বাধিক সমর্থন পেয়েছিল ।
৪. .” মানুষ এখন ভয় পায়। আমি এমন এর আগে কখনও দেখিনি। যখন কেউ আমার সাথে ফোনে সরকারের সমালোচনামূলক কিছু বলে, তারা বলে, ” আপনার সাথে দেখা হলে আমি বরং এ বিষয়ে কথা বলব কারণ আমি নিশ্চিত যে তারা এই কথাবার্তাটি শুনছে।”
৫. যেসব সংবাদপত্রগুলি যারা সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা সরকারী বিজ্ঞাপন পায়না এবং তারা সম্ভবত অনেকগুলি বড় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন থেকেও বঞ্চিত হয়।
৬…” তার বড় সাফল্যগুলির একটি হল ২০০২ সালের গুজরাটে হত্যাকাণ্ডে তার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়। আর তাই অনেক ভারতীয়রা এটি বিশ্বাস করে না। “
৭. “আমি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দেখেছি। এক মুসলিম দিনমজুর যে আমাদের হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে এসেছিল এবং স্থানীয় হিন্দু গুন্ডারা তাকে ছুরি মেরেছিল। আমি বাগানে খেলছিলাম, এবং সে সসাহায্য এবং জলের সন্ধান করতে এসেছিল।তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। আমি বাবাকে চিৎকার করে বললেন এবং এক গ্লাস জল আনলাম । সে আমার কোলে শুয়ে ছিল। আমার বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সে সেখানেই মারা যায়।
“আসুন আমরা প্রতিটি বিবৃতিগুলি ক্রমান্বয়ে যাচাই করে দেখি। ।
প্রথম দাবিটি হলো মোদী নেতৃত্বাধীন সরকার বিজেপি বিরোধী ‘অনেক’ হিন্দুকে কারাগারে রেখেছিল অথবা তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে । তিনি এই সংক্রান্ত কোনো নাম ‚ কোনো সংখ্যা বা কোনো তথ্য কিছুই দেননি। যে পাঠকরা ভারত সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না তারা নোবেল বিজয়ীর কাছ থেকে এই ভুল বিবৃতি শুনে ভারত সম্পর্কে কি ধারণা করবে?
যাইহোক ‚ এই সম্পর্কিত আসল সত্য কি? প্রথম সারির ইংলিশ ভাষার সংবাদপত্র, হিন্দুস্তান টাইমস-এ প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সাতজন মানুষ ‚যারা অ্যাক্টিভিস্ট এবং সাংবাদিক মারা গিয়েছিল! এবং তাদের মধ্যে সবাই হিন্দু ছিলো। তালিকাটি পড়লে আমরা জানতে পারি যে তাদের মধ্যে চারজনকেই মোদী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতা পাওয়ার আগেই হত্যা করা হয়েছিল!
নিহত সাতজনের মধ্যে তিনজন ছিলেন হিন্দি ভাষার সাংবাদিক যারা মাওবাদীদের বা অন্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হাতে নিহত হয়েছিলো। এই হত্যাকাণ্ডের বিজেপি সরকার, এর রাজনীতি বা রাজনীতিবিদদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। আর বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যে দু’জনকে হত্যা করা হয়েছিল তারা হলেন এম.এম. কালবুর্গি এবং গৌরি লঙ্কেশ, দুজনই দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে মারা গিয়েছিলেন, যেখানে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় ছিল না। হত্যার চার বছর পরেও (একটি সেপ্টেম্বর 2015 এবং অপরটি সেপ্টেম্বর 2017 এ) একটি মামলায় কেবল সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে এবং অন্য মামলায় খুনি বা খুনিদের ধরার ক্ষেত্রে সত্যিকারের কোনো অগ্রগতি হয়নি। এটি, যদিও কর্ণাটকের সরকার একটি কংগ্রেস পার্টি / জনতা দল (সেকুলার) নেতৃত্বাধীন সরকার ছিল, যারা খুনীদের খুঁজে বের করার জন্য একটি বিশাল তদন্ত / পুলিশ দলকে রেখেছিল। নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য কলম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ, এবং বিবিসি সহ ইউরোপীয় এবং আমেরিকান সংবাদপত্রগুলিতে নায়কের মর্যাদায় ভূষিত হওয়া গৌরী লঙ্কেশের ক্ষেত্রেও জানা যায় যে তিনি বিভিন্ন উগ্রবাদী / খুনিদের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন। সংস্থাগুলি এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন সংবাদপত্রটি একটি ছদ্মবেশী ট্যাবলয়েড ছাড়া আর কিছুই ছিল না, এবং ট্যাবলয়েডের মালিকানা নিয়ে তিনি তার ভাইয়ের সাথে ঝগড়া চলছিলো ।
উদ্ধৃতি ২- অমর্ত্য সেন অভিযোগ করেছেন যে মহাত্মা গান্ধীর খুনী নাথুরাম গডসে একজন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সদস্য ছিলেন এবং আরএসএস একটি “ফ্যাসিবাদী হিন্দু আন্দোলন”। যদিও এটি সত্য যে নাথুরাম গডসে এবং তাঁর ভাইয়েরা আরএসএসের সদস্য ছিলেন, তারা মূলত হতাশ হয়ে হিন্দু মহাসভায় চলে গিয়েছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করতে চেয়েছিলেন ‚যেটি আরএসএস সবসময়ই এড়িয়ে চলে। , এবং এই হত্যাকাণ্ড আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার অন্য সদস্যদের অজান্তেই চালিয়েছিল হিন্দু রক্ষা দল নামে ষড়যন্ত্রকারীদের একটি ছোট সংগঠন!
