পশ্চিমবঙ্গ কেবল একটি প্রদেশের নাম নয়, একটি আস্ত ইতিহাস। পশ্চিম যখন আছে, পূব কোথায় গেলো? কারা নিল? এবার পশ্চিমও কি নিতে চায়?
লিখেছেন কল্যাণ গৌতম ।
২০ শে জুন, পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠা দিবস। বাঙালি হিন্দুর বিজয় দিবস। একটি রথযাত্রার দিন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রথের সারথী। তিনি পশ্চিমবঙ্গের রথ ছুটিয়ে নিয়ে দিল্লিতে চলেছেন। বাংলা মা ভারত মাতায় একাকার হবেন।
পশ্চিমবঙ্গ কেবল একটি প্রদেশের নাম নয়, কেবল পূর্বতন বঙ্গপ্রদেশের পশ্চিমাংশ নয়। পশ্চিমবঙ্গ একটি ভাবনার নাম, পশ্চিমবঙ্গ বাঙালির অস্তিত্বের নাম, পশ্চিমবঙ্গ বাঙালির অস্মিতার নাম, পশ্চিমবঙ্গ এক অবর্ণনীয় ইতিহাসের নাম। মানুষ যখন প্রশ্ন করবে, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ যখন আছে, পূর্ব নিশ্চয়ই ছিল, তা কোথায় গেল? যে বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনে এত বলিদান দিয়েছে, যে বাঙালি এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, নবজাগরণে পথ দেখিয়েছে তারই উত্তরাধিকারের নাম পশ্চিমবঙ্গ।
প্রশ্ন আসবে বাঙালি কারা? বাংলা ভাষায় কথা বললেই কেউ বাঙালি হয়ে যান না। ইংরেজি ভাষায় কথা বললেই কেউ ইংরেজ হয়ে যান? জার্মান ভাষায় কথা বললেই জার্মান হয়ে ওঠেন? বাংলা ভাষায় কথা বললেও তিনি বাঙালি হবেন না। বাঙালি হতে হলে বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে চলতে হয়। এই উত্তরাধিকার কয়েক হাজার বছরের পারম্পর্য। এই ইতিহাসে শ্রীচৈতন্যদেব আছেন; চন্ডীদাস, রামপ্রসাদ, শ্রীরামকৃষ্ণ আছেন; আছেন বঙ্কিমচন্দ্র, স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ, শ্রীঅরবিন্দের মতো মনীষীরা। এই উত্তরাধিকারে দুর্গাপূজা আছে; দোল, জন্মাষ্টমী, গাজন, মনসাপূজা, রামনবমী আছে। এই সামগ্রিকতা যারা ভুলিয়ে দিতে চান, তারা বাংলা ভাষায় কথা বললেও বাঙালি পদবাচ্য নন। যারা সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত অহরহ বিদেশি শব্দভাণ্ডার সঙ্গী করে কথা কন, তাদের ভাষা কী বাংলা?
