কোথায় গেল রথের দিনে যাত্রাপালার পাতাভর্তি বিজ্ঞাপন?

Story image

আষাঢ় আম-কাঁঠালের মাস। রথযাত্রার মাস। রথের দিন প্রতিটি সংবাদপত্রে যাত্রাপালার পাতাভর্তি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে? ২০১৪-১৫ অবধিও লক্ষ্য করা যেত যাত্রার বিজ্ঞাপন। মোটা কাগজ হত। প্রায় ২৪-২৫ পাতার। আজ আর যাত্রার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে না। সময় পাল্টেছে। সময়ের হাত ধরে এসেছে ওটিটি। গ্রামবাংলায় যাত্রার দাপট ক্রমশ কমেছে। তবুও এমন দিনে যাত্রাপালার কথা মনে পড়ে।

আশির দশকের শুরুতে গ্রাম বাংলার সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলেছিল ‘মরমী বধূ’ নামের এক যাত্রাপালা। জসীম উদ্দিনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অবলম্বনে নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছিল। নট ও নাট্যকার নির্মল মুখোপাধ্যায় আর মীনাকুমারী তখন গ্রামের পর গ্রাম রাত জেগে অভিনয় করছেন। ‘মরমী বধূ’ পালা দেখতে ১০/১৫ কিলোমিটার ভ্যান রিকশা ভাড়া করে যেতেন বাড়ির মেয়েরা। গ্রামে যেহেতু কাছাকাছি আত্মীয়ের বাড়ি থাকে যাত্রাপালার আগের দিন থেকে তাই ভিড় জমাতেন মানুষ। নিখাদ প্রেমের এই পালা বলা যায় শরৎচন্দ্রের দেবদাসকে হারিয়ে দিয়েছিল। যাত্রা-প্যান্ডেল থেকে চোখ মুছতে মুছতে বের হতেন না এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা পাওয়া ছিল দুষ্কর।

তার আগে অবশ্য ‘বিবি আনন্দময়ী’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘মীরার বঁধুয়া’, ‘গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম’, ‘মা মাটি মানুষ’ বাংলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তার চেয়ে ‘মরমী বধূ’ ছিল গ্রামের মানুষের অনেক কাছের। তখনও জনপ্রিয়তার বিচার হত কত টিকিট বিক্রি হল আর হাটে-বাজারে, মাঠে ঘাটে কোন যাত্রাপালা আলোচনা হচ্ছে, তা দিয়ে। গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, মীরার বঁধুয়া ছিল পৌরণিক পালা। হিন্দু, এমনকি মুসলমানদের একটা অংশ এই দুই যাত্রাপালা দেখতে ছুটতেন। এর বড়ো কারণ বীণা দাশগুপ্ত আর বেলা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়। তবে এই দুই নায়িকাকে ছাপিয়ে মীনাকুমারী হয়ে উঠেছিলেন গ্রাম বাংলার পার্বতী বা লায়লা মজনুর লায়লি।

এখন যেমন দুর্গোপুজোর রমরমা, পুজো শেষ হলেই পরের বারের থিম নিয়ে ভাবনা শুরু হয়ে যায়, তখন প্যান্ডেলের পরের বারের বায়না দেওয়া হত রথযাত্রায়। প্রতিবছর যেমন হালখাতা হয়, তখনও যাত্রাপালায় হালখাতা হত। বায়না দেওয়া হত, উল্টোরথে বুকিং নেওয়া হত ঠিকই, তবে পছন্দমতো তারিখ পাওয়া যেত না।

গ্রামে তখন ‘শার্দুল জারাক খান’, ‘আমি সুভাষ বলছি’, ‘হারেমের কান্না’-ও বেশ জনপ্রিয় ছিল। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকটাতেও বেশ জনপ্রিয় ছিল যাত্রাপালা। তার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ ভাটার টান। যাত্রার স্বর্ণযুগ বলা হয় সত্তরের শুরু থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়টাকে। অনেকে বলেন, ততদিনে গ্রামে ঢুকে পড়েছে টেলিভিশন, বিনোদন ঘরের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ায় যাত্রার নাকি কদর কমেছিল। কিন্তু যেসব কমিটি পালার আয়োজন করত তাদের মতে, নির্মল মুখার্জি, মীনাকুমারী, ইন্দ্র লাহিড়ী, ছন্দা রায়, বেলা মুখার্জি, বীণা দাশগুপ্ত, তরুণ কুমার, শিবদাস মুখার্জি যাত্রাজগৎ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন ততদিনে পরবর্তী ক্ষেত্রে যে পালা এসেছিল তা মানুষের মন ততটা জয় করতে পারেনি বলে লোকসান হতে শুরু করল। বড়ো কমিটিগুলো সরে এল পালা আয়োজন করা থেকে। তাই যাত্রাশিল্পে ভাটা পড়তে শুরু করল।