গডসের কাজে জন্য তার যুক্তি এবং আগ্রহ নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যক তবে তারজন্য প্রফেসর সেনের মতো তাঁর রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় এর থেকে এমন কথাবার্তা আশা করা যায়না।
বাম বা প্রগতিবাদী মতাদর্শীদের কাছে প্রিয় “ফ্যাসিবাদী” লেবেলটির বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে যে আরএসএসের আন্দোলন যদি আসলেই ফ্যাসিবাদী হয় তবে এই “ফ্যাসিবাদী” আন্দোলনে অনুপ্রাণিত বিজেপি সরকার কেন নিয়মিত নির্বাচনের অনুমতি দিয়েছে? (স্থানীয় এবং রাজ্যস্তরের এবং জাতীয়) বিভিন্ন দল এতে নিয়েছে,তারা নিজেরাই কিছু নির্বাচন হেরেছে, রাজনৈতিক প্রচারে কোনও বাধা সৃষ্টি করেনি এবং ভারতীয় রাজ্যের ফেডারেল কাঠামোও বজায় রেখেছে।
উদ্ধৃতি ৩- এটি দেখায় যে ভারতের হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করে পার পেয়ে যাওয়া কতটা সহজ। তিনি হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিজেপি-র সাথে হাত মেলানোর অভিযোগ আনেন। তিনি হিন্দু চরমপন্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, এবং তার যে বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি তা প্রশ্ন তোলে যে হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এই ধরণের অভিযোগ কতটা আইনী বা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য? হ্যাঁ, প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ভারতীয় রাজনীতিতে জাতপাত বা বর্ণভিত্তিক আনুগত্য এক ভয়াবহ জঘন্য কাজ, তবে বিজেপিই একমাত্র দল যারা সমস্ত হিন্দু / ভারতীয়দের কাছে বর্ণ / জাতির সম্পর্ককে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার জন্যে আবেদন জানিয়ে যাচ্ছে।
নম্বর ৪- অধ্যাপক সেন দাবি করেছেন যে লোকেরা এখন ফোনে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে এই ভয়ে যে তাদের কলগুলি সরকার তদারকি করতে পারে। তবে কয়েক দশক ধরে বিভিন্ন সরকার ‚ যাদের মধ্যে কংগ্রেস সরকারও আছে ‚ যেভাবে ফোন ট্যাপিং করেছে প্রসিদ্ধ অধ্যাপক সেন ভালো করেই জানেন। প্রকৃতপক্ষে, তার সমর্থন পুষ্ট কংগ্রেস পার্টি স্বাধীন উত্তর ভারতের ইতিহাসে রাজনৈতিক পেশীশক্তি প্রদর্শনের জন্য কুখ্যাত। বিশেষত ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের রাজ্য সরকারগুলিকে বরখাস্ত করা এবং অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থার সময় (১৯৭৫-৭৭) এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা গিয়েছিলো। তাঁর নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেরও কমিউনিস্ট সরকার রাজনৈতিক সহিংসতার জন্যও পরিচিত ছিল এবং রাজ্যের বর্তমান সরকারও তার নাগরিকদের উপর একইভাবে জঘন্যতম সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত সরকার বিরোধীদের উপর নজরদারি করার জন্য রাজ্য সরকারের প্রশাসন এবং ফোন ট্যাপিং ব্যবহার করেছে। দক্ষিণ ভারতের অন্যতম রাজ্য কর্ণাটকের উদাহরণ দিয়ে বলা যায় ‚ ফোন ট্যাপিং সেখানে গত তিন দশক ধরে সরকারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে মোদি সরকার সম্পর্কে প্রফেসর সেন যা অভিযোগ করেছেন তা হলো বিনা প্রমাণে কেবল উস্কানি দেওয়া, কুৎসা করা ও সহজে রাজনৈতিক মাইলেজ পাওয়া ।