সাহিত্যে, দর্শনে, বিজ্ঞানে যে বাঙালি দেশের পথ দেখিয়েছে তাকে নিমেষে মুসলিম দেশ করে ফেলার চক্রান্ত হল। এর বিরোধিতা করার ইতিহাস থেকেই পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হল। আন্দোলনের নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন হিন্দু-অস্মিতার নয়নের মণি, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। স্যার আশুতোষ মুখার্জীর সপুত্র; একাধারে শিক্ষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য, আদ্যন্ত সেবাব্রতী, নিঃস্বার্থ এক মানুষ। রাজনীতির বাইরেও তাঁর অনবদ্য ভূমিকা। অথচ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জন্মদিনে একটি মালাও জোটে না! আজ এই বিশেষ দিনে আলোচনা করছি পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার কথা, তাৎপর্যের কথা। আলোচনার পরতে পরতে শ্যামাপ্রসাদের নাম আসবে।
পশ্চিমবঙ্গ দিবসের তাৎপর্য কী? তাৎপর্য হল নির্যাতিত বাঙালি হিন্দুদের জন্য একটি হোমল্যান্ড আদায় করার রোমহষর্ক কাহিনী। কে তার কারিগর? ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। কেন বঙ্গপ্রদেশকে ভাগ করতে হল? উত্তর পাবো ভাগ করার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করে। আর তখনই পশ্চিমবঙ্গ দিবসের তাৎপর্য আমরা খুঁজে পাবো।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী এই পর্বে সার্বিক নেতৃত্ব দিলেন। তখন বাংলার ইতিহাসে তেমন বড় মাপের নেতা নেই। দেশ ত্যাগ করে নেতাজী বাইরে গিয়ে লড়াই করার মাঝে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন, আমরা জানি না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পরলোক গমন করেছেন আগেই। শ্রীঅরবিন্দ পণ্ডিচেরীর সাধন মার্গে বিরাজ করছেন। ১৯৪৭ সালে এই দিনে হিন্দু বিধায়কেরা বাংলাকে ভাগ করে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ গঠনের জন্য ইতিহাস গড়লেন। বিভক্ত ভারতের মধ্যে থেকেই হিন্দু বাঙালির আলাদা বাসভূমি রচনার জন্য নির্বাচনে অংশ নেওয়া। যারা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ভোট দিলেন, হিংস্র মানুষের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেও অনড় থাকলেন তারা বীর-সাধক। যারা তৈরি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দখলদারি বজায় রাখতে নানান কৌশল অনলম্বন করলেন তারা ক্ষীর-খাদক। ক্ষীর-খাদকের সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য দেবার দিন হল ২০ শে জুন, পশ্চিমবঙ্গ দিবস।
এই পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি না হলে কী হত? এই ভূখণ্ড পাকিস্তানে যুক্ত হত অথবা যুক্তবঙ্গে যেত। অতি অবশ্যই পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যেত, নতুবা আলাদা একটি মুসলিম কান্ট্রি হত। আপনারা জানেন স্বাধীন বাংলাদেশের কী পরিণতি হয়েছে। স্বাধীনতা পাবার কয়েক বছরের মধ্যে মুসলমানী রাষ্ট্র হয়ে গেছে। বাংলা মুসলিম সংখ্যাধিক্যে স্বাধীন দেশ হলে জিন্না-সুরাবর্দী প্রমুখ নেতাদের ইচ্ছেয় ‘সাবসিডিয়ারি পাকিস্তান’ হত। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী একেই বলেছিলেন ‘ভার্চুয়াল পাকিস্তান’। তিনি এই ভূখণ্ডটিকে কোনোমতেই পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে দেন নি।
স্বাধীন বঙ্গের নামে ‘বোরখাবৃত পাকিস্তান’ হবার পথেও বাধা দিয়েছিলেন তিনি। জিন্না যখন বুঝলেন কলকাতা সমেত কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না, তখন বঙ্গের মুসলমান নেতাদের দিয়ে ইংরেজ গর্ভনরের পরামর্শে যুক্ত ও স্বাধীন বাংলার নামে ভারত থেকে কেটে দিতে চাইলেন। অনেক চেষ্টা হল, সে এক দীর্ঘ টানাপোড়েনের ইতিহাস। কুচক্রীদের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের মোলাকাতও হয়েছে, তাদের উত্তরাধিকারীদেরও আমরা চিনি। কিছু সুযোগসন্ধানী হিন্দু নেতাও ছিলেন। ভালোভাবে এদের চিনে নেবার দিনটি হল ২০ শে জুন পালনের তাৎপর্য।
পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে গেলে বা স্বাধীন বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হলে অত্যাচারিত বাঙালি হিন্দুর কোথাও স্থান হত না, হয়তো প্রত্ন-ইতিহাসে হিন্দু বাঙালির স্থান হত। এখনও কলকাতায় বসে, রাজ্যের সুরক্ষিত শহরে বসে যে হিন্দু-বাবু-সম্প্রদায় তোষণের চাদর গায়ে দিয়ে শ্যামাপ্রসাদের অহরহ মুণ্ডপাত করেন, তা তাঁরই করে দেওয়া ভূমির উপর। এদের সামনে সত্যের সত্তা লজ্জিত হয়। এদের মনগড়া ইতিহাস পড়তে হয়। এই ইতিহাস এতদিন বাঙালি মানতে বাধ্য হয়েছে, মনে হচ্ছে আগামী দিনে আর মানবে না। বাংলায় প্রবাদ আছে, “যে পাতে খায়, সে পাতেই থুতকায়”, ভাবুন কতখানি অকৃতজ্ঞ হলে মানুষ এটা করতে পারে! বাঙালি হিন্দুর নির্যাতনের ধারাবাহিক ইতিহাস যারা ভুলিয়ে দিয়েছে তারা কী ধাতুতে গড়া!
