১- প্রথম ছবিটি অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বের। অবলোকিতেশ্বর যখন মোক্ষলাভ করেছেন, যখন তিনি পা বাড়িয়েছে নির্বাণের দিকে‚ হঠাৎ পেছনের দিক থেকে শুনলেন জীবের হাহাকার! তিনি ফিরে তাকালেন। দেখলেন অজস্র মানুষ, জীব-জন্তু, গাছ-পালা সবাই আর্তনাদ করে বলেছে, হে অর্হত, আপনি চলে যাচ্ছেন, হে সম্বুদ্ধ, আপনি মোক্ষপ্রাপ্ত, আমরা দেখছি আপনার নির্বাণ হবে, আপনি লয় পাচ্ছেন, এই দুঃখময় সংসার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন, আপনার আর পুনর্জন্ম হবে না, কিন্তু আমাদের কি হবে? আপনি আমাদের কথা ভাবুন, আমাদের পথ দেখান!

আর এগোতে পারেন নি অবলোকিতেশ্বর। এক পা ইতিমধ্যেই বাড়ানো হয়ে গিয়েছিলো‚ সেই অবস্থাতেই তিনি থেমে গেলেন। দ্বিতীয় পা আর এগিয়ে দিলেন না। তিনি নিজের মোক্ষ চান না। তিনি সবাইকে মুক্তি দিতে চান দুঃখময় জগৎ থেকে। জীবের কান্না শুনে জগৎকে পরম কারুণ্যে অবলোকন করেছিলেন, তাই অবলোকিতেশ্বর।

ইতিহাস সাক্ষী, তান্ত্রিক বাঙালি গৌতম বুদ্ধকে নয়, বরং নিজের ঘরের মানুষ হিসাবে উপাসনা করেছে মহাযান-বজ্রযান-তন্ত্রযান-সহজযান ধর্মের মূল প্রেরণা এই অবলোকিতেশ্বর মূর্তিকে।

.
.
.
২- নরেন্দ্রনাথ গেছেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে কাশীপুরে। রামকৃষ্ণের কাছে তিনি চাইলেন মুক্তি- সমাধিতে শুকদেবের মতো লীন হয়ে থাকতে।

কিন্তু রামকৃষ্ণ তাকে মুক্তি দিলেন না। তিনি তিরস্কার করে বলেছিলেনঃ ‘ছিঃ ছিঃ, তুই এতবড় আধার, তোর মুখে এই কথা! আমি ভেবেছিলাম, কোথায় তুই একটা বিশাল বটগাছের মতো হবি, তোর ছায়ায় হাজার হাজার লোক আশ্রয় পাবে, তা না হয়ে তুই কিনা শুধু নিজের মুক্তি চাস!’

এই ঘটনার অনেক পরে বিবেকানন্দ বলেছিলেনঃ ‘…এই জগতের দুঃখ দূর করতে আমায় যদি হাজারো জন্ম নিতে হয়, তাও নেবো। তাতে যদি কারও এতটুকু দুঃখ দূর হয় তো ক’রব।’

.
৩- এবার আসি সরাসরি রাজনীতির ইতিহাসে। এই যে ছবিটা দেখছেন। এনার নাম শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। নাম তো শুনা হি হোগা। একবার না‚ দুইবার হেলায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। সেই মন্ত্রীত্ব‚ যা পাওয়ার জন্যে মানুষ কি না করতে পারে। খুন‚ অপহরণ‚ বিশ্বাসঘাতকতা‚ নিজেকে বিক্রি করা‚ আরও কতকিছু!

প্রথমবার মন্ত্রীত্ব ছাড়লেন ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪২ সালে। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এই মন্ত্রীসভা গঠনের একটা ইন্টারেস্টিং ইতিহাস আছে। পরে কোনো পোস্টে বলছি। যে মন্ত্রীসভাকে মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রী ছিলো বলে মিথ্যে বলে বেড়ায় কমিউনিস্ট জঞ্জালগুলো। তা যাই হোক‚ ১৯৪২ সালে ভারতজুড়ে চলছে গান্ধীর আগস্ট আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অন্যতম বড় ভূমিকা নিয়েছিল মেদিনীপুরের মানুষরা। আর এই মেদিনীপুরের বিপ্লবীদের উপরেই পুলিশের অত্যাচার দেখে মনে আঘাত লাগে তার। মূহুর্তের মধ্যে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে নেমে আসেন মানুষের মাঝে।

