ছিলেন মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল; হয়ে উঠলেন ভগিনী নিবেদিতা। ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মযাজকের কন্যা; হয়ে গেলেন হিন্দু বিধবা সাধ্বী রমণীর আদরের ‘খুঁকি’। ছিলেন ব্রিটিশ সাজাত্যবোধে অটুট নারী; হয়ে উঠলেন ভারতীয় জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমের ব্যতিক্রমী অস্মিতা। এ যেন মার্গারেট সত্তাকে একদম ভেঙ্গেচুরে, বিসর্জন দিয়ে হয়ে ওঠা ভারতীয় সন্ন্যাসিনী। স্বামীজি এমন নারীকেই চেয়েছিলেন, “ভারতের নারীসমাজের জন্য, পুরুষের চেয়ে নারীর — একজন প্রকৃত সিংহীর প্রয়োজন। ভারতবর্ষ এখনও মহীয়সী মহিলার জন্মদান করতে পারছে না, তাই অন্য জাতি থেকে তাকে ধার করতে হবে। তোমার শিক্ষা, ঐকান্তিকতা, পবিত্রতা, অসীম ভালবাসা, দৃঢ়তা, সর্বোপরি তোমার ধমনিতে প্রবাহিত কেল্টিক রক্তের জন্য তুমি ঠিক সেইরূপ নারী, যাকে আজ প্রয়োজন।”
ইংল্যান্ডে স্বামীজির সঙ্গে যখন তার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে তখন তিনি আঠাশ বছরের পূর্ণ যুবতী আর বিবেকানন্দ তেত্রিশের এক তরুণ সন্ন্যাসী। শিকাগোয় সফল ধর্মাভিযানের পর ধর্মপ্রচারে এসেছেন ইওরোপে। মার্গারেট তখনই ইংল্যান্ডের এক প্রতিষ্ঠিত, সফল ব্যক্তিত্বসম্পন্না জনপ্রিয় শিক্ষাবিদ; বুদ্ধিদীপ্ত, স্বাধীন চিন্তার অধিকারিণী। কাজেই স্বামীজির সামীপ্যে-সান্নিধ্যে এসে নিজের চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনের জন্য নিজেকে বদলাতে হয়নি; বদলাতে হয়েছিল কেবল আদর্শকে নিজের কর্মক্ষেত্রকে। স্বামীজি হয়ে উঠলেন তাঁর ‘Master’; তিনি প্রভুর কাছে, বলা ভাল, ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। স্বামীজির প্রভাব সম্পর্কে তিনি পরে লিখেছেন, “Suppose he had not come to London that time! Life would have been like a headless dream; for I always knew that I was waiting for something. I always said that a call would come. And I did.”
আবাল্য ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ সত্ত্বেও, চার্চের অধীনে প্রথাগত ধর্মজীবনে সম্পৃক্ত থাকলেও তিনি শান্তির সন্ধান পাননি। অসংখ্য ধর্মপুস্তকে খু্ঁজেছেন ধর্মজীবনের সঠিক পথ। সেই পথ পেলেন ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ত দর্শনের ব্যাখ্যায়। অবশেষে স্বামীজির ডাকে সাড়া দিয়ে স্বদেশ, স্বজন ও প্রতিষ্ঠিত জীবন ছেড়ে ভারত গঠনের কাজে কলকাতায় এসে পৌঁছালেন। দেখলেন দুঃখ-দারিদ্রপূর্ণ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পরাধীন ভারতবর্ষ আর তারই পশ্চাতে উপলব্ধি করলেন আধ্যাত্মিকতার ঐশ্বর্যে পূর্ণ ত্যাগ ও তপস্যাময় মহান ভারত। অতুল্য ভারতের বিপ্রতীপে অভুক্ত ভারত। সেই ভারতকে ক্রমশ ভালবাসতে শুরু করলেন নিবেদিতা। ভারতবর্ষ ও নিবেদিতা মিলেমিশে একাকার হল। ভারতবর্ষের জন্য আক্ষরিক অর্থেই তিনি নিবেদিত। বিশ্বাস করলেন ভারতের কল্যাণই বিশ্বের কল্যাণ; ভারতের আধ্যাত্মিকতাই জগতের পরম পথ; ভারতবর্ষের সেবা মানেই সমগ্র মানবজাতির সেবা।
