#পর্ব_৯
তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা। তিনিই অভয়ামঙ্গল বনদেবী যা ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের অরণ্যানী স্তবের সাথে সম্পৃক্ত। চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু-আখ্যানে তিনি দ্বিভূজা, তাঁর প্রতীক মঙ্গলঘট, পূজার উপচার মাঙ্গল্য ধানদূর্বা।তিনি পশুমাতারূপে পূজিতা।
ওঁ জয় ত্বং দেবি চামুণ্ডে জয় ভূতাপহারিণি।
জয় সর্বগতে দেবি কালরাত্রি নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণম অহম ঈশান এব।কারিতাস্তে যতোহ্তস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান ভবেৎ।।
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দেবী সংস্তুতা।মোহঐতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।।
প্রবোধং চ জগৎস্বামী নিয়তাং অচ্যুতো লঘু।বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুং এতৌ মহাসুরৌ।।
বিষ্ণুর শরীর গ্রহণ করেতুমি-ই সব করো, তোমার স্তুতি করে কতজন শক্তিমান হয় ।।
তোমার প্রভাবে দেবী ,থামাও তুমি এই প্রায় অপরাজেয় অসুরদের।মোহাচ্ছন্ন করে দাও দুই দুর্ধর্ষ অসুর মধু আর কৈটভকে ।।
জগৎস্বামী (বিষ্ণুকে) তুমি তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগিয়ে তোল ।আনো তাঁকে সেই বোধে যাতে তিনি ধ্বংস করেন এই দুই মহা অসুরকে ।।
দেবী দুর্গা শাক্ত ধর্মে সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবী, বৈষ্ণব ধর্মে তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর অনন্ত মায়া হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয় এবং শৈবধর্মে দুর্গাকে শিবের শক্তি পার্বতী হিসাবে অর্চনা করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনিই কেনোপনিষদে বর্ণিত হৈমাবত দুর্গা হিসাবেই আখ্যায়িত করা হয়েছে; ভাগবতে শ্রীকৃষ্ণের যোগমায়াকে দুর্গা আখ্যা দেওয়া হয়েছে যিনি হরি সহায়িনী তথা হরিভক্তিপ্রদায়িনী। এইসমূহ ছাড়াও দুর্গাদেবীর বর্ণনা মহাভারতের বিরাট পর্ব ও অন্যান্য পুরাণে পাওয়া যায়।
গণপুর এর মণ্ডল পরিবারের পুজোর বয়স প্রায় ১০০০ বছর ।অবাক হচ্ছেন? হিসেবটা বীরসিংহের পরিবারের পূজার বয়সের থেকেও অনেক বেশি তাই না? গনপুরের উদ্ভবের থেকেই এখানে মন্ডলদের বাস ছিল। তাদের হাত ধরেই পট দুর্গাপূজাও প্রায় ১০০০ বছর অতিক্রম করেছে ……চৌধুরী পরিবারের পূর্বপুরুষ উবীনচাঁদের মাতা ছিলেন মন্ডল বংশের কন্যা। ইতিহাস বলে তিনি স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে এখানে বাস করতে আসেন । তিনি সেসময় এক সাধকের কাছে লক্ষীনারায়ন পেয়েছিলেন । লক্ষ্মীনারায়ণের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুকুর খনন করতে গিয়ে বেশ কিছু সম্পত্তি পান। জমিদারি চালু করেন । মন্ডল বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে অকিঞ্চন চৌধুরীর পূজা চালু রাখতে সাহায্য করেছিলেন এ কারণেই হয়তো চৌধুরীবাড়ির বলির পর মন্ডল বাড়িতে বলি হয় । এখনও এই প্রথা রয়েছে। মায়ের পাকা মন্দির আছে ।এর ভিতরেই পট রক্ষিত থাকে। এখন যে পট দেখা যায় তা দীর্ঘদিনের সংরক্ষিত। এটি এঁকে দিয়েছিলেন মল্লারপুরের শিল্পী নিহার রায় ।বর্তমানে পূজার তিনটি শরিক। পূজায় তাদের এক একজন করে চারদিন ভাগ থাকে ।বলিদান হয় প্রত্যেকদিন ।সপ্তমীতে সাদা পাঁঠা, অষ্টমীতে সাদা পাঁঠা, নবমীতে কালো পাঁঠা এবং দশমীতে যেকোনো রঙের পাঁঠাবলি হয়। পট রক্ষিত থাকে।