এককথায় বলা যায় — “খায় দায় পাখিটি, বনের দিকে আঁখিটি।” এদের সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদ নিজেই মন্তব্য করেছিলেন — “নিজেদের একটু ভারতীয় বলে ভাবুন, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
এ রাজ্যের কয়েকটি রাজনৈতিক দল শ্লোগান দেয়, “বাংলা ভাগ করল কে? শ্যামাপ্রসাদ আবার কে?” কিন্তু ওদের দ্বারাই তো “নেপোয় মারে দই” হয়েছে! ওদের বড়বড় নেতাই তো পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নিরাপদ মনে করেন নি। কোটি কোটি অসহায় হিন্দুকে ওদেশে ফেলে চলে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে, বর্তমান ভূখণ্ডে। সেই বাঙালি হিন্দু সামনা করলো লোলুপ নেকড়েদের। অত্যাচারে, অগ্নি সংযোগে, ধর্ষণে, প্রিয়জনের মৃত্যুতে দলে দলে হিন্দু পালিয়ে আসতে বাধ্য হল এপার বাংলায়। ২২ শতাংশ থেকে হিন্দু জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে দাঁড়ালো ৮.৫ শতাংশ। নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের ওই নেতারা ওৎ বসে রইলেন, সীমান্ত ডিঙোনো ভিটেমাটি হারানো উদ্বাস্তুদের একে একে ধরার জন্য। তাদের কাঁধে ভর দিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং দখল হল। কয়েক দশক ধরে বাংলার সংস্কৃতিকে একেবারে পাল্টে দিল তাদের কনসার্ট। শ্যামাপ্রসাদকে ভুলিয়ে দিলেন; তাঁকে ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যা দিলেন। আপনাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে কবি নজরুল ইসলামকে চিকিৎসার যাবতীয় সহায়তা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। নজরুল কিন্তু তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলে মনে করেন নি, তাই তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। চিকিৎসার খরচ জুগিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, স্বাস্থ্যেদ্ধারের জন্য নিজের প্রবাস গৃহে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। বাংলায যে সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সেই ফজলুল হকও তাঁকে সাম্প্রদায়িক মনে করতেন না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন তিনি ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির উচ্চতর পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করেছিলেন। মুসলমান ছাত্রদের নানাভাবে সহায়তা করতেন যিনি, তাঁকেই ওরা সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিলেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “পাপ করেছো রাশিরাশি। ভুগবে কী তোমার মাসিপিসি?” মানুষ যত সত্য ইতিহাস জানছে, মানুষের থেকে ওরা ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এখন আন্দোলনকে অশুভ পথে নিয়ে যাচ্ছে।
দেশ ভাগ হল। দেশ ভাগের সমর্থক ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। “Jinnah got Pakistan, but it was one he called ‘moth-eaten’ because he lost East Punjab and West Bengal.” পোকাকাটা পাকিস্তান জিন্নাকে উপহার দেবার কৃতিত্ব শ্যামাপ্রসাদের। বলা হয়, “He was sucessful in mobilizing the Hindu community for division; Sarat Bose and his allies could not resist.” নেতাজীর দাদা শরৎ চন্দ্র বসু, কংগ্রেসের কিরণ শঙ্কর রায়, মুসলিম লীগের শহীদ সুরাবর্দী প্রমুখর সঙ্গে বাংলার গর্ভনর বারোজের ইচ্ছাও জলে গেল। ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের ইচ্ছেকেও সুকৌশলে পিছনে ফেলে দিলেন শ্যামাপ্রসাদ। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান খন্ডটিকে ভারতে ধরে রাখার রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও জনসমক্ষের আন্দোলনে শ্যামাপ্রসাদ জিতলেন। তাই সংসদে তিনি নেহেরুর মুখের উপর শুনিয়ে দিতে পেরেছিলেন “You divided India, I divided Pakistan.”
