তিন লাইনের একটি হাতে লেখা ‘সুইসাইড নোট’। প্যাডের ছেঁড়া পাতায়। সিলিং ফ্যান থেকে শাড়ির ফাঁসে ঝুলন্ত দেহটির পা মুড়ে রয়েছে বিছানার উপরে। ভাঁজ করা ছেঁড়া পাতাটা পড়ে ছিল চিকিৎসক প্রজ্ঞাদীপা হালদারের (৩৭) সেই দেহের পাশেই। তাতে নীল কালিতে লেখা, ‘যে প্রহারের দাগ নিয়ে চলে গেলাম / এর শোধ কেউ নেবে। / আমার মৃত্যুর জন্য কৌশিক দায়ী।’
প্রজ্ঞাদীপা সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসককে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে থাকতেন। পদমর্যাদায় তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল। লেখালেখির শখ ছিল প্রজ্ঞাদীপার। সেটা যেমন মুদ্রিত হরফে, তেমনইসমাজমাধ্যমেও। নিয়মিত কিছু না কিছু পোস্ট করতেন। মন ছুঁয়ে যাওয়া কোনও লেখা নজরে পড়লে পরিচিত বা অপরিচিত, প্রশংসা করতেন অনেকেই। তাই ফেসবুকে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজারেরও বেশি। গত সোমবার প্রজ্ঞাদীপার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয় ব্যারাকপুর সেনা ছাউনির অফিসার্স কোয়ার্টার্স ‘ম্যান্ডেলা হাউস’-এর ২০ নম্বর ফ্ল্যাটের একটি ঘর থেকে। প্রাথমিক ভাবে ওই রাতে পুলিশ ঘটনাটি আত্মহত্যা বলেই ভেবেছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে পেয়ে এবং প্রজ্ঞাদীপার প্রণয়ীকে একাধিক বার জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে বেশ কিছু প্রশ্ন ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।
পুলিশ জানিয়েছে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলছে, প্রজ্ঞাদীপার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। সেগুলি মৃত্যুর অব্যবহিত আগের বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে করছেন তদন্তকারীরা। যে ঘর থেকে ওই চিকিৎসকের ঝুলন্ত দেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। বিছানার পাশেই টেবিলের উপরে রাখা হুইস্কির বোতল, কাচের গ্লাসে সেটিরপড়ে থাকা অবশিষ্টাংশ, লন্ডভন্ড বিছানা-বালিশ, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে থাকা তাকে রাখার জিনিসপত্র— এমন অনেক অসঙ্গতি তদন্তকারীদের মনে একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে পুলিশের প্রশ্ন, ওইদিন প্রজ্ঞাদীপাকে কি তাঁর সঙ্গী নেশা করে মারধর ও যৌন হেনস্থা করেছিলেন?
ঘটনাটি আত্মহত্যা না খুন, এই বিতর্কে অবশ্য তোলপাড় সমাজমাধ্যম। বিভিন্ন জন তাঁদের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশেরভূমিকা নিয়েও। যদিও সেনাবাহিনীর ওই পদস্থ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর থেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছে ইস্টার্ন কমান্ড। অভিযুক্ত চিকিৎসকও অসুস্থতার জন্য বেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।ব্যারাকপুরের নগরপাল অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘যে ঘর থেকে প্রজ্ঞাদীপার দেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেটি সিল করে দেওয়া হয়েছে। ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে গোটা ঘরের। আমাদের নজরদারি আছে পুরোমাত্রায়। ফেসবুকে মন চাইলেই অনেক কিছু লেখা যায়। খুব স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে কোনও রকম হঠকারিতা আমরা চাই না। আত্মহত্যা না খুন, তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে ময়না তদন্তের রিপোর্ট বলে দিচ্ছে, আত্মহত্যা হলেও তাতে প্ররোচনা ছিল।’’ তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, অভিযুক্ত চিকিৎসকের স্ত্রী ও দুই মেয়ে রয়েছেন। তাঁরা কলকাতায় থাকেন। তাঁদেরও খোঁজ চলছে।
প্রজ্ঞাদীপার মাসতুতো দাদা কুমারশঙ্কর দাস মঙ্গলবার পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। সোমবার মধ্য রাতে এই ঘটনার পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও পরিবারের লোক না আসা পর্যন্ত সেখানেকাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরিবারের পক্ষ থেকে কুমারশঙ্করই পুলিশের সঙ্গে সাক্ষী হিসাবে ওই ঘরে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘মানসিক ভাবে খুব দৃঢ় ছিল বোন। ভালবেসে এক জন মানুষের সঙ্গে সারা জীবন কাটাতেচেয়েছিল। তাকে চলে যেতে হল। কেন যেতে হল, সে জবাব তো ওই ‘ভরসা’র মানুষটিকেই দিতে হবে।’’