একসময় যেমন উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট ছিল যাত্রাপালার পীঠস্থান। কোলিয়ারি এলাকার বুকিং হত রানিগঞ্জ ও বর্ধমান থেকে। দুই মেদিনীপুরের বুকিং হত তমলুক বা নন্দকুমার থেকে। এখনও হয় ঠিকই, তবে সে কৌলিন্য আর নেই। একসময় যাত্রা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অভিনয় দেখতেই মানুষ ভিড় জমাতেন। পরবর্তীকালে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের একটা অংশ নেমে পড়েন আসরে। হালআমলে টেলিভিশনের রাতারাতি স্টারেরাও চুটিয়ে মাচা, ফাংশন ইত্যাদি করেন। তাঁদের দেখতে ভিড় জমান উৎসাহী মানুষ।

তা বলে কি পালার কদর কমেছে! আশির দশকে নামী পালা দেখতে যেমন মানুষ ছুটতেন, একই সঙ্গে গ্রামে হত মনসার ভাসান, বনবিবি চম্পা, রূপবান যাত্রা, বেহুলা-লখিন্দর, লায়লা মজনুর মতো অত্যন্ত জনপ্রিয় যাত্রাপালা। গ্রামে খেটে খাওয়া মানুষ হিন্দু-মুসলমান সন্ধের পর একসঙ্গে বসতেন রিহার্সালে। এক-একটা দল দু-তিনটে করে পালা নামাত। সেরা অভিনেতা অভিনেত্রীকে খুশি হয়ে বহু মানুষ পুরস্কার দিতেন, তাঁদের নাম ঘোষণা করা হত মাইকে, এই নাম ঘোষণার ব্যাপারটা নামী যাত্রাতেও হত, গ্রামের মানুষ মনে করতেন এতে তাঁর সম্মান বেড়েছে, দেখাদেখি আরও অনেকেই ছুটে আসতেন স্টেজে। অভিনেতাদের মোটা টাকা ব্যক্তিগত আয় হত। গ্রামে একসময় যাত্রাপালার প্রতিযোগিতা হত। সেসব দিন এখন আর নেই।

বাংলায় যাত্রাপাড়া বলতে একসময় একবাক্যে সকলে চিনতো চিৎপুরকে— যাত্রার পীঠস্থান। রথের দিন চিৎপুরের চেহারা যেত পাল্টে। আলো-ফুল দিয়ে সাজানো হত যাত্রা পার্টির অফিসঘর। অতিথিদের থাকত গোলাপ জল, মিষ্টিমুখ, শরবত আর ক্যালেন্ডারের ব্যবস্থা। নায়কেরা সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে নির্দিষ্ট দিনে পালা বুক করে যেতেন। অসম, ত্রিপুরা বা এই রাজ্যের জেলাগুলি থেকে দলে দলে লোক আসতেন পালার বায়না করতে। গ্রামেগঞ্জে চিৎপুরের দল আনা সহজসাধ্য ছিল না সেসময়। একে তো দলের জন্য বিরাট টাকার সংস্থান, তারপর ছিল সরকারি অনুমতি আদায়ের ঝামেলা। এ সব সামলাতে পারা অর্থবল, লোকবল যাঁদের ছিল, তাঁরাই নিয়ে আসতেন চিৎপুরের যাত্রা। রথের দিন খবরকাগজেও দেখা যেত ‘বিশেষ’ ব্যাপার। মূল কাগজ যদি ৮ পাতার হয়, তবে ক্রোড়পত্রটি হবে ২৪ পাতার। কাগজের কলেবর এভাবেই ফুলে-ফেঁপে উঠত। কাগজের পাতা জুড়ে থাকত নায়ক-নায়িকাদের পমেটম-মাখা মুখ, কাজলটানা চোখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.