বীরভূমে প্রখ্যাত গ্রাম গুলির মধ্যে হেতমপুর । সেখানের বিখ্যাত পূজা হল মুন্সি পরিবারের পটের দুর্গা পূজা । এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কুচিল সেন। কিন্তু হেতমপুরের মহারাজ চক্রবর্তী মহাশয় ( ১২৭৬ থেকে ১৩৯০ বঙ্গাব্দ) কুচিল সেনের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ঈশান মুন্সি।কারন হেতমপুরের রাজ বংশের অন্যতম পুরোধা পুরুষ বিপ্রচরণ চক্রবর্তীর এক কাকা ছিলেন কুচিল নামে। তাই তার নাম সম্বোধন করা যুক্তিযুক্ত নয় বিবেচনা করে এই নাম পরিবর্তন করা হয়। সেই থেকে এই পরিবারকে মুন্সি পরিবার নামে সবাই চিনে থাকে । সাড়ে তিনশ বছর আগে সেই ঈশান মুন্সি ওরফে কুচিল সেন পটের দুর্গা পূজার সূচনা করেন। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় রচিত বীরভূম বিবরণ ও কিশোরীলাল সরকারের হেতমপুর কাহিনী গ্রন্থের অবলম্বনে দেখা যায় কিছু মতানৈক্য। একটি তথ্য থেকে জানা যায় কুচিল সেনের আদি বাড়ি ছিল বোলপুরের নিকট সাত্তোর গ্রামে। তিনি ছিলেন রাজনগরের রাজা মুন্সি। সন্তুষ্টহয়ে’ রাজা জমিদারি দান করতে চাইলে তিনি হেতমপুরকে বেছে নেন। এই তথ্যেরও অসঙ্গতি আছে। হরেকৃষ্ণ বাবুর তথ্য অনুযায়ী তিনি হেতমপুরের রাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তীর মুন্সি ।
সে যা হোক, কুচিল বা ঈশান মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে পূজা শুরু করেন এবং এর পরে পরেই মুন্সি পরিবারের রমরমা শুরু হয়। মুন্সিবাড়ি চত্বরে মায়ের স্থায়ী পাকা মন্দির রয়েছে।সেখানে সারাবছর মায়ের পুজো হয়।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল ইতিপূর্বে রাজ পরিবারের অন্যতম সদস্য রাধানাথের পুত্র গঙ্গাচরণ ১২৪০ বঙ্গাব্দে হেতমপুরে মৃন্ময়ী দুর্গাপূজা প্রতিষ্ঠা করেন। এখনো সে পূজা বর্তমান ।
পূজা পূর্বে পটেই হত । পট তৈরি করতেন কামদেব দে। বর্তমানে পটের জায়গা নিয়েছে কাঠের স্থায়ী মূর্তি ।কারন পট শিল্পের সঙ্গে নিযুক্ত শিল্পী ক্রমশ কমে যাচ্ছে, ছেলেরা চলে যায় ভিন্ন পেশায় ফলে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে । তাই পট ছেড়ে স্থায়ী একটা ব্যবস্থা তারা করে নিলেন । কাঠের দুর্গা মূর্তি তৈরি করেছেন যশপুর পাছিয়াড়া গ্রামের অনিল সূত্রধর। ব্যয় হয় পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা।
মায়ের নামে রয়েছে জমি এবং ব্যাংকে কিছু আমানত।এক সময় সরকার থেকে বার্ষিক অর্থ সাহায্য পাওয়া যেতো ।বর্তমানে তা বন্ধ হয়ে গেছে। বলি আছে। সন্ধিপূজায় একটি সাদা পাঁঠা ও নবমীতে একটি পাঁঠা বলি হয়। বিসর্জনের প্রশ্ন ওঠেনা।
জলন্দি পাল পরিবারের পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো । তবে পূজা শুরু হওয়ার কোন ইতিহাস জানতে পারা যায়না ।পালবাড়ির পূজার বিশেষত্ব হলো চৌদ্দটি পরিবারের ৪০ জন সেবায়েত দ্বারা পরিচালিত হয় এই পূজা। দেবোত্তর কোন সম্পত্তি নেই। সেবায়েত রা নিজ অংশ থেকে পূজার খরচ চালানো হয়। পূজার খরচ মোটামুটি পনেরো হাজার থেকে কুড়ি হাজার টাকা ।
জলন্দির শিল্পীরা পট আঁকেন। বহুপূর্বে হংসেশ্বর সূত্রধর ,ভৈরব সূত্রধর ,হারাধন সূত্রধর, গোবর্ধন সূত্রধর ,প্রফুল্ল সূত্রধর প্রভৃতি শিল্পীগণ পট আঁকতেন। প্রফুল্ল সূত্রধর গত হওয়ার পর এখন পট তৈরি করছেন গৌরাঙ্গ সূত্রধর।এক একজন শিল্পীর আঁকার ধরন স্বতন্ত্র হলেও পটের আদল রক্ষিত হয়। মা সপরিবারে পটে উপস্থিত থাকেন।
জলন্দিতে বোধন হয় মহাষষ্ঠী পূজার ১২ দিন আগে কৃষ্ণা নবমীতে । ঐদিন থেকে প্রতিদিন চন্ডীপাঠ হয় ও ঢাক বাজানো হয়।
মহাষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় প্রত্যেক পূজামণ্ডপ থেকে সেবায়তগন নিজ নিজ পূজামণ্ডপ বাদে বাকি সমস্ত পূজা মন্ডপ থেকে মহাষষ্ঠীর পূজায় বসার অনুমতি নিয়ে এসে পূজা শুরু করেন। পুরো গ্রামে মোট ১০ টি মাটির প্রতিমা ও ২ টি পট পূজা হয়।নবপত্রিকা আনা হয় একসাথে । তবে যাত্রা শুরু হয় পাল বাড়ির মন্ডপ থেকে। প্রথমে থাকে পালেদের দোলা। পাল পুকুরের নবপত্রিকা স্নান হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় অনুরূপ অনুমতি নিয়েই সবাই পূজা শুরু করেন।
বলিদান এখানেও রয়েছে। বোধন ,সপ্তমী ,নবমী , দশমীর দিন চাল কুমড়া এবং অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় কালো রঙের পাঁঠা বলি দেওয়া হয় ।আগে বর্ধমান রাজার বাড়িতে কামানের ধ্বনি শোনার পর বন্দুকের গুলি ফাটিয়ে শব্দ করে “মা মা” ডাক দেওয়ার পর বলিদান হতো। বর্তমানে বর্ধমানের রাজবাড়ীর সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে কামানের ধ্বনি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ে মা মা ডাক দেবার পর বলিদান হয়। বলিদান এর পাল বাড়ির খাঁড়া সাধুদের দুর্গা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় ,এই পূজামণ্ডপে খাঁড়া দেখার পর বলি হয়।
জলন্দি গ্রামে পূজার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিজয়া দশমীর পুজো মণ্ডপের পূজা শেষ করে সমস্ত পূজামণ্ডপের পূজারী ও সেবায় জলেশ্বরীতলা জলেশ্বরীর পূজার জ,ন্য পূজার সামগ্রী এবং বলির জন্য চালকুমড়ো প্রভৃতি নিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে উপস্থিত হন । সেখানে পূজা শেষ হলে সবাই নিজ নিজ মন্ডপে ফিরে এসে পুষ্পাঞ্জলী দেন এবং অপরাজিতা পূজার পর মায়ের ও অন্যান্য দেব দেবীর বিসর্জন হয়। পট বিসর্জন হয় না। সারা বছর এই পট মন্দিরে থাকেন। প্রতিবছর দশমীর দিন বিকালে সেই বছরের নবপত্রিকা ও আগের বছরের পট শিব পুকুরে বিসর্জন হয়।
বীরভূম জেলার কোমা গ্রাম ও সেই গ্রামে হাজরা বাড়ির পটের দুর্গাপূজা বিখ্যাত। ১৬২২ খ্রিস্টাব্দে দিগম্বর চট্টোপাধ্যায় এই পূজার প্রবর্তন করেন ।তিনি জমিদার ছিলেন এই অঞ্চলের। তাঁরর পুত্র গয়ারাম চট্টোপাধ্যায় কে হাজারটা মহলের দায়িত্ব দেবার জন্য পরিবারটি হাজরা পদবি লাভ করেন। হাজরা পরিবারে পরবর্তী পুরুষ ব্রজলাল হাজরার তিন পুত্র রক্ষাকর হাজরা, সতীশচন্দ্র হাজরা ও উদয় হাজরা। তার মধ্যে উদয় হাজরা সন্ন্যাসী হয়ে চলে যাবার সময় সতীশচন্দ্রকে সম্পত্তি দিয়ে যান। ফলে দুবছর সতীশ পক্ষের এক বছর রক্ষার পক্ষে পালি হয় পূজার । বর্তমানে কোমা গ্রামে পুজোর ৫ শরিক। পরিবারের সম্পত্তি একটি প্রাচীন তাম্রফলক ছিল। এখন সেটি হারিয়ে গেছে।
রক্ষাকরের বংশের এক পুত্র ধর্মদাসের ছেলে দেবীসদয় পরবর্তী ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী গ্রাম গাঙটে আরেকটি পটের পূজার প্রচলন করেন। অন্যদিকে সতীশচন্দ্রের পরবর্তী প্রজন্ম কোমা গ্রামে পূজা চালিয়ে আসছেন। এই পূজার প্রাচীনত্বের প্রমাণ হিসেবে ১১২২ বঙ্গাব্দের একটি প্রাচীন দা আছে। সটি দিয়েই বলির কার্য সম্পন্ন হয়।
পূর্বে সিউড়ির মালীপাড়া থেকে পট আসত, এখন পানুরিয়া গ্রামের বিকাশ দলুই পট আঁকেন। এর আগে ৮ থেকে ১০ বছর বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায় পট আঁকতেন।
মায়ের মন্দির ছিল নুড়ি ইঁটের। এখন তা নতুন করে নির্মাণ হয়েছে।
