প্রতিপক্ষের উপর রোলার চালিয়ে দেওয়ার ক্রিকেটীয় দর্শন প্রথম নিয়ে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচের শুরুতেই প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা দেওয়াই লক্ষ্য থাকত স্টিভ ওয়, রিকি পন্টিংদের। অথচ ইংল্যান্ডের বাজ়বল ক্রিকেটের সামনে অ্যাশেজ সিরিজ়ের প্রথম দিন থেকেই রক্ষণাত্মক প্যাট কামিন্সরা।
ফুটবল কোচেরা রক্ষণের দুর্বলতা ঢাকতে বেছে নেন আক্রমণ। বলা হয়, ‘অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স’। অর্থাৎ, আক্রমণই সেরা রক্ষণ। লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষ ফুটবলারদের তাদের অর্ধেই ব্যস্ত রাখা। যাতে রক্ষণের উপর বেশি চাপ তৈরি না হয়। ফুটবল এবং ক্রিকেটের পার্থক্য অনেক। দুই খেলার চরিত্র এক নয়। তবু আধুনিক ক্রিকেট ঝুঁকছে আগ্রাসনের দিকে।
সারা দিন ধরে বল বুঝে বুঝে ব্যাট করার দিন অতীত। অফ স্টাম্পের বাইরের বল মানেই এখন আর অচ্ছুত নয়। মারার বল মারতে হবে। আক্রমণের জন্য বেছে নিতে হবে প্রতিপক্ষ দলের সেরা বোলারদের। প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটারের জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজন হলে তাঁর ব্যর্থতা, দুর্বলতার জায়গাগুলি বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ খেলা জমে ওঠার আগেই খেলা শেষ করে দিতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার এই আগ্রাসী মানসিকতার ক্রিকেট আঁকড়ে ধরেছে ইংল্যান্ড। ব্রেন্ডন ম্যাকালাম টেস্ট দলের কোচ হয়ে আসার পর থেকে এই পথে সাফল্য পাচ্ছেন বেন স্টোকসরা। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অ্যাশেজেও পরিকল্পনা পরিবর্তন করেনি ইংল্যান্ড। তাতেই টেস্ট বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের দেখে কিছুটা কোণঠাসা মনে হচ্ছে। কামিন্সের নেতৃত্বের মধ্যে এমনিতেই অস্ট্রেলীয়দের চেনা খুনে মেজাজের অভাব। ইংল্যান্ডের কিউয়ি কোচ-অধিনায়ক জুটির সামনে যেন আরও ফেকাসে তাঁর নেতৃত্ব।
বিষয়টি নজর এড়ায়নি বিশেষজ্ঞদেরও। পন্টিং তো বটেই, ইংল্যান্ডের অইন মর্গ্যান, অ্যালিস্টার কুক, কেভিন পিটারসেনের মতো প্রাক্তনেরাও বিস্মিত অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণাত্মক মানসিকতা দেখে। কামিন্সের নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন তাঁরা।
পন্টিং বলেছেন, ‘‘মনে হচ্ছে রক্ষণাত্মক পরিকল্পনা করেই মাঠে নেমেছে কামিন্সরা। না হলে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে ফিল্ডার রাখত না। আমি ওখানে ফিল্ডার রাখার পক্ষে নই। অন্তত প্রথম থেকে তো নয়ই। ব্যাটাররা যদি প্রথম থেকেই স্বচ্ছন্দে রান করতে শুরু করলে কোনও ফিল্ডিংয়েই চাপ অনুভব করে না।’’ তাঁকে সমর্থন করেছেন কুক। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেছেন, ‘‘এই দলকে দেখে ঠিক অস্ট্রেলিয়ার বলে মনে হচ্ছে না। ওরা সাধারণত আগুন দিয়েই আগুনের মোকাবিলা করে।’’
এই আগুনটাই অ্যাশেজের প্রথম দিন দেখা যায়নি কামিন্সদের মধ্যে। গত সপ্তাহে টেস্ট বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে দাপুটে জয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই ম্যাচে অজি ক্রিকেটারদের আগ্রাসনের থেকেও বেশি আলোচিত হয়েছিল ভারতীয় দলের ব্যর্থতা। বিশেষ করে ভারতীয় দলের অধিকাংশ ব্যাটার ওভালের ২২ গজে নিজেদের প্রয়োগই করতে পারেননি। সাফল্যে অনেক সময়ই দুর্বলতা ঢেকে যায়। কামিন্সদের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনই হয়েছে। ইংল্যান্ডের কিউয়ি কোচ-অধিনায়ক জুটির রণকৌশলের সামনে চেনা মেজাজে দেখা যাচ্ছে না কামিন্সদের।
মর্গ্যান যেমন বলেছেন, ‘‘প্রথম দিন প্রথম ১ ঘণ্টা ফিল্ডিং সাজানো দেখে মনে হয়েছে, অস্ট্রেলিয়া ভয় পেয়ে গিয়েছে। আমি একটু বিস্মিত। অস্ট্রেলিয়াকে এমন রণনীতিতে দেখা যায় না। বাউন্ডারিতে চার জন ফিল্ডার রাখতে কখনও দেখিনি অস্ট্রেলীয়দের!’’ পিটারসেন বলেছেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়া এত রক্ষণাত্মক! ওদের এ ভাবে ফিল্ডিং সাজাতে কখনও দেখিনি। ওরা সব সময় শুরুতে আঘাত করতে পছন্দ করে। ওরা কি দ্বিতীয় পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করেছে?’’ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের খেলার পরই কামিন্সের নেতৃত্বের সমালোচনা শুরু হয়েছে।
বার্মিংহাম টেস্টে এখনও খেলা অনেক বাকি। প্রথম দিন ৮ উইকেটে ৩৯৩ রান তুলে প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন স্টোকস। অনেকে বলতে পারেন, ৪০০ রান করে রাখার মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা স্বচ্ছায় হাতছাড়া করেছে ইংল্যান্ড। হাতে উইকেট থাকতেও অস্ট্রেলিয়াকে ৪ ওভার ব্যাট করানোর কী দরকার ছিল? ইংল্যান্ড হয়তো চেয়েছে সারা দিন ফিল্ডিং করে ক্লান্ত অজি ওপেনারদের প্যাড, হেলমেট পরে নামিয়ে দিতে। ক্লান্ত শরীর একটা ভুল করে ফেললে ক্ষতি কী? ১টা উইকেট নিয়ে নিতে পারলে দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই চাপে থাকবে প্রতিপক্ষ। আরেকটা যুক্তি আছে। প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া, তারা কতটা আত্মবিশ্বাসী। মনস্তাত্ত্বিক সুবিধার ধার ধারে না ইংল্যান্ড। খেলার নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে। তাই রান বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও পরোয়া করেন না স্টোকসরা। সুযোগ তৈরি করে দেন প্রতিপক্ষকে। নিতে দেবেন কিনা, তা পরের বিষয়! কিছুটা কি অবজ্ঞার ছাপ রয়েছে স্টোকসের ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণার মধ্যে?
আগ্রাসন। আত্মবিশ্বাস। অবজ্ঞা। যে যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুক, ইংল্যান্ডের বাজ়বল দর্শন ক্রিকেট বিশ্বকে ভাবাচ্ছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ভয় পাওয়াচ্ছে। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেন, ঘরের মাঠে সকলেই বাঘ!