তবে কি নতুন ভাবে ফিরে এল ত্রাস তৈরির পুরনো কৌশল?
বছর কুড়ি আগের আরামবাগ। লোকসভা নির্বাচনের মুখে সেখানকার বাম প্রার্থী বলে দিয়েছিলেন, তিনি কত ভোটে জিতবেন, তা এলাকার ছোট বাচ্চারাও জানে! তত দিনে আরামবাগ, গোঘাট, খানাকুল তো বটেই, লাগোয়া গড়বেতা বা আরও একটু এগোলে কেশপুরেও চালু হয়ে গিয়েছে ‘সাদা থানের সংস্কৃতি’। বাড়ির সামনে একটি নতুন সাদা থান রেখে আসা হত। যার অর্থ: বাড়ির পুরুষ ভোটে লড়লে বা ভোট দিতে গেলে তাঁর স্ত্রীর বৈধব্য অবশ্যম্ভাবী। ত্রাস তৈরির এমন কৌশল নাকি ওই বাম নেতারই উদ্ভাবন— এখনও এই অভিযোগ করেন তখনকার ভুক্তভোগীরা।
২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটে সেই ‘সংস্কৃতি’ই ফের দেখা যাচ্ছে গ্রাম বাংলায়। প্রথমে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর। তার পরে হুগলির ধনেখালি। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
প্রশ্ন উঠছে, তা হলে কি সাদা থান রেখে আতঙ্ক তৈরির কৌশলও হাতবদল হয়ে গেল?
বিজেপি সাংসদ তথা সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের সোজা কথা, ‘‘তৃণমূল বরাবরই সিপিএমের যোগ্য ছাত্র। ওই জমানায় যা চলত, তা-ই শিখেছে তৃণমূল।’’
ধনেখালিতে সাদা থানটি কিন্তু রাখা হয়েছে সিপিএমেরই বাড়ির সামনে। সিপিএমের অভিযোগ, ওই ব্লকের ভাস্তারা পঞ্চায়েতে তাদের প্রার্থী বরুণ গোস্বামীর বাড়িতে রবিবার রাতে তৃণমূলের ১৫-২০ জনের বাইক বাহিনী হামলা চালায়। সিপিএমের ধনেখালি এরিয়া কমিটির সদস্য বরুণের অভিযোগ, ‘‘ওরা জানলার কাচ ভেঙে সেখান দিয়ে সাদা থান ঘরে ঢুকিয়ে দেয়। মনোনয়ন প্রত্যাহার না করলে খুনের হুমকি দেয়।’’ রাতেই পুলিশ ওই বাড়িতে গিয়ে থান নিয়ে আসে। পুলিশ জানিয়েছে, ধনেখালির ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়নি। হলে তদন্ত করা হবে।
এর আগে গত শুক্রবার জয়নগরে প্রায় একই ঘটনা ঘটে। সেখানে বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থীর বাড়ির সামনে সাদা থান, রজনীগন্ধার মালা ও মিষ্টির বাক্স রেখে আসে কেউ। প্রার্থীর বাড়ির লোকজনের দাবি, তৃণমূলের তরফেই এই হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ধনেখালির তৃণমূল বিধায়ক অসীমা পাত্র অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘কারা অভিযোগ করছে? না, সিপিএম! যারা নিজেরাই এক সময়ে ধনেখালিতে বিরোধীদের খুন করেছে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।’’
এই সূত্রেই আরামবাগের প্রাক্তন সাংসদ, প্রয়াত অনিল বসুর কথা উল্লেখ করেছেন শহরের পুরপ্রধান সমীর ভাণ্ডারী। সমীর বলেন, “বাম আমলে অনিল বসুর নেতৃত্বে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর নানা কৌশল ছিল। তার মধ্যে প্রার্থীর বাড়িতে সাদা থান পাঠানো অন্যতম।’’ তৃণমূলের সমীরের স্পষ্ট কথা, ‘‘সেই সংস্কৃতি ফিরে আসুক, চাই না।’’
অনিল বসুর আমলে সিপিএম নেতাদের মধ্যে আরামবাগের মোজাম্মেল হোসেন, গোঘাটের অভয় ঘোষের দাপটও ছিল চোখে পড়ার মতো, বলছেন তৎকালীন বিরোধীরা। মোজাম্মেল অসুস্থ। অভয় বলেন, ‘‘(সাদা থান নিয়ে) অভিযোগ থাকতেই পারে। সত্যতা আমার জানা নেই। প্রার্থী হলে খুন করে ফেলব— এমন ইঙ্গিত আমাদের দিতে হয়নি।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “আমাদের সময়ে এই অভিযোগ উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তারসত্যতা মেলেনি।”
তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের পাল্টা দাবি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এই সংস্কৃতির ‘কপিরাইট’ সিপিএমের। কিছু জায়গায় সিপিএমের লোকজনই এ সব করছে।’’ একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আর সিপিএম থেকে যাঁরা বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁরা এটা শিখতে শুরু করেছেন।’’
দিলীপ ঘোষ অবশ্য পুরো দায় সিপিএমের সঙ্গে তৃণমূলের উপরে চাপিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তখনকার গুণ্ডা, দুষ্কৃতীরা এই জামানাতেও রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তা হলে পরিবর্তন এনে কী লাভ হল?