মহালয়ার অমাবস্যা কাটলে প্রতিপদে প্রথম বারি আসে এবং সেদিন থেকে পুজোর শুরু হয়। বলিদান আছে । অষ্টমীতে ছাগ বলি হয়।সন্ধিপুজোর বলির সময় আগে মাপা হতো পূবের অর্থাৎ পার্বতীপুরের জমিদারদের পূজা, বনশঙ্কা… বাজনা শুনে। এখন ঘড়ি ধরে পঞ্জিকা মতে হয়। দশমী বিসর্জন করে এসে মন্দিরে জয়া বিজয়ার পুজো হয়। পুজোর পরে ছেলেরা হাতে অপরাজিতার ডাল বেঁধে গ্রামের মনসা তলায় গিয়ে পূজা ও বলিদান করেন। পট বিসর্জন হয় পরের বছর দুর্গাপূজার সময় ।গাঙটে যে হাজরা পরিবারের দুর্গাপূজার সূচনা হয়েছে তার পূজার পদ্ধতি ও সব কিছুই কোমার ন্যায়। তবে কোমার পটে যেমন মা সপরিবারে উপস্থিত , তেমন গাঙটের দুর্গাপটে কেবলমাত্র ত্রিশক্তি দেবী অর্থাৎ দুর্গা সরস্বতী লক্ষী উপস্থিত দেখতে পাওয়া যায়। পট বাজার থেকে কিনে আনা হয়।এটি তিন শরিকের পূজা। এখন এখানে চৌধুরীও ঘোষাল পরিবারের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে ।
ইন্দ্রগাছা চট্টোপাধ্যায় পরিবার দুই শরিকের পূজা। এই পরিবারে পূজোর সূচনা ঘটেছিল প্রায় ৪০০ বছর আগে ।মোলপুরের কাছাকাছি কোনো এক স্থানে এক ভদ্রমহিলা এখানে থাকতে । তিনি পূজা করতেন। তাঁর দৌহিত্র বংশের সন্তান হলেন বর্তমান শরিকগন।একবার তিনি অর্থাভাবে পূজা বন্ধ রাখেন। কিন্তু কথিত আছে পূজার দুইদিন পূর্বে স্বপ্নাদেশ পেয়ে ও তালপাতা ঘেরা ঠাকুর ঘরের মধ্যে কিছু টাকা পেয়ে পূজার সূচনা করেন। আগে মূর্তিতে পুজো হত। একশ থেকে দেড়শ বছর আগে তাদের পূর্ব পুরুষের আর্থিক অবস্থা ভীষণভাবে খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেই গড়ন্ত মূর্তি এবং ৮০ বিঘা সম্পত্তির মধ্যে ৬০ বিঘা দত্তদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দত্তরা সে মূর্তি পূজা করে । চট্টপাধ্যায়রা পরে স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজো শুরু শুরু করতে চাইলেন। কিন্তু মূর্তি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তাই পটে পূজা চালু করলেন। পট কিনে আনা হয় বাজার থেকে। বলি হয়। সপ্তমীতে চাল কুমড়ো, অষ্টমীতে ছাগ, নবমীতে চালকুমড়া।
লম্বোদরপুর বৈদ্যপাড়া সরকার পরিবারের পূজা প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে বেশ মতানৈক্য রয়েছে । তবে একথা জানা যায় যে এই পূজা সুদূর অতীতে সাধক স্বামী বিমলানন্দ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি মায়ের দর্শন পেয়ে পূজার সূচনা করেছিলেন । তাঁর প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মায়ের পঞ্চমুন্ডির আসন আজও বর্তমান । সেই আসন এই বর্তমানে দুর্গাপূজা করা হয়। স্বামী বিমলানন্দ পরে এই পূজার দায় ভাণ্ডারীবনের বিশ্বাস পরিবারের হাতে তুলে দেন। বিশ্বাসরা এখান থেকে দেওঘর চলে গেলে সেই পূজার দায় দিয়ে যান সরকার পরিবারের নিকট। সে প্রায় ৩৫০ বছর আগের কথা।শোনা যায় তখন দর্পনারায়ন সরকার মুর্শিদাবাদের নবাবের খাজাঞ্চী ছিলেন। সেই থেকে সেই পূজার দায়িত্ব পালন করে আসছে সরকার পরিবার ।
পরবর্তীতে তাঁদের দৌহিত্র অর্থাৎ সেনগুপ্ত পরিবার পূজার সাথে যুক্ত হন। সরকার ও সেনগুপ্ত পরিবারের বর্তমানে মোট ১১ টি পরিবার এই পূজায় অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বাস পরিবার এখনও আংশিকভাবে যুক্ত। তাঁরা চলে গেলেও সাহায্য পাঠান যথেষ্ট। তাই পূজার ঘট , প্রদীপ বিশ্বাসদের নামে সংকল্প হয়। সেনগুপ্ত পরিবারের নামে কোন সংকল্প হয় না কারণ তাঁরা সরকার পরিবারের দৌহিত্র ।
আগে সিউড়ির মালীপাড়া থেকে পট আসত।পরে গঙ্গাধর সূত্রধর ৪০ বছর ধরে পট আঁকতেন। এর পর জীবধরপুরের নিত্য সূত্রধর পট আঁকতে শুরু করেন। পরে পট আঁকার ভার পান নবকুমার চিত্রকর । এখনো অব্দি তিনি পট আঁকেন। পূজা একাসনে বসে হয় । বর্তমান পূজার খরচ কুড়ি হাজার টাকা। মায়ের নামে কোন রকম জমিজমা-সম্পত্তি দেবোত্তর বিষয় ইত্যাদি নেই । তবে আছে ট্রাস্টি বোর্ডে সরকার ও সেনগুপ্ত পরিবার এবং বিশ্বাস দের সাহায্য। অষ্টমীতে সাদা পাঁঠা বলি থাকলেও সরকাররা বৈষ্ণব হবার কারনে প্রসাদ গ্রহণ করেন না। শ্রীধর নারায়নের মন্দির রয়েছে দুর্গামন্দিরের ঠিক পাশেই।
