‘মা মহামায়ার মন্দির’, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা মহানগরীর দক্ষিণাঞ্চলে গড়িয়ার মহামায়াতলায় অবস্থিত প্রাচীন একটি শক্তিপীঠ। দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়ার মহামায়াতলার ঐতিহ্যবাহী এই মন্দিরে গত ২২০ বছর ধরে পূজিতা হচ্ছেন স্বপ্নাদেশে আবির্ভূতা দেবী মহামায়া।

লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে (শাসনকাল ১৭৮৬-১৭৯৩) চালু হওয়া সূর্যাস্ত-আইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে কোম্পানির খাজনা দিতে না পারায় জমিদার দুর্গাচরণ দত্ত রায় এর নিলাম হয়ে যাওয়া হরিনাভি ও রায়পুর গ্রাম দুইটি ক্রয় করে জমিদারীর পত্তন করেন ব্রিটিশদের নিমক মহলের দেওয়ান জনার্দন কর চৌধুরীর পুত্র দুর্গারাম কর চৌধুরী।
জনশ্রুতি অনুসারে একদা রাত্রে জমিদার দুর্গারাম কর চৌধুরী এক বীণাবাদনরতা দেবীর নিকট থেকে ‘গঙ্গার জলে নিমজ্জিতা দেবী মহামায়ার বিগ্রহ উদ্ধার করে এনে মন্দির প্রতিষ্ঠার স্বপ্নাদেশ’ পেয়ে পরদিনই নৌকো নিয়ে সেইস্থানে গিয়ে দেখেন পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষালও দেবীর একই স্বপ্নাদেশ পেয়ে একই উদ্দেশ্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তখন দুইজনে একত্রে গঙ্গাবক্ষে ডুব দিয়ে উদ্ধার করেন নিমকাঠের তৈরি দেবী মহামায়ার দারুবিগ্রহ।
জমিদার দুর্গারাম দেববিগ্রহের সাথে উদ্ধার হওয়া দুইটি পাথরখণ্ডের উপরে প্রথমে অস্থায়ীভাবে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পুরোহিত গোরাচাঁদ ঘোষালকে নিত্যপূজার দায়িত্ব প্রদান করেন। এর একটি পাথর এখনও মন্দিরের তুলসীমঞ্চে রাখা আছে। পরবর্তীতে প্রায় ৩৬৫ বিঘা জমি দেবোত্তর করে সেই জমির উপরে ১৮০৩ সালে (১২১০ বঙ্গাব্দে) বিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা পূর্বক জমিদার দুর্গারাম নবনির্মিত মন্দিরে দেবী মহামায়ার দারুমূর্তিটি স্থাপন করেন। দেবীর নামানুসারে এলাকার নাম হয় মহামায়াতলা। এখনো এই মন্দিরে ঘোষাল পরিবার এবং দৌহিত্র চক্রবর্তী ও ব্যানার্জীদের মিলে মোট চারটি পরিবার তিনমাস করে সারা বছর দেবীর নিত্যসেবার দায়িত্ব পালন করেন।

আটচালাশৈলীর মন্দিরের সামনে রয়েছে বিশাল নাটমন্দির। এর পাশেই তুলসীমঞ্চ। গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে পাথরের বেদীর উপরে স্থাপিতা দ্বিভূজা প্রসন্নময়ী দেবী মহামায়ার অপূর্ব সুন্দর দারুবিগ্রহ। মন্দিরটি অনেকবার সংস্কার করা হয়েছে, তাই প্রাচীনত্বের নিদর্শন এখানে তেমনভাবে দৃশ্যমান হয়না। মন্দিরের চারপাশে খোলা প্রাঙ্গণের এক কোণায় রয়েছে গোল করে শানবাঁধানো গোড়াযুক্ত বিশাল বটগাছ। এই গাছের গোড়ায় ভক্তেরা মনস্কামনা পূরণের আশায় লাল ও হলুদ বর্ণের সুতো বেঁধে রাখেন।

নিত্যপূজিতা ‘মা মহামায়ার মন্দির’ প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১২টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সকাল ১০-১২টার মধ্যে পূজা এবং সন্ধ্যা ৬.৩০টায় সন্ধ্যারতি অনুষ্ঠিত হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের প্রতি সন্মান দেখিয়ে তাঁর জন্মতারিখ ২৩শে জানুয়ারি বিশাল আকারে মন্দিরের বাৎসরিক পূজা এবং ভোগ অনুষ্ঠিত হয়। নীলষষ্ঠীর দিনও এখানে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এইসব বাৎসরিক এবং বিশেষ পূজার দিনগুলোতে মন্দির প্রাঙ্গণে দূর-দূরান্ত থেকে আসা প্রচুর ভক্তের সমাগম ঘটে। ভক্তেরা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন এবং সাধ্যমতো পূজা নিবেদন করেন। কাছাকাছি এলাকার ভক্তেরা মানসিক শান্তির জন্য এই মন্দিরে নিয়মিতই যাতায়াত করেন। ভক্তদের বিশ্বাসে অত্যন্ত জাগ্রতা দেবীর কাছে ভক্তিভরে প্রার্থনা করলে তা পূরণ হয়। মন্দিরের পরিবেশও অত্যন্ত নিরিবিলি। এখানে এলে মন শান্ত হয়ে যায় বলেই ভক্তদের বিশ্বাস।
ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে মা মহামায়ারা তিন বোন। প্রথম জন টালিগঞ্জের ‘মা করুণাময়ী’ বড় বোন, দ্বিতীয় জন ‘মা মহামায়া’ মেজ বোন এবং তৃতীয় জন বোড়ালের ‘ত্রিপুরসুন্দরী দেবী’ ছোট বোন।

বাসস্ট্যান্ড বা মেট্রোস্টেশান থেকে কাছে গড়িয়ার বিখ্যাত মহামায়াতলায় এই মন্দিরটি অবস্থিত। গড়িয়া রেলস্টেশন থেকে অবশ্য অটোতে আসতে হয়। গড়িয়া শীতলা মন্দির ও কামালগাজীর মাঝামাঝি স্থানে বড় রাস্তা থেকে একটু ভিতরে মহামায়াতলায় একটা গলির মধ্যে ঘেরা জায়গায় ‘মা মহামায়ার মন্দির’এর অবস্থান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.