রসগোল্লা (Rasgulla) তুমি কার? – এই নিয়ে কবে থেকে গলাবাজি চালিয়েছে বাংলা (Bengal) ও ওড়িশা (Odisha)। শেষমেশ জিতেছে বাংলাই। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে জিআই ট্যাগ পায় রসগোল্লা। তারপর থেকেই ‘বাংলার রসগোল্লা’ স্বীকৃতিকে সম্মান দিতে রসগোল্লা দিবস পালিত হল। বাংলা ও ওড়িশা এই নিয়ে একে অপরকে কব্জির জোর দেখালেও খাবারের ব্যাপারে তাদের অদ্ভুত সহাবস্থান। প্রতিবেশী রাজ্য বলেই এই মিল কিনা কে জানে! তবে ইতিহাস ঘাঁটলে একটা তথ্য জানা যায় যে, সেই কবে থেকে কলকাতায় বসত করেছেন ওড়িয়া রাঁধুনিরা। বাঙালির হেঁশেল থেকে যে একের পর এক স্বাদুপদ ভোজনরসিকদের পাতে উঠেছে, ভুরিভোজ তৃপ্ত হয়েছে, তা এইসব খানসামাদের হাতের কারসাজি।
দশ ঘাটের জল খেয়ে বাঙালি খাবারের ব্যাপারে আজ এ পর্যায়ে। বহুমাত্রিক। কত না সংস্কৃতি এসে মিশেছে এই বাংলার পাড়ে। পারস্য, পর্তুগিজ, বিলিতি, চীনা, দিশি কত ঘাটের রান্নার স্রোত এসে মিলেছে বাঙালির পাতে। খাওয়া-দাওয়ার বৈচিত্র্য তাই বঙ্গ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগে বাংলার খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। পার্সি, তুর্কি, আফগান, আরবরা তখন প্রায় পুরো ভারতের দখল করে রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত। এই রাজ্যবিস্তার করতে করতে নিজেদের অন্যান্য সংস্কৃতিসহ খাবারের অভ্যেসও ঢুকিয়ে দিয়েছে বাংলার প্রান্তরে। এরই মধ্যে আবার পনেরশো শতকে বাংলায় আসে পর্তুগিজরা, ষোড়শ শতকে হানা দেয় ইংরেজরা, ষোড়শের শেষার্ধে প্রবেশ করে ওলন্দাজ আর ফরাসিরা। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ সকল ঘটনা বাংলার রান্নার ভূগোল পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। তাই সময়ে সময়ে যুগে যুগে একেক জাতির খাবারের স্বাদ সানন্দে গ্রহণ করেছে বাঙালি। মোগল আমলে বাংলা ও ওড়িশা একসঙ্গে ছিল। ফলে রান্নার দিক দিয়ে প্রাদেশিকতার প্রভাব তখন যে বাঙালি খানায় পড়েনি, তা বলাই যায়।
চতুর্দশ শতকেই ‘চর্যাপদ’-এর একটি বৌদ্ধ গানে দেখা যায়, বাড়িতে অতিথি এসেছে, অন্যদিকে হাঁড়িতে নেই ভাত তাই বলে কবি বিপদে পড়ে দুঃখ করছেন। কলাপাতায় গরম গরম ঘি আর ভাত দেওয়ার কথা জানা যায় ভট্টাচার্যের বাড়িতে মহাপ্রভুর ভোজনের বর্ণনায়, পঞ্চদশ শতকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে। এ থেকেই প্রমাণিত যে, প্রাচীন যুগ থেকেই ভাত ছিল বাঙালিদের প্রধান আহার্য। বাঙালির হেঁশেলে যে বৈচিত্র্যের ইতিহাস জানা যায়, তাতে ওড়িয়া রাঁধুনিদের (Odissi Chef) প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
উড়িয়া রাঁধুনিদের উড়ে ব্রাহ্মণ-ও বলা হয়ে থাকে
কলকাতা (Kolkata) চিরকালই নানা জাতি, নানা সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যময়। এমনকি খাবার-দাবারেও। কোনো খাবার এসেছে পর্তুগিজদের রান্নাঘর থেকে। আবার কোনোটা মুঘলদের পাকঘর থেকে। আবার কোনো ব্রিটিশ পদ মিশে গেছে বাঙালি রান্নাঘরে। রান্না যখন মিশেছে তখন আবশ্যিকভাবেই মিশেছেন রাঁধুনিরা। সাধারণত খাওয়ার পদটি মনে থাকলেও, সঙ্গত কারণেই পদটির সৃষ্টিকারী অর্থাৎ রাঁধুনির নাম মনে থাকে না আমাদের। কিন্তু তাঁদের সৃষ্টি রসনা আমাদের তৃপ্ত করে এসেছে বংশ পরম্পরায়।
বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রাঁধুনিরাও যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেমন, কলকাতায় ওড়িশা রাজ্য থেকে আসা রাঁধুনিদের একটা বিশেষ চাহিদা রয়েছে আজও। ষাটের দশক থেকে শুরু করে বাঙালি বাড়িতে রাঁধুনি মানেই ধরে নেওয়া হতো তিনি ওড়িশার মানুষ। যদিও আজ কলকাতার যেকোনো খাওয়ার অনুষ্ঠান দখল করে নিয়েছে ক্যাটারাররা। তবে বছর কুড়ি আগে পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার বাঙালি বাড়ির অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হলেই বাড়ির কর্তা হাজির হতেন ভবানীপুরের ওড়িয়া পাড়ায় বা মুদিয়ালি অঞ্চলে। আবার উত্তরের ভোজনরসিক বাঙালি রান্নার ঠাকুরের খোঁজ করতেন বাগবাজারের বিশেষ কয়েকটি গলিতে।
কলকাতার খাদ্যরসিকরা রাঁধুনি বা খানসামাদের শুধু মনেই রাখেননি, তাদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামও দিয়েছেন। যেমন- ছকু খানসামা লেন, চমরু খানসামা লেন, পাঁচু খানসামা লেন, করিম বক্স খানসামা লেন, নিমু খানসামা লেন, মিসরী খানসামা লেন, পিরু খানসামা লেন, গদাই খানসামা লেন রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য।
যেকোনো শহরের রাস্তা বা গলির নাম হয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নামে। কিন্তু কলকাতার খাদ্যরসিকরা রাঁধুনি বা খানসামাদের শুধু মনেই রাখেননি, তাদের নামে বিভিন্ন রাস্তার নামও দিয়েছেন। যেমন- ছকু খানসামা লেন, চমরু খানসামা লেন, পাঁচু খানসামা লেন, করিম বক্স খানসামা লেন, নিমু খানসামা লেন, মিসরী খানসামা লেন, পিরু খানসামা লেন, গদাই খানসামা লেন রাস্তাগুলো উল্লেখযোগ্য। জেনে রাখা ভালো, সেকালে অর্থাৎ ষাটের দশকে যারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়িতে গিয়ে রান্না করতেন, তাদেরকে ঠাকুর বা খানসামা বলা হতো।
প্রতিটি রাস্তার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নামের ইতিহাস। আমহার্স্ট স্ট্রিট এলাকায় একটি গলির নাম ছকু খানসামা লেন। শোনা যায়, কলকাতার সে সময়ের বিখ্যাত এক রাঁধুনি এই গলিতেই তাঁর ডেরা বেঁধেছিলেন। ঠিক তেমনি পার্কসার্কাস এবং বালিগঞ্জের সংযোগ স্থলে চামারু খানসামা লেন। চামারু রাঁধুনি এই অঞ্চলে বসবাস করতেন। বড়ো বড়ো অনুষ্ঠানের মোগলাই খাবার রান্না করার জন্য ডাক পড়ত চামারু খানসামার।
বিহারি রাঁধুনিদেরও কদর কম ছিল না কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালি, যার আগের নাম ছিল খানসামা পাড়া। এখানেও ভিনরাজ্য থেকে আসা, বিশেষ করে ওড়িশা থেকে আসা রাঁধুনিদের একাধিক ডেরা ছিল বলে জানা যায়। নতুন সময় দখল করে নেয় পুরোনো ইতিহাসের অধ্যায়গুলোকে। বিভিন্ন কারণে বদলে যায় পাড়ার নাম, রাস্তা, এমনকি বাড়ির নামও। তবে কলকাতা মনে রেখেছে ভিন রাজ্য থেকে আসা রাঁধুনি বা খানসামাদের।
বাংলার সঙ্গে ওড়িশার খাবারের আত্তীকরণ ঘটেছে অনেক কাল আগে। যেমন বেশ কিছু খাবার মূলগতভাবে একই। শুধুই রেসিপিতে একটু আধটু বদল ঘটেছে। যেমন বাংলার পান্তা ভাত, আর ওড়িশার পোখাল ভাত। পোখাল ভাত হচ্ছে ওড়িয়াদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। দইয়ের সঙ্গে এই ভাত খাওয়া হয়। সঙ্গে থাকে বড়ি ছ্যাঁচা, আলু বা অন্য কোনও ভাজা, আলু সিদ্ধ, মাছ ভাজা, কাঁচালঙ্কা, কাঁচা পেঁয়াজ, আচার ইত্যাদি। মূলত বাঙালিদের পান্তা ভাতই হল ওড়িশার পোখাল ভাত।
দুই প্রতিবেশী রাজ্য বিভিন্ন খাবারের ব্যাপারে এভাবে গলা মেলালেও রসগোল্লা নিয়ে তারা কতই না গলা চড়িয়েছে। যেই জিতুক, মোদ্দা কথা হল দুই রাজ্যের রসগোল্লাই স্বাদে অতুলনীয়। ওড়িশার রসগোল্লা দেখে মনে হয় গাঢ়, স্পঞ্জি নয় এবং অনেকটা মেটে মেটে রং। আর বাংলার রসগোল্লা ধবধবে সাদা, স্পঞ্জি। খাবার আবেগের ব্যাপার। তাই লড়াই নয়। হাতে হাত মিলিয়ে বলতে হয়, পাতে বাংলা কিংবা ওড়িশা-যার রসগোল্লা/খাবারই পড়ুক – মধুরেণ সমাপয়েৎ!