শ্যামাপ্রসাদের তথ্যনিষ্ঠ জীবনীরচনায় তপন শিকদার।

শ্রী তপন সিকদার তখন ‘ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী স্মারক সমিতি’-র সাধারণ সম্পাদক এবং শ্রী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বে ভারত সরকারের রসায়ন ও সার দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। এইসময় তিনি সমিতির পক্ষ থেকে নিবেদন করলেন একটি সঙ্কলিত ও সম্পাদিত গ্রন্থনা “শতবর্ষের আলোয় শ্যামাপ্রসাদ”। বইটির প্রকাশকাল ২০০২ সালের জুলাই মাস। বইটির লেখক তালিকা এবং বিষয় বৈচিত্র্য দেখলেই বোঝা যাবে, কত যত্নে শ্যামাপ্রসাদের জীবন ও কর্মের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। এক দু’টি প্রবন্ধের শিরোনাম উল্লেখ করা যেতে পারে —
শ্যামাপ্রসাদ: পারিবারিক পরিবেশে — সুশান্ত কুমার সাহিত্যরত্ন;
ড. শ্যামাপ্রসাদ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় — ড. দীনেশচন্দ্র সিংহ;
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় শ্যামাপ্রসাদ — অসীমকুমার মিত্র;
একটি রাজনৈতিক মঞ্চের সন্ধানে শ্যামাপ্রসাদ — অধ্যাপক বলরাজ মাধোক;
কাশ্মীর মঞ্চে শ্যামাপ্রসাদ — অধ্যাপক রুদ্রপ্রতাপ চট্টোপাধ্যায়;
বিভিন্ন ভূমিকায় ড. শ্যামাপ্রসাদ — ড. মণীন্দ্রমোহন চক্রবর্তী;
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী — ড. প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র;
ফিরে দেখা: শতবর্ষে শ্যামাপ্রসাদ — নারায়ণ সান্যাল;
রাজনৈতিক শ্যামাপ্রসাদের মূল্যায়ণ আজও হয়নি — অধ্যাপক তথাগত রায়;

তপন বাবু নিজেও একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন উক্ত গ্রন্থে “জনসেবায় শ্যামাপ্রসাদ”। বইটির পরিশিষ্ট অংশে শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে যে সমস্ত প্রয়াত বিশিষ্টজনের লেখা সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে তাদের মধ্যে শ্রী মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর, কবিশেখর কালিদাস রায়, আচার্য দেবপ্রসাদ ঘোষ, অধ্যাপক হরিপদ ভারতী, পণ্ডিত প্রেমনাথ ডোগরা, হিরণ্ময় কার্লেকর, শ্রী যোগেশচন্দ্র বাগল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৯৫৩ সালের ১০ ই সেপ্টেম্বর সংসদে ড. শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে ড. মেঘনাদ সাহা যে ভাষণ দেন তাও সন্নিবিষ্ট রয়েছে।