১৩১৮ বঙ্গাব্দে ‘ভগিনী নিবেদিতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “নিজেকে এমন করিয়া সম্পূর্ণ নিবেদন করিয়া দিবার আশ্চর্য শক্তি আর কোন মানুষে প্রত্যক্ষ করি নাই।” নিবেদিতার মধ্যে একটা প্রবল ব্যক্তিত্বের বল ছিল, যাকে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন ‘যোদ্ধৃত্ব’ রূপে। নিবেদিতার এই তপঃশক্তিকে জানলে স্বামীজির ভারতস্বপ্নকে জানা সম্ভব। যে ভারতবোধ, জাতীয়তাবাদকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন তা তিনি ভারতীয় হিসাবেই করেছেন, বিদেশিনী হিসাবে নয়। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত তাই যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন, “এক বিদেশিনী মহিলার এই ভারতীয় হইয়া যাইবার কাহিনী সভ্যতার ইতিহাসে এক রহস্যময় ঘটনা।” বিখ্যাত বিবেকানন্দ গবেষক শঙ্করী প্রসাদ বসু দেখিয়েছেন ভারতের সংকটকালে আধ্যাত্মিকতা ও স্বদেশসেবার মধ্যে দ্বিতীয়টিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন, কারণ তিনি বিপ্লবের মহাদেবী কালীকে স্বামীজির মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এটিকেই বলা যায়, খ্রিষ্টীয় সংস্কারের উপরে কালীর কৃষ্ণছায়াপাত — এক বৈপ্লবিক রূপান্তরের সূচক।
তাঁর আধ্যাত্মিকতা ও ভারতপ্রেম যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল তার সবচাইতে বড় প্রমাণ অবনীন্দ্রনাথের ‘ভারতমাতা’ ছবিটি। নিবেদিতার ‘Kali the Mother’ গ্রন্থ পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি ভারতমাতার রূপদান করেছিলেন। ভারতবাসীকে তিনি যদি নিজের রক্ত, নিজের ভাই বলে মনে না করতেন, তিনি এইভাবে ভারতের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন না। ভারতের সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবন সাধনে তাঁর আত্মনিয়োগ জাতীয়তাবাদের অন্যরূপ। ধর্মসাধনা, শিক্ষা, সেবা, বিজ্ঞান, শিল্প, ভারতীয়ত্ব, হিন্দুত্ব, স্বাধীনতা আন্দোলন সবধারায় তিনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিলেন, ফলে আলাদা করে তা থেকে মার্গারেট এলিজাবেথ নোবলকে ছেঁকে তোলাই যায় না।
এক ঝলকে ভগিনী নিবেদিতার জীবন:
১৮৬৭ — ২৮ অক্টোবর : উত্তর আয়ারল্যান্ডের টাইরন প্রদেশের ডানগ্যানন শহরে জন্ম। পূর্বনাম: মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। পিতা: স্যামুয়েল রিচমন্ড নোবল (ধর্মযাজক), মাতা: মেরী ইসাবেল; পিতামহ: জন নোবল (ধর্মযাজক)।
১৮৭৭ — দশ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু ; অভিভাবকের দায়িত্বে মাতামহ: হ্যামিলটন (আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা)।
১৮৮৪ — ১৭ বছর বয়সে বিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কেসউইকে শিক্ষয়িত্রীরর পদ গ্রহণ।
