ছোটোবেলার রথ মানে জলছাপের মতো লেগে থাকা একটা গল্প – আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়া তিথি। ছোটোবোন সুভদ্রার বড়ো আবদার সে বেড়াতে যাবে। অগত্যা বোনের শখ পূরণ করতে দুই দাদা জগন্নাথ আর বলরাম তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন মাসির বাড়ির উদ্দেশ্যে। এই তো রথযাত্রা। কিন্তু রথ কোথায় পাওয়া যাবে, তাঁকে সাজাবেই বা কারা? এ সবই ছিল খেলার মতো – রথকে উপলক্ষ্য করে সবাই মিলে আনন্দ করাটাই ছিল সব। রথের আগের দিন বাবা বা জেঠুরা কিনে এনে দিত একটা কেরোসিন কাঠের বা কার্ডবোর্ডের রথ। রংচং তেমন থাকত না সে রথে। আমরা সারা সকাল ধরে তাতে নানারকম রং-বেরঙের কাগজ সাঁটাতাম আঠা দিয়ে। কেউ কেউ ফুল পাতা দিয়েও সাজাত। ওই রথের দৈন্যদশা দূর করে তাকে একরকম আভিজাত্য দেওয়া আর কী! অবশ্য অনেক সময় এই কাজে বড়োদের মধ্যে কেউ না কেউ হাত লাগাতেন। সব সময় একা একা একটা বাচ্চার পক্ষে পেরে ওঠা মুশকিলেরও বটে। তবে খুব বাচ্চা হলে আলাদা কথা – আমার সে বয়সের কথা মনেও পড়ে না সেভাবে। যতদূর মনে পড়ে আমার পাড়ায় একজন সর্বজনীন জেঠিমা ছিলেন। তিনি আমাদের রথের আভিজাত্য ফেরাতে সাহায্য করতেন। আর ফুলের প্রয়োজন মেটাতেন এক ব্রাহ্মণী পিসি। তাকে আগেরদিন আবদার করে বলে রাখতে হত কিছু ফুল বেশি করে তুলতে। তিনি ভোরবেলা পাড়া ঘুরে প্রতিদিন ফুল জোগাড় করতেন। সেদিন সকালে আমাদেরকে আলাদা আলাদা ভাগ করে কিছু ফুল দিতেন।
প্রথমে তিন মূর্তিকে জল দিয়ে ধুয়ে দোতলা রথের উপরের তলায় তাঁদের দিতাম বসিয়ে (মাটির তৈরি মূর্তিও পাওয়া যেত, তাদের যদিও স্নান করানো হত না)। নিচের তলায় দেওয়া হত বাতাসা, নকুল দানা, মিছরির মতো সহজলভ্য প্রসাদ। আর থাকত ব্রাহ্মণী পিসির থেকে আদায় করা ফুল। টগর, জবা, অপরাজিতা, গন্ধরাজ ইত্যাদি নানা ফুল – যার ভাগে যা পড়ত তাই নিয়েই দেওয়া হত নৈবেদ্য। যদিও ঠিক ঈশ্বরকে চড়ানোর মতো নৈবেদ্য হিসেবে ধরা হত না এটাকে। ফুল ভাগ নিয়ে আমাদের কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। প্রতিযোগিতা ছিল রথের আকার নিয়ে। সকলের বাড়ি থেকে একরকম রথ কিনে দেওয়া হত না। তখন আর্থিক সামর্থ্য ব্যাপারটা বুঝতাম না, ফলে বাড়িতে এসে বায়না ধরতাম প্রায়ই। অবশ্য কারো কারো মজবুত কাঠের বা লোহার রথ থাকত – তারা বছর বছর সেটাকেই সাজিয়ে নিয়ে বেরত।