বিবরণ ৫- নির্দিষ্ট কিছু সংবাদপত্রে সরকারী বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করা নিয়ে বিজেপি সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি কিছুটা সত্যি বলেছিলেন। সত্যি সত্যিই মোদী সরকার তিনটি বড় বড় ইংরেজী ভাষার সংবাদপত্রে সাময়িকভাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল, তবে এটিও সত্যি যে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে সংবাদপত্র এবং সরকার উভয়ের মধ্যেই এক পারষ্পরিক সুবিধাভোগী এই আচরণ গত সাত দশক ধরে বর্তমান রয়েছে । এই ব্যাপারে মোদি সরকারের দিকে আঙ্গুল তোলা উদ্দেশ্যমূলক। তবে তিনি যে উল্লেখ করেননি ‚তা হ’ল, গত পাঁচ বছরে সরকার যে তিনটি প্রধান সংবাদপত্রকে টার্গেট তারা এতদিন ধরে সরকারি বিজ্ঞাপন ব্যয়ের বেশিরভাগ পরিমাণটাই পেয়ে আসছিলো । টাইমস অফ ইন্ডিয়া গ্রুপ পেয়েছিলো সর্বাধিক পরিমাণ সরকারী বিজ্ঞাপনের টাকা। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় কংগ্রেস পার্টি ইন্দিরা গান্ধীর সাতাশতম মৃত্যু বার্ষিকীতে সংবাদপত্রগুলিতে দেওয়া বিজ্ঞাপনগুলিতে করদাতার অর্থ অকাতরে ব্যয় করেছিল, সংবাদপত্রের সাহায্যে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারের জন্যে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গ্রুপ অফ নিউজ পেপারের প্রকাশক রামনাথ গোয়েঙ্কাকে যেভাবে ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের চাপ সহ্য করতে হয়েছিল ‚ সেই কথা প্রফেসর সেন সহজেই ভুলে গেছেন। তিনি বিজেপি সরকাররে এই তথাকথিত অন্যায়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেব বলে মনে করলেও এদেরই তিনি একসময় সমর্থন করেছেন এবং দলীয় নেতাদের তিনি সমর্থন দিয়েছেন।
মজাদার ভাবেই , বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারই ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক সেনকে ভারতরত্ন সম্মান দিয়েছিল! প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং বিজেপি সরকারের উপর তাঁর বিরতিহীন হামলার জন্য প্রফেসর সেনের উপর জনগণ যে ক্ষুব্ধ তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এবং তাদের মধ্যে অনেকেই তার থেকে ভারতরত্ন থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছিলেন। অর্থনীতিতে অধিকতর স্থিতিশীল ও ভালো কাজ করা এবং অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রফেসর জগদীশ ভগবতী ‚প্রফেসর সেনকে এই বলার জন্য উপহাস করেছেন যে যদি প্রাক্তন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বলেন তবে তিনি পুরষ্কারটি ফিরিয়ে দেবেন।
নম্বর ৬- অধ্যাপক সেন দাবি করেছেন যে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তার বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গা মামলায় তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গুলি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য আদালতকে চাপ দিয়েছেন। এটা দেখে আমরা অবাক হয়ে গেছিলাম যে নিউইয়র্কার কীভাবে এই ধরনের নির্লজ্জ মিথ্যাচারকে মেনে নিলো।
কংগ্রেস পার্টি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে রাজ্য আদালত এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট -উভয়ের তদন্তের আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে মোদীকে কোনও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রেখেছিলো।
নম্বর ৭- প্রফেসর সেন যখন শৈশবে ঢাকায় একজন মুসলিম ব্যক্তির ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ এর কথা স্মরণ করছেন, সেটি ১৯৪৪ সালে (?) বা। ১৯৪৬ (?)এর ঘটনা ‚ এবং সেই মুসলিম ভদ্রলোক হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন, তখনও কিন্তু কলকাতায় ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ঘটনা তার মনে পড়েনা। এখানে মুসলিম নেতারা দাঙ্গার উস্কানি দিয়েছিল , এবং হিন্দুরা কোনোরকম প্রতিরোধ শুরু করার আগেই কয়েক হাজার হিন্দু গণহত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সর্বস্ব লুঠ করা হয়েছিল। এটি ছিল মুসলিম লীগ কাউন্সিলের “ডাইরেক্ট অ্যাকশন” এর ডাক যা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের অন্যতম রক্তাক্ত গণহত্যার দিকে মানুষকে পরিচালিত করেছিল। অধ্যাপক সেন যা তার নিজের সুবিধার জন্যে ভুলে গেছেন তা হ’ল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ !
