রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট মিটলেই রাজ্যসভার ভোট। বাংলার মোট সাতটি আসনে ভোট হবে। তার মধ্যে একটিতে উপনির্বাচন। বাকি ছ’টির পাঁচটি তৃণমূল পাবে, তা নিশ্চিত। যেমন নিশ্চিত যে, একটি আসন পাবে বিরোধী বিজেপি। কিন্তু কে হবেন সেই ভাগ্যবান (অথবা ভাগ্যবতী)?
রাজ্য বিজেপি সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে পাঁচটি নাম পছন্দ করছেন নেতারা। তাঁদের মূল্য লক্ষ্য এমন কারও নামে জোর দেওয়া, যিনি ‘লম্বা দৌড়ের ঘোড়া’। যাঁকে রাজ্যসভায় পাঠালে দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে দলের। যিনি হবেন ‘রাজনৈতিক’ এবং যাঁকে ‘ভবিষ্যতের নেতা’ হিসাবে তৈরি করা যাবে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার যা বিন্যাস এবং রাজ্যসভার ভোটের যা অঙ্ক, তাতে এ বার বাংলা থেকে এক জন প্রার্থীকে জেতাতে ৪২টি ভোট দরকার। খাতায়কলমে বিধানসভায় বিজেপির শক্তি ছিল ৭৫। কিন্তু ইতিমধ্যেই ছ’জন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে তাদের ভোট কমে হয়েছে ৬৯। তবে মুকুল রায়কে বিজেপির বলে ধরলে তাদের বিধায়কের সংখ্যা ৭০। এই বিধায়ক সংখ্যার সুবাদে একটি আসনে বিজেপির জয় নিশ্চিত। বিজেপির আদি দল ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিনিধি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ১৯৫২ সালে রাজ্যসভায় গিয়েছিলেন দেবপ্রসাদ ঘোষ। সে হিসাবে ৭১ বছর পরে এই রাজ্য থেকে গেরুয়া শিবিরের কোনও প্রতিনিধি নির্বাচনে জিতে রাজ্যসভায় যাবেন।
যে সাতটি রাজ্যসভা আসনে নির্বাচন হবে, তার একটিতে হবে উপনির্বাচন। তৃণমূলের অর্পিতা ঘোষ ইস্তফা দেওয়ায় তাঁর জায়গায় পাঠানো হয়েছিল গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফেলেইরোকে। তিনি ইস্তফা দেওয়ায় ওই আসনে উপনির্বাচন হবে। সেই উপনির্বাচনে প্রার্থীকে ৪৯ জন বিধায়কের ভোট পেতে হবে। কারণ, অর্পিতা যখন ২০১৭ সালে জিতেছিলেন, তখন বিধানসভার বিন্যাস অনুযায়ী তাঁকে ৪৯ জন বিধায়কের ভোট পেতে হয়েছিল। ফেলেইরো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছিলেন। কিন্তু এ বার উপনির্বাচন হলে যিনি লড়বেন, তাঁকে ৪৯ জন বিধায়কের ভোট পেতে হবে। ওই আসনটি তৃণমূলই জিতবে বলেই তারা মনে করছে।
বিধানসভায় সব মিলিয়ে শাসক দলের বিধায়কের সংখ্যা এখন ২২২-র আশপাশে। যদি মুকুলকে তৃণমূলের বলে ধরা হয়। নয়তো ২২১। প্রার্থীপ্রতি ৪২টি ভোট ধরে পাঁচ জনকে জেতাতে ২১০টি ভোট প্রয়োজন। সরাসরি অঙ্কের হিসাব বলছে, যে ছ’টি আসনে নির্বাচন হবে, তাতে লড়াই হলে তৃণমূল পাঁচটি আসন পাবেই।
২০১৭ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েন, দোলা সেন, সুখেন্দুশেখর রায়, শান্তা ছেত্রী এবং মানস ভুঁইয়া। মানস পরে রাজ্যে মন্ত্রী হওয়ায় তাঁর জায়গায় উপনির্বাচনে জিতেছিলেন সুস্মিতা দেব। ওই পাঁচটি আসনের পাশাপাশি কংগ্রেসের প্রদীপ ভট্টাচার্যের আসনটিও পাবে বলে মনে করছে তৃণমূল।
কিন্তু বিজেপির ‘সবেধন নীলমণি’ প্রার্থীটি কে হবেন? রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, ‘‘এটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত। দিল্লি থেকেই নাম ঘোষণা হবে। শুধু বাংলা নয়, অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও এটাই বিজেপির রীতি।’’ বাংলার নেতাদের মতামত নেওয়া হবে কি না জানতে চাওয়ায় সুকান্ত বলেন, ‘‘সেটা হতেই পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন শীর্ষ নেতৃত্বই।’’