১৮৮৬ — রেস্কহ্যাম শহরে ‘সেন্ট মার্কস চার্চ’-এ যোগদান।
১৮৮৮ — আগষ্ট থেকে অক্টোবর: ‘North Wales Guardian’ থেকে ‘Papers on Women’s Right’ বিষয়ক ছ’টি রচনা প্রকাশ।
১৮৯০ — স্কুল শিক্ষকের কাজ নিয়ে লন্ডনের কাছে উইম্বলডনে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু।
১৮৯২ — ইংল্যান্ডের উইম্বলডনে ‘রাসকিন স্কুল’ স্থাপন।
নভেম্বর : মননশীল লেখিকা হিসাবে ‘Research’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ।
১৮৯৫ — নভেম্বর : ২৮ বছর বয়সে লন্ডনে স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ; পিতার ভবিষ্যৎ বাণী স্মরণ, ‘একদিন ঈশ্বরের আহ্বান আসবে।
১৮৯৬ — দ্বিতীয়বার স্বামীজির লন্ডন ভ্রমণের সময় সম্পর্ক সুদৃঢ় হল।
১৮৯৭ — জুলাই: স্বামীজির পত্র পেলেন।
১৮৯৮ — ২৮ জানুয়ারি: ‘মম্বাসা’ জাহাজে ভারতবর্ষে পৌঁছালেন।
২২ ফেব্রুয়ারি: শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে প্রথম দক্ষিণেশ্বরে এলেন।
২৭ ফেব্রুয়ারি: বেলুড়মঠের সাধারণ জন্মোৎসবে যোগদান।
১১ মার্চ: স্টার থিয়েটারে স্বামীজির প্রচেষ্টায় বিদ্বজ্জন মহলে পরিচয় ও বক্তৃতা।
১৭ মার্চ: শ্রীমা সারদার দর্শন লাভ, ‘day of days’.
২৫ মার্চ: স্বামীজি দীক্ষা দিলেন, যজ্ঞের ছাইয়ে ললাটে টিকা পড়ালেন, তিনি ‘নিবেদিতা’ হলেন, ‘জীবনের সবচেয়ে
আনন্দময় সকাল’।
২ আগষ্ট: স্বামীজির সঙ্গে অমরনাথ যাত্রা।
১৩ নভেম্বর: ১৬ নং বোসপাড়া লেনের বাগবাজার বাসভবনে বালিকা বিদ্যালয়ের সূচনা; উদ্বোধক: শ্রীমা
সারদা।
১৮৯৯ — ১৩ ফেব্রুয়ারি: অ্যালবার্ট হলে কালী সম্পর্কে বক্তৃতা, শ্রীরামকৃষ্ণের কালীপুজো আর ব্রাহ্মদের অদ্বৈত ধর্মচেতনা
মেলানোর চেষ্টা। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে বাকযুদ্ধ।
— ব্রাহ্মদের তার বিদ্যালয়ে চা-পানের আমন্ত্রণ।
— কোলকাতায় প্লেগরোগ মহামারী আকার নিলে স্বামীজির নির্দেশে প্লেগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন — নিবেদিতা তার
সম্পাদিকা এবং স্বামী সদানন্দ প্রধান কার্যাধ্যক্ষ। বাগবাজার-শ্যামবাজার অঞ্চলে সেবাকর্মে আত্মনিয়োগ।
২০ জুন: স্বামীজির সঙ্গে পাশ্চাত্যে গমন, সঙ্গে স্বামী তুরীয়ানন্দ।
১৯০০ — ‘Kali the mother’ গ্রন্থ প্রকাশ।
১ নভেম্বর: ইংল্যান্ডের শুভঙ্করী শক্তি সম্পর্কে মোহ ছিন্ন; তিক্ততর হল কণ্ঠস্বর,’ ভারতের ভরসা ভারতেরই
হাতে — ইংল্যান্ডের হাতে নয়।’
১৯০১ — ১১ জানুয়ারি: ইংল্যান্ড থেকে চিঠিতে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের ভন্ডামী ও দু’মুখোনীতির বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষা প্রয়োগ, ‘পৃথিবীর প্রতিটি জাতির প্রতিটি মানুষের স্বাধীনতা চাই।’
১৯০২ — ফেব্রুয়ারি : কলকাতা প্রত্যবর্তন।
— ২ জুলাই: স্বামীজির মহাপ্রয়াণ।
— ১১সেপ্টেম্বর: বক্তৃতা সফর শুরু।
১৯০৩ — ২৮ জানুয়ারি:”Lord Curzon is a dreadful Viceroy.”
সেপ্টেম্বর: “The web of Indian Life”.