বিকেলবেলা টানা হত রথ। সেই সারা দুপুর আমাদের চোখে ঘুম থাকত না। অবশ্য বাড়ির বড়োরাও খুব জোরাজোরি করতেন না সেদিন। একেবারে চার থেকে দশ – নানা বয়সী ছেলেরা মিলে রাস্তায় নেমে রথ টানতাম। বড়োরাও কখনও কখনও সঙ্গ দিত। কেউ কেউ বাজাত কাঁসর ঘণ্টা। বিশেষত যাদের বাড়িতে দু-তিনজনের জন্যে একটাই রথ থাকত, তাদের একজন ঘণ্টা বাজাত, একজন টানত রথ, পালা করে করে। অবশ্য বড়োরাও বাজাতেন এভাবে। আমরা সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে রথ টানতাম আর বাড়ি বাড়ি নকুলদানার বিনিময়ে দক্ষিণা আদায় করতাম। দক্ষিণা তো নয়, সে হল পয়সা। যা শ্রীক্ষেত্রের পাণ্ডাদের মতোই আমাদেরও নিজেদের পেটের তাগিদেই আদায় করতাম – না, বাড়ির লোক এ সবের ভাগিদার হতেন না কদাপি। যদিও রথ টানা কালে তার ভঙ্গুরতা হোক বা পর্যাপ্ত গতিকে গাজোয়ারিতে টেনে নিয়ে যাওয়া – যে কোনো কারণেই হোক, কখনও কখনও কার্ডবোর্ডের রথ একেবারে দশরথ হয়ে খানখান ছড়িয়ে পড়ত।
সকলের বাড়ি থেকে রথ কিনে দেওয়া হত না। যাদের রথ থাকত না, তারাও ভিড় জমাত, অন্য কারো রথ টানবার আশায়। ছোটোবেলায় কোনো বিভেদনীতি মনে গাঁথা থাকত না। ফলে সবাই মিলেমিশে একটা আনন্দে সামিল হতাম – সেই আমাদের রথ উৎসব। অবশ্য কখনও কখনও কোনো ছেলেকে পিল্লি ফলের গায়ে ঝাঁটাকাঠি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে সুন্দর রথ তৈরি করতে দেখেছি – তার চাকা চলত না বটে, তবু সেটা টানা হত ঘষটে ঘষটে। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি – রথ থাকা না থাকার মধ্যে, বড়ো রথ ছোটো রথের মধ্যে, সুন্দর করে সাজানো আর না সাজানোর মধ্যে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, একটা সাংস্কৃতিক বৈষম্যও থাকত। কিন্তু শৈশব সঙ্গ পেতে ভালোবাসে, একসঙ্গে দল বেঁধে উৎসব পালনই তখন একমাত্র লক্ষ্য। এ অবিশ্যি যে কোনো উৎসবেরই মূলে থাকে। সকলেই যে যার মতো করে তা পালন করে – যে যার মতো করেই তার ধরনও খুঁজে নেয়।না, বাচ্চা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এ বিষয়ে উৎসাহ খুব একটা চোখে পড়ত না। হয়তো পুরীধামের রীতির অনুকরণের জন্যই। এমনও হতে পারে আমাদের লিঙ্গভেদের সামাজে যে কোনো খেলাকে লিঙ্গচিহ্নে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতার জন্যই এমনটা হয়।
এখনও এভাবে বাচ্চাদের ছোটো রথ টানার রেওয়াজ রয়েছে। তবে উৎসবের খণ্ডচিত্র হিসেবে ততটাও নয় যতটা বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য রক্ষা এবং পারিবারিক ধর্ম প্র্যাক্টিসের নমুনা হিসেবে। দোকানে দোকানে এখনও একতলা রথ, দোতলা রথ কিনতে পাওয়া যায়। তার স্বরূপ বদলে গেছে – কার্ডবোর্ডের বদলে প্লাই এসেছে, রঙিন কাগজ বদলে গিয়ে এসেছে রং-বেরঙের লাইটিং; পাড়ার রাস্তায় বেরিয়ে সমবেত উদযাপন নয় – এখন এ প্র্যাক্টিস চার দেওয়ালের ফ্ল্যাট বাড়িতে। সেই রবীন্দ্রনাথের রথের রশি-র কথা মনে পড়ে যায় – যেখানে সমবেতভাবে রথ টানতেই রথ চলতে শুরু করে; সমাজের উঁচু-নিচু খানাখন্দকে সমান না করলে রথ (রশিদেবতা) চলবেন না। আমরা কি তবে পিছন দিকে হাঁটতে শুরু করেছি?
সৌরভ দাস