পূর্বে এখানে মায়ের মন্দির ছিল মাটির । মহাদেব সেনগুপ্ত, সরকার বাড়ির দৌহিত্র , এনার ছেলে দেব প্রসাদ সেনগুপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যখন তিনি ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন তখন মহাদেববাবু মায়ের কাছে মানত করেছিলেন ছেলে বেকসুর খালাস পেলে মায়ের মন্দির বানিয়ে। দেবেন। ছেলে বেকসুর খালাস পান এবং পিতা কোথাও রাখেন তৈরি হয় পাকা মন্দির ১৩৪২ বঙ্গাব্দে । পট বিসর্জন হয় না ।পরের বছর ষষ্ঠীর দিন আগের বছরের পট বিসর্জন হয় অর্থাৎ সারা বছর পর মন্দিরে রক্ষিত থাকেন। নিত্যসেবা হয়।
আমার শেষ পটের দুর্গার কথা আলোচনা করবো মহোদরী গ্রামের পুজো নিয়ে। মহোদরী হলো একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। নন্দীরা হলেন গ্রামের আদি বাসিন্দা। পরে বিশ্বেশ্বর সেন মহোদরীতে এসে জমিদারি কেনেন । ১১৭৫ বঙ্গাব্দে দুর্গাবাড়ি এবং ১১৭৬ এ শিববাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৭৫ বঙ্গাব্দে তিনি দুর্গাপূজা চালু করেন। এটি সেন বাড়ির দুর্গাপূজা । বাড়ির লাগোয়া মন্দিরে এই দুর্গাপূজা এখনো পটেই হয়। সেনদের প্রবর্তিত মৃন্ময়ী দুর্গা পূজাটি এখন গ্রামের সার্বজনীন পূজা ।
সম্ভবত এই পরিবারে নন্দী বাড়ির কোনো কন্যার বিবাহ হয়। তাঁর হাত ধরে এই সেন পরিবারে পটের দুর্গা পূজার সূচনা। বর্তমানে এই পরিবারের পারিবারিক পূজা সাড়ম্বরে পালিত হয় ।সেন পরিবারের পট একসময় আঁকতেন শ সুশীল রুজ। এখন লাভপুরের কাছে পুণ্য গ্রামের মালাকারেরা পট সরবরাহ করেন। পাকা মন্দির আছে। সেখানে সারা বছর পট থাকেন। তবে প্রতি বছরই নতুন পট আঁকা হয়। নিত্য সেবা হয় দুর্গার। দুর্গাপূজার আনুমানিক ব্যয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা । পুরোহিত, ঢাকি আছেন। পূর্বে নহবৎ বসত। তাঁদের সকলকে জমি দেওয়া হয়েছিল পারিশ্রমিক হিসাবে । বর্তমানে কিছু পয়সাও দিতে হয় পারিশ্রমিকের ।কেননা প্রদত্ত জমি থেকে আর তেমন আয় হয় না। সপ্তমীতে চালকুমড়ো ,অষ্টমী ও নবমীতে ছাগ বলি হয়।
মহোদরীতে দুর্গাপুজোর আর এক প্রাচীনতম নাম লোহারাম নন্দী। এই পূজা সেনদের আগমনের পূর্বে প্রতিষ্ঠা বলে কথিত আছে। বর্তমানে এই বাড়ির পূজা ৮ বাড়ির নন্দীতলার পূজা বলে পরিচিত । নন্দীবাড়ির দুর্গা মন্দিরের ভিতরে দেওয়ালে রয়েছে প্রাচীন অশ্ব বাহিনী দেবী দুর্গার রিলিফ। বর্তমানে মূর্তিটি দেয়ালের ফাটল ফেটে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ১২জন শরিক থাকলেও মাত্র ৬ থেকে ৭ জন পালি করে পূজা চালান।সেনরাও শরিক। সেনদের ৮ বছর অন্তর পালি পরে। এছাড়াও রুজ, নাগ পরিবারও এখানে পূজার শরিক। সুশীল রুজ পট আঁকেন। এছাড়াও তিনি অন্য কয়েকটি পূজার পট আঁকেন।
মহোদরীর দুর্গা পূজায় নন্দী বাড়ির প্রাধান্য বোঝা যায় বলি প্রসঙ্গে। বলি প্রথমেই নন্দী বাড়িতে হয়। এরপর সার্বজনীন দুর্গা মন্ডপে , পরে সেন পরিবারে। এভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে একটি সাংস্কৃতিক বৃত্ত।
রুজ বাড়ির পূজা , এটি ছোট বাড়ির পূজা নামেও পরিচিত। প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বছর থাকার পর ২০০৫ সালে আবার শুরু আবার শুরু হয় ….. বর্তমানে তারকনাথ রুজ পরিচালনা করেন, ফলে পূজাটি প্রাণ পেয়েছে। এটি সেন পরিবারের কোন মেয়ে জমিদারি অংশ পেয়ে শুরু করেন। এখানে এ বিষয়টি লক্ষণীয় যে , বলি নেই।