দ্বিতীয়বার আবার একবার মন্ত্রী হলেন। এবার নেহেরুর মন্ত্রীসভায়। তিনি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। এখন পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবেই শিল্পমন্ত্রীর গুরুত্ব বুঝবেন না‚ কিন্তু অন্য যেকোনো মন্ত্রীসভায়‚ বিশেষত নেহেরুর মতো সমাজতান্ত্রিক মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রীর গুরুত্ব সাংঘাতিক। ক্ষমতাও তেমনই। উভয়ার্থেই। কিন্তু বিদ্রোহ আর দেশপ্রেম যার রক্তে মিশে রয়েছে তাকে মন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আটকে রাখবে কে?
এখানেও প্রতিনিয়ত চলতে লাগল নেহেরুর সাথে তীব্র বাদানুবাদ। উপমহাদেশের বিশেষত পাকিস্তানের হিন্দুদের উপর অত্যাচার নিয়ে নেহেরুকে প্রতিদিন তুলোধুনো করেন তিনি। নেহেরুকে আক্রমণ করে করা তার একটি মন্তব্য ইতিহাসের পাতায় উঠে গেছে – “আপনি ভারত ভেঙ্গেছেন। আর আমি ভেঙ্গেছি পাকিস্তান।
পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০ এর দাঙ্গার প্রতিবাদে সবার সামনেই নেহেরুকে তুলোধুনো করেন তিনি। দিন টা ছিলো ১৪ এপ্রিল, ১৯৫০! কারণ নেহেরু লিয়াকত চুক্তির দ্বারা পাকিস্তানের হিন্দুদের দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেছিলো নেহেরু। এছাড়া তো কাশ্মীর নিয়ে নেহেরুর নীতি ছিলোই।

সারা দেশের জন্যে এক নীতি নিয়ে চললেও বন্ধু আব্দুল্লার রাজ্য কাশ্মীরে আলাদা নিয়ম জারি করলেন নেহেরু। কাশ্মীরের জন্যে বরাদ্দ হল আলাদা পতাকা‚ আলাদা সংবিধান। একটা দেশের মধ্যেই আরেকটা দেশ। বস্তুত ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর আরেকবার দেশভাগ করেছিলেন নেহেরু। কাশ্মীরকে আলাদা সংবিধান দিয়ে। বিরোধিতায় গর্জে উঠলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ভারতের অঙ্গহানি আর তিনি মেনে নেবেন না। ‘এক দেশ মে দো বিধান নেহি চলেঙ্গে (এক দেশে দুই আইন চলবে না)’- তার এই স্লোগান তখন দক্ষিণপন্থী ভারতীয়দের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

কিন্তু শুধু স্লোগান দিয়ে তো হবে না। দেশের কাজের জন্যে চাই মাঠে নেমে লড়াই। নেহেরুর ভেস্টেড ইন্টারেস্টের বিরুদ্ধে মুখোমুখি লড়াই। যে লড়াই তার মন্ত্রীসভায় থেকে কখনোই সম্ভব নয়। অগত্যা আবারও পদের মোহ‚ নিরাপদ জীবনের লোভ‚ লাল বাতি‚ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা – সবকিছু হেলায় পায়ে দলে পদত্যাগ করলেন তিনি। নেমে আসলেন মানুষের মধ্যে। গ্রাসরুট লেভেলে আন্দোলন করে ভারতবর্ষের অখন্ডতা ফিরিয়ে আনার জন্য। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে রহস্যজনকভাবে নিহতও হয়েছেন কাশ্মীরের জেলের ভেতর। একদল অনুগত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে সাথে নিয়ে কাশ্মীরে গিয়ে উপস্থিত হন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীও এই আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই ভীতসন্ত্রস্ত কাশ্মীর সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। আর সেই শ্রীনগরেই পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সম্পূর্ণ সুস্থ শ্যামাপ্রসাদের আকষ্মিক মৃত্যু হয় এই আজকের তারিখে‚ ২৩ শে জুন‚ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ। বহু মানুষের সন্দেহ‚ রাজনৈতিক আক্রোশ মেটাতে হত্যা করা হয়েছে তাকে।

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানো যে মানুষটা নেহেরুভিয়ান কায়দায় আরাম করে পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারত সারাটা জীবন‚ নিজের বিবেকের তাড়নায়‚ অসহায় ভারতবাসীকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করে নেমে আসলেন মানুষের মাঝে। করুণভাবে নিহতও হলেন শাসক শ্রেণীর ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে।

এইভাবেই হয়তো একটা জাতির চেতনা প্রবাহিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে! নিজের সুখের জন্যে নয়‚ নিজের সমৃদ্ধির জন্যে নয়‚ সকলের মঙ্গলের জন্যই তোমার জীবন বলিপ্রাপ্ত।

সব্বে সত্তা সুখিতা ভবন্তু! জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক – এটাই হলো বাঙ্গালীর চিরকালীন বীজমন্ত্র।

©সৌভিক দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.