“শ্যামাজননীর মহাপ্রসাদ শ্যামাপ্রসাদ”। কবিশেখর কালিদাস রায় কবিতাতে এই মন্তব্য করেছিলেন৷ বাঙ্গলাতে শ্যামাপ্রসাদের আবির্ভাব মহাকালীর প্রলয় নৃত্যের মত। হিন্দু বাঙ্গালিকে বাঁচানোর জন্য; সারা দেশে “এক বিধান, এক নিশান, এক প্রধান” করবার নেতৃত্ব দিয়ে খেসারত দিলেন তিনি। আপন বলিদান দিলেন। মনে পড়বে স্বামী বিবেকানন্দের কবিতা ‘Kali the Mother’ কবিতাটি:
“যে দেয় দুঃখে প্রেম
মৃত্যুকে ধরে বক্ষে
প্রলয় নৃত্যে মত্ত
মা-যে আসে তারই চিত্তে।”
২০ শে জুন বঙ্গবাসীকে এ কথা বারবার মনে করানোর জন্য আসে।
শরৎ-কিরণ-সুরাবর্দীর ‘ভার্চুয়াল পাকিস্তান’
ভোকাট্টা করে আনলো ছিনে মুখার্জীর ওই গান।
যুক্ত-স্বাধীন বাংলার নামে যাবতীয় শয়তানি
বিশে জুন তার সামূহিক বিষ ভাঙ্গিয়া দিল আনি।
পশ্চিমবঙ্গ একটি আশার নাম, পশ্চিমবঙ্গ একটি আশ্রয়ের নাম। এই বাঙ্গলার রূপেই আছে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। এটাই বিশুদ্ধ বাংলা।
আসুন, এক ঝলকে দেখে নিই সেসময় বাংলার পরিস্থিতি কেমন ছিল? কেন ভাগ করতেই হল? ৬০০ বছরের বাংলায় ইসলামি শাসনের ইতিহাস বাঙালি ভোলে নি। সেই ছ’শো বছরে ধ্বংস হয়েছে বাংলার হিন্দু বৌদ্ধ প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির ও প্রতিষ্ঠান। মাঝে ইংরেজ রাজত্বের ২০০ বছরে অনেকটা শান্তির পর ১৯৩৭ সাল থেকে মুসলিম লীগের শাসন, ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগষ্ট শুরু হওয়া কলকাতার বীভৎস দাঙ্গা, তারপর নোয়াখালিতে হিন্দু গণহত্যার পর অখণ্ড ভারতের প্রবক্তা শ্যামাপ্রসাদ বলতে বাধ্য হলেন, ভারত ভাগ হোক বা না হোক, বাংলাকে খণ্ডিত করতেই হবে, তা না হলে বাঙালি-হিন্দু-সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে অমৃতবাজার পত্রিকা গ্যালপ পোলের রেজাল্ট প্রকাশ করেছিল, সেখানে দেখা গেল ৯৮.৩ শতাংশ বাঙালি-হিন্দু সেইসময় বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করছে। ১৯৪৭ সালের ১৫ ই মার্চ কলকাতায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে জানানো হয়, প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ১০৬টি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে তার মাত্র ৬ টিতে বাংলা ভাগের বিরোধিতা করা হয়েছে। এই ভাবনায় সাথী হয়েছিলেন বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। ১৯৪৭ সালের ২২ শে এপ্রিল নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করে বক্তব্য রাখলেন ঐতিহাসিক ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন। সেই বছর ৭ ই মে একটি তারবার্তা সরকারের কাছে পাঠালেন শিক্ষাবিদদের একটি দল, তাতে সামিল হলেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, ড. শিশির মিত্র, ভাষাচার্য ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়। তারা লিখলেন, বাংলাদেশে একটানা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে এবং শিক্ষা, ব্যবসা ও শিল্প ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। নানান সভায় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাজনৈতিক নেতা বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে কথা বললেন।