বলির সময় একটি ব্যাপার দেখা যায় এই মহোদরী গ্রামে। মহোদরীর বলির পর পাশের গ্রামগুলিতে বলি হয়। এখানকার বলি সংকেত পেলে তবে গ্রামগুলিতে বলি হয়।মহোদরীর বলির সংকেত পাঠানো হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। ।
যেমন – তাঁতিনাপাড়ার ঘোষ বাড়ির বিশ্বনাথ ঘোষ বলেছেন , মহোদরী থেকে তাঁতিনপাড়া অবধি মোটামুটি ১ কিলোমিটার অন্তর মানুষ এমন করে দাঁড়িয়ে থাকেন যাতে একজন আর একজনকে দেখতে পান। বলি হতেই তাঁরা হাত নামিয়ে সংকেত দেন তাঁতিনা পর্যন্ত। এক্ষেত্রে বলে রাখি তাঁতিনার ঘোষ পরিবারের পূজার বয়স ৭০ বছর মতো। নবমীতে নরনারায়ন সেবা ও আদিবাসী সেবা হয়। পূজার খরচ ১ লক্ষ টাকা। অষ্টমীতে মহোদরীতে বলি হয়ে সংকেত হলে এখানে বলি হয়। আসলে আগে তো ঘড়ির ছিল না । তাই এভাবেই পাশাপাশি গ্রাম গুলি ক্ষন বিচার করত। ঠিক এরম কিন্তু গড়জঙ্গলে শ্যামরূপার থান ও তার পাশের গ্রাম গুলিতে হয়। কথিত আছে আগে নাকি অষ্টমীর সন্ধিপূজার বলির পূর্বে মাটির তলাদিয়ে কামান দাগার গুরু গুরু শব্দ শোনা যেত। বহু প্রাচীন মানুষ তা স্বীকার করেছেন।তাই শুনে বলি হত। তাই শ্যামারূপা থানের বলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাশের গ্রাম গুলি।
আমার রচনায় প্রথম পর্ব থেকে শুরু করে শেষ এই পর্বে বীরভূমের যতগুলো পটের দুর্গা পূজোর কথা উল্লেখ করেছি তাছাড়াও কিন্তু সমগ্র বীরভূমে অজস্র পটের দূর্গা, পটের চালচিত্র তৈরি হয় এবং পূজো হয়। তা এতটাই বড় তার সমীক্ষা ক্ষেত্রের বাইরে চলে যায় ।তবুও যা যা কিছু কিছু নাম সংগ্রহ করা গেছে আমি সেগুলো দিচ্ছি যেমন-
সেন পরিবার কড়িধ্যা, কড়িধ্যার তেঁতুলতলা ব্রজের গ্রামের সরকার পরিবার, লোকপুর দে ( কর্মকার পরিবার) { এনারা ঝাড়খন্ড পাহাড়পুরের বাসিন্দা ছিলেন, সেখান থেকে বারি এনে পূজার শুরু হয়। আগে কাঠের পাটাতনে পট আঁকা হত এখন উপরে গামা কাঠের স্থায়ী মূর্তি তৈরি করা হয়েছে।}, ধর পরিবার লোকপুর, গোবরা চ্যাটার্জি পরিবার ( সিউড়ির মালীপাড়া শুভঙ্কর মৈত্র পট আঁকেন।) , মন্ডল পরিবার বাংলা পাড়া ইন্দ্রগাছা ( তিনশরীকের এই পূজায় অষ্টমীতে তিন বাকুলি হয়। নবমীতে মেষ ও নিজেদের জমির আখ বলি হয়। আখ বলি দেন পরের বছর ভালো ফসলের জন্য। বলি প্রদত্ত আখের ডগার দিকটি গোয়ালে রেখে দেন। ) , ইন্দ্রগাছা সাহা পরিবার, পৈতন্ডী পরিবার সাহাপুর, তাপাইপুর মন্ডল পরিবার, কীর্ণাহার রায় চৌধুরী পরিবার, দ্বারোন্দা গুপ্ত পরিবার ( এনারা কবিরাজ বৈদ্য পরিবার, এনাদের দোলগোবিন্দ কবিরাজ গ্রামে আনেন। পূজা দোলগোবিন্দর ছিল, তিনিই সবকিছুর সঙ্গে পূজাও গুপ্তদের দিয়ে যান। দশমীর দিন বেলপাতায় শ্ৰী দুর্গা নাম লেখার নিয়ম আছে। ), রানীপাথরের চক্রবর্তী পরিবার এবং মুখার্জী ও ব্যানার্জি পরিবার, সিউড়ির মালাকার ,কর্মকার ,দে ও বিষ্ণু বাড়ির পট পূজা।
এছাড়াও বোলপুর থানা এলাকায় পাঁচশোয়া চৌধুরী বাড়ি, গাজিডাঙ্গাল ঘোষ বাড়ি, নাহিনা পাল বাড়ি, ভবানীপুর সরবাড়ি, থুপসারা হাজরা বাড়ি, জশড়া সামন্ত বাড়ি, পারুই থানার বাতিকার সেনগুপ্ত বাড়ি, কড়চাডিহির হাজরা বাড়ি, নানুর থানার কুরুমবাঘোষের ভট্টাচার্য ও মুখপাধ্যায় বাড়িকোল গ্রাম ঠান্ডার বাড়ি চারকোল গ্রাম ঘোষবাড়ি ,চারকোল গ্রামের সরবাড়ি, ডোংরা মন্ডল বাড়ি, নানুর থানার হাজরা বাড়ি, লাভপুুর থানার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ি আবাডাঙ্গা, চক্রবর্তী বাড়ি দোনাইপুুুর, সুগর মিত্র বাড়ি ,গোপ্তার মন্ডল বাড়ি, কলেশ্বর রায়বাড়ি।