সেখানে পাকিস্তানী সৈন্যরা এবং তাদের পূর্ব পাকিস্তানর সাহায্যকারী রাজাকার দের দ্বারা যে বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যা করেছিল এবং নারী ধর্ষণ করেছিল, তারা হিন্দু ছিল । অধ্যাপক সেন যা সুবিধামত ভুলে গেছেন তা হ’ল পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যা, যা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে ছিলো প্রায় ২০ শতাংশ ছিল, এবং পূর্ব পাকিস্তানে ৩৫ শতাংশ! বর্তমানে এটি এখন পাকিস্তানে (পশ্চিম পাকিস্তান ) প্রায় ১.৫ শতাংশে এবং বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান ) প্রায় ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। । অধ্যাপক সেন তার হিন্দুসহনাগরিক দের জন্য কোনও চোখের জল ফেলেন না , তবে তিনি “সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা” এর জন্য চিন্তিত।
অপরদিকে বিজেপি শাসিত কোনও রাজ্যে বা দেশে গত পাঁচ বছরে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। কিভাবে? তিনি ঢাকার আমেরিকান দূত গ্যারি বাসের কাজ উল্লেখ করেননি , যিনি “রক্তের টেলিগ্রাফ: নিকসন, কিসিঞ্জার এবং একটি ভুলে যাওয়া গণহত্যা” বইটি লিখেছিলেন, যাতে তিনি অনুমান করেছেন যে কমপক্ষে ৩০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল, একটি তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলো হিন্দু। পাকিস্তানী সৈন্য এবং তাদের বহু স্থানীয় মুসলিম হাতে তারা নিহিত হয়েছিলো। মানবিকতার যে অদ্ভুত মাপকাঠি তিনি তৈরী করেছেন তা শুধুই হিন্দুদের অপরাধী হিসাবে এবং মুসলমানদেরকে শিকার হিসাবে চিহ্নিত করে। অধ্যাপক সেন এবং তাঁর “প্রগতিশীল” দুনিয়ায় অত্যাচারিত হিন্দু দের জন্যে কোনো জায়গা নেই।
অনেকেই মনে করেন, অর্থনীতির নোবেল পুরষ্কার অধ্যাপক সেনের প্রাপ্য নয়। এবং “কার্যকারিতা” এবং “সামর্থ্য” সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। তবে যথেষ্ট সাবধানতার ভাবে সাথে সাজানো এবং পরিচালিত পাবলিক ওয়েবসাইটগুলিতে সেনের বিরোধী সমালোচনাগুলি দেখতে পাওয়া যায়না।অমর্ত্য সেন শুধু মোদি সরকারের সমালোচনাই করেন তাইনা ‚ মোদি সরকারের নেওয়া বিশাল বিশাল উদ্যোগ গুলোও তার নজর এড়িয়ে যায়। যেমন মানুষের খোলা জায়গায় মলত্যাগ করা আটকানোর জন্যে টয়লেট বানিয়ে দেওয়া ‚ লক্ষ লক্ষ বাড়িতে রান্নার গ্যাসের যোগান দেওয়া ‚ দরিদ্র ‚ প্রান্তিক কৃষক‚ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাংকিং পরিষেবাগুলিতে সরল, সরাসরি প্রবেশাধিকারের সুবিধা দেওয়া যাতে মধ্যস্থতাকারী এবং দুর্নীতিগ্রস্থ সরকারী আমলাদের জালিয়াতির হাত থেকে তারা বাঁচতে পারে! এসব দেখিয়ে দেয় যে তিনি কেবলমাত্র সরকারের নীতিমালার একজন একচোখা সমালোচকই নন ‚ জনসাধারণের অনুভূতির সাথে তিনি একটি অনৈতিক প্রতারণাও করেছেন। অমর্ত্য সেনকে ধিক্কার্।