শ্যামাপ্রসাদের যুক্তি ছিল মুসলিম-গরিষ্ঠ প্রদেশগুলি যদি হিন্দুপ্রধান ভারত রাষ্ট্রে না থাকতে পারে তবে হিন্দুপ্রধান জেলাগুলিই বা ইসলামি পাকিস্তানে যাবে কেন? যে নীতিতে ভারত ভাগ হচ্ছে সেই একই নীতি মেনে পাকিস্তানকেও ভাগ করতে হবে। ভারতের সংলগ্ন হিন্দুপ্রধান জেলাগুলিকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
হালে পানি না পেয়ে অখণ্ড বঙ্গের সমর্থকরা স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গরাষ্ট্র গঠনের ডাক দিলেন। যৌথডাক এলো মুসলিম লীগ নেতা সুরাবর্দী এবং নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু। কিন্তু এই ফাঁদে বাঙালি হিন্দু পা দেয় নি। কারণ সুরাবর্দীর জিঘাংসক ব্যক্তিত্ব তখনও হিন্দুদের কাছে তরতাজা, অমলিন। শরৎ বসু একলা ডাক দিলে কী হত, বলা যায় না, বাঙালি হিন্দু ভুল করলেও করতে পারতো।
পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার দেবার চক্রান্ত ইদানীং কালেও চলেছে। ২০১৬ সালের ২৯ শে আগষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এক বিশেষ অধিবেশনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়কদের ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের নতুন নাম হবে ‘বাংলা’, হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ বা ইংরেজিতে ‘বেঙ্গল’। সিপিএমের এই পরিবর্তনে আপত্তি ছিল না, কারণ এর আগে জ্যোতি বসুর আমলে তারাই ইতিহাস ভুলিয়ে দেবার এই প্রস্তাব এনেছিল। ২০১৮ সালের ১৫ শে জুলাই সব ভাষাতেই ‘বাংলা’ নাম হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই প্রস্তাব বিধানসভায় গৃহীত হয়। যুক্তি ছিল West Bengal নাম থাকলে কেন্দ্রীয় আলোচনায় ইংরেজি বর্ণানুক্রমিকের শেষে সুযোগ পায় পশ্চিমবঙ্গ। অসুবিধা কাটাতে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামটি বাদ যাক, ‘বাংলা’ করা হলে ‘B’-এর কারণে দৌড়ে এগিয়ে যাবে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ আবেদন করতেই পারতো, কেন্দ্রীয় আলোচনায় একবার শুরু হবে ‘A’ থেকে, পরের বার ‘Z’ থেকে। তাহলে তো ইংরেজি বর্ণানুক্রমে কোনে বৈষম্য থাকে না! আসলে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিলো না, ইতিহাস ভোলানোই ছিল কাজ। আলোচনা তো এমন ভাবেও হতে পারতো, রাজ্যের নামগুলি কম্পিউটারে Random পদ্ধতিতে ঠিক হবে। নাম পাল্টিয়ে ‘Paschimbanga’ করা যেতে পারতো, তা কিন্তু তা হল না, অন্য মোটিভ কাজ করছিল। লাখো মানুষের আপত্তিতে এ দুরভিসন্ধি বাস্তবায়ন হয় নি। কিন্তু এটার মধ্যে সততা ছিল না, মানুষ পরিস্কার বুঝতে পেরে গেছিল।
এ প্রসঙ্গে একটি আশ্চর্যজনক ঘটনার কথা উল্লেখ করে আলোচনা শেষ করবো। ২০০০ সালের জুলাই মাসে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বাঙালি অধ্যাপক, যিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে পরে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে সাংসদ হয়ে দিল্লি গিয়েছিলেন, বললেন, “বঙ্গভঙ্গের প্রবক্তাকে যদি আমরা বাঙালির নায়ক বা পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা হিসাবে মানতে চাই, তাহলে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নয়, লাটসাহেব কার্জনকেই আমাদের পুজোর বেদিতে বসিয়ে আরাধনা করা উচিত।” শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে একজন ইতিহাসের অধ্যাপকের এহেন মন্তব্য খুবই কুরুচিপূর্ণ!