এবার আসি তপন বাবুর প্রবন্ধে। প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় আর্তত্রাণে শ্যামাপ্রসাদ; তাঁর সেবাব্রতী রাজনৈতিক সত্তাকে নানানভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। যখনই প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়েছে, মানুষ রাজনীতির শিকার হয়েছে, ধর্মীয় হিংসার বলি হয়েছে — তখনই ছুটে গেছেন শ্যামাপ্রসাদ। এককথায়, বিপন্ন মানুষের সেবা যে তাঁর অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল, তা ফুটে উঠেছে বারবার তপন বাবুর লেখায়। আদর্শের প্রশ্নে তিনি দু’বার মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছিলেন। জীবিকান্বেষণের প্রয়োজনে তিনি শিক্ষাক্ষেত্র ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন নি। সেবাই প্রথম ও শেষ লক্ষ্য ছিল।
তপন শিকদার লিখছেন, “শ্যামাপ্রসাদের সেবাধর্মী রাজনীতির প্রথম প্রসাদ জুটল দুর্ভাগা নোয়াখালির ভাগ্যে। শ্যামাপ্রসাদ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য। তিনি দেখতে পেলেন মুসলিম লীগের দুঃশাসনে বাংলার হিন্দুদের মানসম্মান, বিষয়সম্পত্তি ও শিক্ষা-সংস্কৃতি সবই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর সরকারি মদতে যে হাঙ্গামা ও নারী নির্যাতন শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ নেই।” তপন বাবু লিখছেন, হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা চাপাবার কালেই নোয়াখালি জেলার উপর দিয়ে ১৭ ঘন্টাব্যাপী বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল, চাষবাস ব্যবসা-বাণিজ্য তছনছ হল। হিন্দু মহাসভা যথাসাধ্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছিল সে সময়; নোয়াখালির দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের বিষয়ে তিনি জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কলকাতায় বৈঠকে মিলিত হন। ঝড়ে নারকেল ও সুপারি চাষে প্রভূত ক্ষতি হয়; তাই জেলার তাঁত শিল্পের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নের মাধ্যমে পুনর্বাসনের বিষয়ে আলোচনা হয়; পরবর্তী ফসল ওঠার আগে পর্যন্ত ত্রাণকার্য পূর্ণোদ্যমে চালানোর পরামর্শ দেন তিনি।

১৯৪১ সালে ঢাকার দাঙ্গা বিধ্বস্ত হিন্দুদের পাশে থাকেন শ্যামাপ্রসাদ। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট দল, ফরোয়ার্ড ব্লক এ ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকে; তখন এগিয়ে এলেন শ্যামাপ্রসাদ। সবেমাত্র হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেছেন তিনি। যাতে হিন্দুদের পাশে না থাকতে পারেন, তার যাবতীয় চেষ্টা করলেন গভর্নর হাবার্ট। শ্যামাপ্রসাদও দমবার পাত্র নন; জীবন বিপন্ন করে দুই আসনের প্রাইভেট প্লেনে ঢাকা পৌঁছালেন তিনি। প্লেন চালাচ্ছিলেন জনৈক লোহিয়া নামে তাঁর মারোয়ারী বন্ধু। শ্যামাপ্রসাদ লিখছেন, “Before I got down I could see the whole of city in flames. Blair, Commissioner, at first would not allow me to enter Dacca as I was like a red rag to the bull, and the Muslims would become uncontrollable if I remained there.” শ্যামাপ্রসাদ বাঁধা মানলেন না, প্রবল জোরাজুরি করলেন, অবশেষে কমিশনার ঢাকা শহরে ঢুকতে দিলেন। সেখানে কয়েকদিন থেকে হিন্দুদের সংগঠিত করে, ত্রাণের ব্যবস্থা করে, ত্রাণ নিয়ে বৈষম্য যাতে না হয় তার জন্য সরকারি কর্মচারীদের হুঁশিয়ার দিয়ে তবে ঢাকা ছাড়লেন তিনি। পরে কলকাতা থেকে আবারও ত্রাণ সামগ্রী পাঠালেন ঢাকায়; নিজে আবার ঢাকায় গেলেন; ঢাকার হিন্দুদের আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য আগরতলায় গিয়ে মহারাজকে ধন্যবাদ জানালেন।

পঞ্চাশের মন্বন্তরে নোয়াখালিতে সেবাকাজ চালিয়েছিলেন তিনি। নোয়াখালি জেলা শিক্ষক সমিতি শ্যামাপ্রসাদের মাধ্যমে দুর্দশাগ্রস্ত শিক্ষকদের জন্য আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভা দেশব্যাপী প্রচার চালিয়ে বাংলার জন্য নগদ অর্থ, বস্ত্র ও খাদ্যশস্য সংগ্রহ করল। ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য তিনি নিজে Bengal Hindu Mahasabha Relief Committee -র সভাপতিত্ব করলেন। বহু মানুষকে বিনামূল্যে খাদ্য প্রদান করা হল; এছাড়াও চিপ ক্যান্টিনের মাধ্যমে সুলভে খাদ্যসামগ্রী বিক্রি হল, মিল্ক ক্যান্টিনের মাধ্যমে গরীবদের দুধ বিতরণ করা হল। অনাথাশ্রম তৈরি করে দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের রাখা হল।