রামপুর হাট থানার চট্টপাধ্যায় বাড়ি, মুখোপাধ্যায় বাড়ি বেলিয়া ।এছাড়া আদিত্য মুখোপাধ্যায় রচিত #দুর্গাপট প্রবন্ধের থেকে জানা যায় বীরভূমে প্রায় ৪৫ টির মত দুর্গাপুজো হয়। তাঁর প্রবন্ধে প্রাপ্ত আরো কয়েকটি গ্রামের নাম উল্লেখ করছি চাঁদপাড়া ,কলেশ্বর, রসা, জিউই, খন্ড গ্রাম , মারকোলা।
একৈবাহং জগত্য দ্বিতীয়া কা মমাপরা
পশ্যৈতা দুষ্ট মষ্যেব বিশন্ত্যো মদ্ববিভূতয়াঃ
দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন আদি শক্তি দেবী, যিনি নিত্য কিংবা সনাতনী , তিনি ভাগ হয়ে যান চরিত্রের আপাত ভিন্নতায়। ভাগ হয়ে যান সমাজ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে র , একাধিক রূপে। বেদের উষা সরস্বতী, অদিতি বা পৌরাণিক দুর্গা, চন্ডী তন্ত্রের মধ্যে হয়ে যান জগতধাত্রী, অন্নপূর্ণা, চামুন্ডা , দশমহাবিদ্যা।আবার সেই আদি শক্তিই সকল দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে এসে নেমে আসেন মাটির নিকট নিতান্ত লৌকিক রূপে। তিনি তখন আমাদের গৌরী ,উমা বা মঙ্গলকাব্যের মঙ্গলচন্ডী বা অন্নপূর্ণা। তিনি তখন বন্যপশুর রক্ষীয়ত্রী চন্ডী, তিনি তখন কৃষি জীবী বা বল্লুকা কুলে মাছ ধরা শিবের ঘরণী। তিনি ভালোবাসেন শাঁখা পড়তে। তিনি ধান ভাঙেন, বেতের ধামা কুলো বোনেন, সংসার প্রতিপালন করেন। যোগনিদ্রা হতে তিনি যুক্ত হন গ্রামীন আচার অনুষ্ঠানে, আশা আকাঙ্খায়।ফ্রাই বলেছেন A divine figure বা Earth a female figure….. দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন ভাবনায়। সব কিছুর সমন্বিত চেহারা নিয়েই তিনিই দেবী দুর্গা , আদিমাতা , পৃথিবীমাতা। এক ও অদ্বিতীয়া দেবীরই সাত্ত্বিকী , রাজসী, তামসী শক্তিকে অবলম্বন করে মহালক্ষ্মী , মহাসরস্বতী , মহাকালীর উদ্ভব। এনারা একই আদিশক্তির ত্রিতত্ত্ব।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে মহেঞ্জদারো হরপ্পা সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ , চীন থেকে জাপান মহামাতৃকার আরাধনা করা হত সেই সুপ্রাচীন কাল হতে মহামাতৃকা দেবীর আরাধনা করা হত ইতিহাস পূর্ব কাল হতে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই তিনি বহুরূপে ব্যাপ্ত। কখনো তিনি সিংহবাহিনী সিবিলি, কখনো তিনি যুদ্ধের দেবী সিংহ বাহিনী ইস্তার , কখনো তিনি ব্যাঘ্র বাহিনী সৈন্ধ্বব দেবী। কখনো তিনি গ্রিক শস্যের দেবী দিমিতার। কখনো তিনি জাপানে জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)” ১৮ হাতের দুর্গা ।মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি।ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃ-তান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। কুশান রাজা কনিস্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। তিনি ত্রিশক্তি দেবী রূপে পূজিতা হতেন প্যাগান আরবে লাত, উজ্জা , মানাত।
শাক্ত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরন হয় খ্রিষ্টীয় ৪০০ – ৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। খ্রিষ্টীয় ৪০০ অব্দে রচিত হয় শাক্ত মহাপুরাণের অন্যতম গ্রন্থ দেবীমাহাত্ম্যম্। এই সময়েই মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায়গুলি মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় এই গ্রন্থ। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থেই প্রথম বিভিন্ন নারী দেবতা সংক্রান্ত নানান পুরাণ-কথা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক উপাদানগুলি একত্রিত করা হয়। দেবীমাহাত্ম্যম্ গ্রন্থে বৈদিক পুরুষতান্ত্রিক দেবমণ্ডলীর সঙ্গে সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব নবম সহস্রাব্দ থেকে বিদ্যমান নৃতাত্ত্বিক মাতৃপূজা-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির এক সম্মিলনের প্রয়াস লক্ষিত হয়। এর পরবর্তী হাজার বছর এই ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের হাত ধরে দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশ, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, ভুটান, মালয়েশিয়া ও মঙ্গোলিয়ায়।কম্বোডিয়া আর ইন্দোনেশিয়া দেবী চণ্ডীর মাহাত্ম্য পূজিত হতে শুরু করে হিন্দু ধর্মের প্রসারের সাথে।অ্যাংকর যুগের (১০১০ শতাব্দের) পূর্বে কম্বোডিয়ায় মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পরে হিন্দুধর্মের হাত ধরে। এই সময়ের যে দুর্গা মূর্তিগুলি কম্বোডিয়া থেকে উদ্ধার হয়েছে, অধিকাংশ চতুর্ভুজা এবং মহিষাসুরমর্দিনী। মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী যে এখানে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা বিষ্ণুর ক্ষমতা ধারণ করেছেন যা তাঁর চতুর্ভুজের শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম থেকে প্রতিষ্ঠিত।
জাভা ও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে উদ্ধার হয়েছে অনেক মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির প্রত্নতাত্ত্বিকধ্বংসাবশেষ। এই মূর্তিগুলো মধ্যে প্রাচীনতমর তারিখ অনুমান অষ্টম শতাব্দীর। ইন্দোনেশিয়ার সেন্ট্রাল জাভাতে রয়েছে নবম শতাব্দীর বিখ্যাত হিন্দু মন্দির প্রাম্বানান। এই মন্দিরে রয়েছে এক জগৎবিখ্যাত মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি। একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইন্দোনেশিয়ায় বৃহত্তম হিন্দু মন্দির, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বড় মন্দির প্রাঙ্গণ।১৫শ থেকে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পূর্বদিকে হিন্দু বালিতে মা দুর্গা ছিলেন আরাধ্যা।
মাতৃআরাধনার আদিম ধারাটি আজও আমাদের মধ্যে বহমান। অবশ্য সংযোজন বিয়োজন তো ঘটেই থাকে। কৃষিপূর্ব কাল থদকে এই মাতৃদেবী ই কৃষি সভ্যতার যুগে হয়ে উঠেছিলেন শুভ, শস্য কামনার মূর্ত প্রতীক । তাই তিনি দুর্গা রূপে রনরঙ্গিনী , তিনিই অভয়দাত্রী, শস্যদাত্রী, জ্ঞানদাত্রী। সব এক জায়গায় এসে একাকার হয়ে উঠেছে ।আদিশক্তি হয়ে উঠেছেন বাঙালির ঘরের মেয়ে । তাঁর রূপসজ্জায় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও তাঁর চোখ স্নেহময়ী। আগমনীতে তাঁকে ঘিরেই মায়ের অর্থাৎ বাঙালি সেজে ওঠা। আবার বিজয়াই চোখের জলের ধারা খুলে তাঁকে বিদায় জানানো ।বীরভূমের পটের দুর্গার পূজার ইতিহাস বড় রহস্যময় ।আমি যতটা পারলাম এবং যে সমস্ত লেখকদের বইয়ের কথা উল্লেখ করলাম তাঁদের নিকট কাছে ঋণ স্বীকার করছি। আমি চেষ্টা করেছি আপনাদের কাছে কিছুটা তুলে ধরার। আশা করি আপনারা আরও অনেক বেশী এই ব্যাপারে সন্ধান করবেন এবং আমাকে জানাবেন । সর্বশেষে বলে রাখি পটুয়া বা চিত্রকর সমাজ অভাবের তাড়নায় ধীরে ধীরে অন্য পেশা গ্রহণ করছেন।
গ্লোবালিজেশনের যুগে এখন তো আর এনাদের কদর তেমন নেই অবশ্যই তারা উন্নত হোক তাদের উন্নতি ঘটুক তারা অন্য পেশা গ্রহণ করুক কিন্তু যে ঐতিহ্য সুপ্রাচীন কাল হতে যে ঐতিহ্য আমাদের নিজেদের রক্তে আছে তাকে কোনদিন আমরা ভুলতে দিতে পারি না । তা যেন আমরা ভুলে না যাই।
ভালো থাকুন। #শুভ_বিজয়া।
#সমাপ্ত
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. পটের দুর্গা : বীরভূম
২.পট : বিমলেন্দু চক্রবর্তী