স্বদেশী জাগরণ তথা স্বাবলম্বী ভারত গঠনের বর্তমান কালপর্বে দাঁড়িয়ে আপনাদের নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না, ১৯০৫ এবং ১৯৪৭ সালের প্রেক্ষাপট কী ছিল! বঙ্গভঙ্গ হয়েছিল ব্রিটিশদের দ্বারা হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টির জন্য। আর স্বাধীনতার বছরে বঙ্গবিভাগ হয়েছিল মুসলমান আগ্রাসকদের দ্বারা হিন্দুর মান-ইজ্জত ও সম্পত্তি রক্ষার গুরুতর অভিযোগের চিরস্থায়ী সুরাহা করতে। যে ব্যক্তি বাঁদর আর শিবের প্রভেদ বোঝেন না, তাকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই মানায় না; অথচ বিনা প্রশ্নে তিনি সংসদে চলে গেলেন। তাঁরই পূর্বজ শরৎচন্দ্র বসুর অপ্রাপ্তি কী তাকে এই মন্তব্য করতে প্ররোচিত করেছে! না-কি আরও গভীরতম অস্পষ্টতা আছে?
শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন অখণ্ড ভারতের সাধক, তাই অখণ্ড বঙ্গেরও বীজমন্ত্র তিনি জপ করতেন। বঙ্গবিভাগ নিয়ে তখন আলোচনা আন্দোলন চলছে। হিন্দু মহাসভার কয়েকজন যুবকর্মী শ্যামাপ্রসাদের কাছে এলেন। বললেন, দেশ তো বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্দীপিত হয়েছে। আজ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলে সেটা কী স্ববিরোধী হবে না? শ্যামাপ্রসাদ উত্তর দিলেন, “এই সেন্টিমেন্ট আমার ছিল। কিন্তু সেন্টিমেন্ট যেন বাস্তববোধকে আচ্ছন্ন না করে। ১৯৪৫ সালের নির্বাচনে হিন্দু ভোটদাতারা আমাদের কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে। দেশবিভাগে বাধা দেওয়ার শক্তি আমাদের নেই। লক্ষ লক্ষ বিহারী ওড়িশি বাংলায় করে খাচ্ছে। তাই সেখানে বাঙালিরা আছে। গোটা বাংলা পাকিস্তানে পড়লে তাদের ফিরে যেতে হবে। সেখানে তখন বাঙালিরা থাকতে পারবে? কোটি কোটি বাঙালি কোথায় যাবে? কে ঠাঁই দেবে? তাদের সবাইকে ধর্মত্যাগ করতে হবে নিজেদের বাঁচাতে। তাই বাংলার যতখানি সম্ভব রক্ষা করতে চেষ্টা করছি।” তিনি একটি সভায় দাবি করেছিলেন, “If this succeeds, the East Pakistan will virtually perish.” পরবর্তীকালে তাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্রে ভেঙ্গে গেল।