সুকান্ত বলতে না চাইলেও রাজ্য বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে নাম চাওয়া হয়েছে। রাজ্যের শীর্ষ নেতারা পাঁচটি নাম বাছাইয়ের চিন্তাভাবনা শুরু করে দিয়েছেন। তবে কারা তাঁরা, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছেন না।
তবে কোন ফর্মুলায় বিজেপি রাজ্যসভার প্রার্থী বাছবে, তা এক রকম নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। রাজ্য বিজেপি চাইছে ‘বিখ্যাত’ ব্যক্তির বদলে ‘রাজনৈতিক’ কাউকে রাজ্যসভায় পাঠানো হোক। সুকান্তদের ভাবনা, আগামী ১০ বছর রাজ্যে সাংগঠনিক কাজে লাগবে, এমন কাউকে ওই নিশ্চিত আসনটিতে প্রার্থী করা হোক। একটি সূত্রের দাবি, বাংলায় দলের সাংগঠনিক কাজে যুক্ত, এমন নেতাদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে কমবয়সি নেতাদের নাম পাঠানো হবে। সে হিসাবে বর্তমান রাজ্য কমিটির দু’জনের সেই তালিকায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে এমন ভাবনা বিজেপিতে নতুন নয়। অন্য রাজ্যেও রাজ্য স্তরের ‘নতুন নেতা’ ঠিক করার কাজ এই ভাবেই করে থাকে বিজেপি। আগামী দিনে দলের হাল ধরতে পারবেন, এমন কাউকে রাজ্যসভায় পাঠিয়ে সংসদীয় পাঠ দেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে একাংশ এমনও ভাবছেন যে, একান্তই সাংগঠনিক কাউকে না পাঠানো গেলে লোকসভা নির্বাচনে ‘বাঙালি ভদ্রলোক’ ভোটারদের ‘আকর্ষণ’ করতে পারবেন, এমন কোনও বিশিষ্টকে প্রার্থী করা হতে পারে। তবে রাজ্য বিজেপির অধিকাংশ নেতা ‘তরুণ এবং সম্ভাবনাময়’ নামের প্রতিই ঝুঁকে। ‘বিশিষ্ট’ কেউ হলে তা কেন্দ্রীয় নেতারাই ঠিক করবেন।
রাজ্যসভার ভোটে প্রতি বার জল্পনায় উঠে আসে মিঠুন চক্রবর্তীর নাম। তিনি আগে তৃণমূলের টিকিটে রাজ্যসভায় ছিলেন। তবে রাজ্য বিজেপি মিঠুনের নাম নিয়ে ভাবছে না বলেই খবর। অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায়কে রাজ্যসভায় মনোনীত সাংসদ করেছিল বিজেপি। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে রূপাকে সে ভাবে সাংগঠনিক কাজে পাওয়া যায়নি। এ সব দৃষ্টান্ত দেখেই রাজ্য বিজেপি আর ‘তারকা’ প্রার্থীর দিকে ঝুঁকতে চায় না বলে জানা যাচ্ছে।
রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ (মনোনীত) স্বপন দাশগুপ্তর নাম নিয়েও জল্পনা রয়েছে। কিন্তু রাজ্য নেতাদের অনেকে স্বপনকে ‘অতিথি রাজনীতিক’ বলে মনে করেন। তৃণমূল ছেড়ে-আসা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদীর নামও কেউ কেউ বলছেন। তবে বাংলায় সঙ্ঘ পরিবার চায় না কোনও অবাঙালিকে রাজ্যের একমাত্র রাজ্যসভা আসনে প্রার্থী করা হোক। একই কারণে রাজ্য বিজেপির পর্যবেক্ষক অমিত মালব্যেরও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম। আলোচনায় নাম রয়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনে বোলপুর আসনের প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের। মোদী ও শাহকে নিয়ে বইয়ের লেখক অনির্বাণ বাঙালি। তবে মূলত দিল্লির বাসিন্দা। ফলে তাঁর নাম রাজ্য বিজেপি পাঠাবে বলে মনে করছেন না অনেকে। কারণ, বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পরে বাংলায় সে ভাবে সাংগঠনিক কাজে অনির্বাণকে পাওয়া যায়নি। তবে রাজ্য বিজেপির তালিকায় এক আরএসএস কর্তার নাম থাকতে পারে। তিনি সঙ্ঘের দায়িত্বে থাকলেও রাজ্য বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ গভীর।
তবে যে নামই রাজ্য বিজেপি পাঠাক আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঘোষণা করুন, একটি বিষয় নিশ্চিত— কাউকে ‘পুরস্কার’ দেওয়ার জন্য রাজ্যসভায় পাঠাবেন না মোদী-শাহেরা। কাউকে ‘খুশি’ করা নয়, সংগঠনের সুবিধা হবে এমন কাউকেই বাংলার নিশ্চিত আসনে প্রার্থী করবে বিজেপি।