১৯০৪ — জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের আঁতুর ঘর সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘ডন সোসাইটি’-তে ভাষণদান।
— পাটনা সভায় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ, “যখন সংগ্রামের আহ্বান আসবে তখন যেন নিদ্রায় মগ্ন থেকো না।”
— বুদ্ধগয়ায় গমন।
— শেষ সপ্তাহে সিস্টার ক্রিস্টিনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আতিথ্যে শিলাইদহে গমন
১৯০৫ — জানুয়ারি: ‘Aggressive Hinduism’ প্রকাশ।
১১ ফেব্রুয়ারি: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত, পরে কার্জনের মিথ্যা বক্তব্যের প্রতিবাদ (১৩
ফেব্রুয়ারি)।
— ইংরেজ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন শুরু, কাশী কংগ্রেসে যোগাদান।
— ৭ আগষ্ট: টাউন হলে প্রতিবাদ সভায় উপস্থিত।
— ১৬ অক্টোবর: বঙ্গবিভাগ কার্যকর দিবসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাবিত মিলন মন্দির প্রতিষ্ঠায় স্যার
তারকনাথ পালিতের সঙ্গে সমর্থন দান।
১৯০৬ — শ্রীরামকৃষ্ণ-শ্রদ্ধেয় গোপাল মায়ের মৃত্যুকালে সেবাযত্ন।
— প্রবল বন্যা ও ভয়ানক মন্বন্তরে সেবাকাজের জন্য পূর্ববঙ্গে গমন, সঙ্গে সমাজসেবী অশ্বিনীকুমার দত্ত।
— ‘The Modern Review’তে লিখলেন, ‘Glimpses of Famine and Flood in East Bengal in 1906’.
— ব্রেনফিভারে আক্রান্ত হয়ে প্রচন্ড অসুস্থ।
— কলকাতা কংগ্রেসের অধিবেশনে কল্পিত জাতীয় পতাকা প্রদর্শন ( রক্তবর্ণ বস্ত্রের উপরে সোনালি সুতো দিয়ে একটি
বজ্র, দু’পাশে লেখা বন্দেমাতরম)।
— ধারাবাহিকভাবে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ।
১৯০৭ — ১২ আগষ্ট: পাশ্চাত্য দেশে গমন, উদ্দেশ্য স্বামীজির চিঠিপত্র ও বক্তৃতা সংগ্রহ।
১৯০৯ — জুলাই: ভারতে প্রত্যাগমন।
— মা মেরীর মৃত্যু।
১৯১০ — ১ ফেব্রুয়ারি: বিখ্যাত বই ‘The Master as I saw Him’ প্রকাশ।
— মে-জুন: সস্ত্রীক জগদীশচন্দ্র বসু ও অন্যান্যদের সঙ্গে কেদারবদ্রী ভ্রমণ।
— ডিসেম্বর: অজন্তা গুহাচিত্র দর্শন, সঙ্গে ইংরেজ শিল্পবোদ্ধা শ্রীমতী হেরিংহ্যাম, নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার,
জগদীশ বসু দম্পতি, গণেন মহারাজ।
১৯১১ — ১৬ জানুয়ারি: স্বামীজি শিষ্যা স্যারাবুলের মৃত্যু।
— ১১ এপ্রিল: কলকাতায় শ্রীমায়ের দর্শন লাভ।
— ৯ অক্টোবর: তাঁর ইচ্ছেতে উইল তৈরি।
— ১৩ অক্টোবর: ৪৪ বছর বয়সে দার্জিলিং-এ জীবনাবসান।
ভারতবাসী নিবেদিতার কাছে কেন ঋণী?