শ্যামাপ্রসাদের মেদিনীপুরের সেবাকাজ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন তপন বাবু। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মেদিনীপুর একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। মেদিনীপুরবাসীর নানান দুর্ভোগে তাঁর সহানুভূতি ও অশ্রু বিসর্জন ছিল। ১৯৪২ সালে ভারতছাড়ো আন্দোলনের বর্ষেই ১৬ ই অক্টোবর মেদিনীপুরের বুকে আছড়ে পড়েছিল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। বাংলার বুকে নেমে এলো প্রবল অন্ধকার। প্রতিশোধপরায়ণ ব্রিটিশ সরকার বিপর্যয়-বিধ্বস্ত মেদিনীপুরবাসীর জন্য কোনো ত্রাণের ব্যবস্থা করল না। দুর্যোগের সংবাদ ১৫ দিন চেপে রাখা হল, কোন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেওয়া হল না। বিপর্যয়ে দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, বারোআনা গবাদিপশু মারা গেল, এক লক্ষ বাড়ি ধ্বংস হল। সিভিলিয়ানরা দুর্গতদের জন্য এগিয়ে এলেন না। এগিয়ে এলেন শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার দরদী শ্যামাপ্রসাদ বিশেষ করে কাঁথির মানুষের বন্ধু হয়ে। তপন শিকদার লিখছেন, “শান্ত বঙ্গোপসাগর রুদ্রের তালে বুকে নাচন জাগিয়ে শান্তির নীড়কে করেছিল বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। তীরের অনেক গ্রাম মুছে গেল। অনেক প্রাণ ঝরে গেল পৃথিবী থেকে। বিপন্ন মানবতা সেদিন একটি মানুষকে দেখেছিল তাদের পাশে পাশে। তিনি ড. শ্যামাপ্রসাদ।”
শ্যামাপ্রসাদ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ‘Bengal Cyclone Relief Committee’ গড়ে তুললেন। ডা. বিধানচন্দ্র রায়কে কোষাধ্যক্ষ করে নিজে তার সভাপতি হলেন এবং অধ্যাপক সতীশচন্দ্র ঘোষকে সম্পাদক করলেন। তার আগে তিনি মেদিনীপুরের বিদ্রোহী পরিবারবর্গকে সাহায্যের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘Sufferers’ Relief Committee’. দুর্গতদের সাহায্য পৌঁছে তিনি ব্রিটিশদের অবহেলার চিত্র বিশ্বময় ছড়িয়ে দিলেন। মেদিনীপুরের মানুষের জন্য কী অসামান্য পরিশ্রম করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, তার অনুপুঙ্খ আলোচনা আছে এই প্রবন্ধের পরতে পরতে। জনদরদী শ্যামাপ্রসাদের ভাবমূর্তির এক অনবদ্য রূপ দেখেছিল মেদিনীপুরবাসী, যখন অন্য কোনো নেতাকে ধারে-কাছে পাওয়া যায় নি। সশরীরে উপস্থিত থেকে, সমবেদনা-সহানুভূতি জানিয়ে, যথাসাধ্য ত্রাণ ও সাহায্যের বিষয়ে তাঁর মতো রাজনীতিবিদ আজও বিরল। পুরো প্রবন্ধে তপন বাবু দেখিয়েছেন, শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক জীবন আসলে মানবতাবাদের অন্য নাম। তিনি লিখলেন, “আর শেষও ঘটল তেমনিভাবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিপন্ন হিন্দুদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে এবং দেশের অখণ্ডতা রক্ষার্থে অমূল্য প্রাণবিসর্জনের মাধ্যমে।”

কল্যণ গৌতম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.