মধুকবি বলেছিলেন, ‘হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন’। সত্যিই তাই। কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিল্পে বাংলা চিরকালই অগ্রণী। তার মধ্যে ঐতিহাসিক ভাবে অন্যতম আলোকজ্জ্বল অংশ হল গ্রামবাংলার কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রশিল্প। পাট, মাটি, গালা, পোড়া ইঁট, এ সমস্তই শিল্পীর হাতের জাদুতে যেন প্রাণ পায়। হয়ে ওঠে নান্দনিক। নিত্য ব্যবহারের সামগ্রী থেকে ঘর সাজানোর উপকরণ, সবেতেই তাদের অবাধ আনাগোনা। সেই মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে এই বাংলাতে গজিয়ে ওঠা সাবাই ঘাসও (Bengal’s Sabai Grass)। সেই ঘাস থেকে তৈরি শিল্পগুণসমন্বিত আশ্চর্য দ্রব্যসম্ভারে আকর্ষিত হচ্ছে সারা পৃথিবী। শুধু শিল্পবেত্তাই নয়, গ্রাম বাংলার অর্থনীতির একটা বড়ো অংশও আবর্তিত হচ্ছে বাংলার সাবাই ঘাসের সামগ্রীকে (Products of Sabai Grass) ঘিরে। সাবাই ঘাসের তৈরি হস্তশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকারও। ২০২১ সালে জিওগ্র্যাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (GI)-এর জন্য উদ্যোগী হয়েছিল রাজ্যের খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ (West Bengal Grameen Shilpa Parshad)।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সাবাই ঘাস জন্মায়। বিশেষত, ঝাড়গ্রাম জেলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে প্রাকৃতিক নিয়মেই জন্মায় সাবাই ঘাস। সুবর্ণরেখা নদীতীরে অবস্থিত প্রান্তিক জনপদ গোপীবল্লভপুর, বেলপাহাড়ি আর নয়াগ্রামের অর্থনীতি আবর্তিত হয় সাবাই ঘাসের তৈরি বিভিন্ন জিনিসকে ঘিরে। বাঁকুড়াতেও প্রসিদ্ধ সাবাই ঘাসের শিল্প।
সাবাই ঘাস সংগ্রহ করে প্রথমে রোদে শুকানো হয়। তারপর সেগুলিকে পাক দিয়ে দড়ি তৈরি করে, তার সাহায্যে তৈরি করা হয় বিভিন্ন শৌখিন নিত্য ব্যবহার্য ও ঘর সাজানোর সামগ্রী। যেমন- ব্যাগ, টেবিল ট্রে, ঝুড়ি, পেন স্ট্যান্ড, পোস্টার ম্যাট, কন্টেনার, পাপোশ, কোস্টার, টেবিল ম্যাট, গয়না ইত্যাদি। প্রতিটি জিনিসকে ভেষজ রঙে ছোপানো হয়। রঙে ছোপানোর পর সেগুলিকে গরম জল দিয়ে ধুয়ে তার পর রোদে শুকনো করা হয়। জিনিসগুলি ১০০ শতাংশ পরিবেশবান্ধব।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর একগুচ্ছ মৃত ঘাসের মত : একদিন সবুজ ছিলাম,/এই আনন্দ নিয়ে হারিয়ে যেতে হবে-’। কিন্তু বাংলার সাবাই ঘাস মরণশীল নয়, বরং চিরন্তন। ব্রিটিশ আমল থেকেই বাংলার সাবাই ঘাসের ব্যবহার প্রচলিত। এখন তা বেড়েছে আরও। সাবাই ঘাসের তৈরি দড়ি থেকে তা এসে পৌঁছেছে ঘর সাজানোর শৌখিন দ্রব্যে। এভাবেই বাংলার কুটিরশিল্প আরও ছড়িয়ে যাক বিশ্বের আঙিনায়।