১. ভারতবাসী হিসাবে আমরা তাঁর কাছে জাতীয় শিক্ষাদর্শের ঋণে জড়িয়ে আছি। জাতীয় শিক্ষার সংগ্রামে ও পরিকল্পনা রচনায় যারা সেযুগে অগ্রদূত ছিলেন তাদের অন্যতম ছিলেন নিবেদিতা। প্রকৃত শিক্ষা ব্যতিরেকে যে প্রকৃত ভারতীয় হওয়া সম্ভব নয়, তা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্ত্রী শিক্ষার উজ্জ্বল ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁর স্থাপিত বিদ্যালয় জাতীয় ধারায় নির্মিত প্রথম বিদ্যালয়।
২. নারী শিক্ষার ব্যবস্থা ইউরোপীয় মিশনারীরাও করেছেন, করেছেন ব্রাহ্ম চিন্তাবিদেরাও। তাঁর নারীশিক্ষার মূলসুরটি বাঁধা ছিল ভারতীয় সুকুমারী নারী-আদর্শের সঙ্গে ইউরোপীয় দৃঢ়তা ও দৃষ্টিভঙ্গির মেলবন্ধন। তাঁর শিক্ষা-উদ্যোগ কেবল কর্তব্যবোধের মধ্যে শেষ হবার নয়; অজ্ঞানের জন্য, নিরক্ষর মানুষজনের জন্য গভীর প্রেম ও অন্তরীণ ব্যাকুলতা ছিল তাঁর শিক্ষাদর্শনের পরতে পরতে। জ্ঞানদানের মধ্যেই কেবল শিক্ষাকে সীমিত না রেখে কর্মকান্ডের অন্দরমহলে তার ব্যাপ্যতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই বাগবাজারের অখ্যাত এক গলির মধ্যেই তিনি নির্মাণ করে ফেললেন এক অনন্য শিশুতীর্থ। তাঁর ছাত্রীরা তাঁর কাছে হয়ে উঠল ‘My Child’।তাদের সঙ্গে পড়া পড়া খেলে, হিন্দু সংস্কৃতি ও রীতিনীতিকে বজায় রেখে চলল এক দেশীয় ঢঙের হৃদয়ের উত্তাপ। বানালেন না তোতাপাখির খাঁচা, গাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি বিরাট পরিকল্পনার বিলম্বিত লয়ের শিক্ষা-গান। বরং সামর্থ্যের প্রয়াসে ভারত রূপ পাখির নারী-পক্ষকে অপরিসীম আনন্দে জুড়ে দিলেন।
৩. ভারতবর্ষের দুঃখ দারিদ্রকে উপেক্ষা করে, এদেশের গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুকে সহ্য করে, ইউরোপের সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে হেলায় দূরে সরিয়ে রেখে তিনি ভারতবাসীর সেবা করেছেন। ১৮৯৯ সালে কলকাতার প্লেগরোগ নিবারণে তাঁর কাজ আজও মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দের কাজকে তিনি কেবল তদারকিই করেন নি, নিজেই ঝাঁটা হাতে রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করতে নেমেছেন, মুমূর্ষু রোগীদের নিজে সেবা করেছেন। বানভাসি, মন্বন্তর-দীর্ণ বরিশালে ছুটে গেছেন সেবাসামগ্রী নিয়ে — হত দরিদ্র মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে, একাত্ম হতে।
৪. নিবেদিতা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপোষহীন সংগ্রামী। স্বদেশী আন্দোলনে কতটা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন তার বিবরণ দিয়েছেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘A Nation is Making’ গ্রন্থে। শুধু যে আন্দোলনের জোয়ারে অবগাহন করেছিলেন তাই নয়, অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করতে স্বদেশী পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্যও মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “প্রয়োজন বিশেষে বা স্থলবিশেষে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধ তিনি আবশ্যক মনে করতেন।” বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে তিনি বিপ্লবীদের উৎসাহ দিতেন, তাদের পড়ার জন্য নানান বই দিতেন এবং বিপ্লবী কাজে তাঁর অনুমোদন ছিল।
তথ্যসূত্র
১. সুদক্ষিণা ২০১৫-২০১৬, জন্ম সার্ধশতবর্ষে ভগিনী নিবেদিতা, নন্দন মিলন বীথি, হরিণাভি, কলকাতা।
২. ভারতের নিবেদিতা, জুলাই ২০০২ (৫ম প্রকাশ), রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা।
৩. স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি, ১৪০৪ (দ্বাদশ পুনর্মুদ্রণ), ভগিনী নিবেদিতা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
৪. ভারতের নিবেদিতা, দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত, দেশ, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৬: ২৪-৩৩