এদেশে প্রথম আধুনিক চামড়ার জুতোর পথ চলা শুরু হয়েছিল কোন্নগরের বাটা কারখানাতে

Story image

স্কুলের জন্য সাদা কেডস অথবা কালো নিউকাট, ঘরে পরার স্লিপার আর বিয়েবাড়িতে পরার জন্য একজোড়া হাইহিল, ছেলেদের জন্য বুট কিংবা বর্ষায় পরার কিটো, হরেক রকম জুতোর বাহার এখন বাঙালির ঘরে ঘরে। অথচ এমন একটা সময় ছিল, যখন খালি পায়ে গটগটিয়ে চলাই ছিল দস্তুর। কিন্তু ‘ধরণীর মলিন ধূলা’ থেকে পা দু’খানিকে বাঁচাতে বেশিদিন আর খালি পায়ে চলাও সম্ভব নয়। অথচ উপায় বলতে তখন সেই কাঠের খড়ম। কিন্তু খেটে খাওয়া মধ্যবিত্তদের পায়ে ও জিনিস শোভা পায় না।

বাংলার মাটিতে না হলেও, বিদেশে তখন ঘরে ঘরে জুতোর চল। এ প্রচলনের শুরুটা অবশ্য রাতারাতি হয়নি। রীতিমতো আবিষ্কার করে এসেছিল ‘জুতো’। রবি ঠাকুরের ‘জুতো আবিষ্কার’ কবিতাখানি সত্যিই সফল এক্ষেত্রে। মশমশে ভারি গামবুটের জায়গায় চিকন, পেলব হাল্কা জুতো পায়ে উঠবে, এমনটা আগে ভাবেননি কেউ। এ পরিবর্তনের ভাবনাটা টমাস সাহেবর। মুচি পরিবারে জন্ম। পুরো নাম টমাস জে বাটা। বুদ্ধিমান বাঙালি কি নাম শুনে খানিক আঁচ করতে পারছেন বাংলায় জুতোর প্রথম পথচলা কোন কোম্পানির হাত ধরে?  

একঘেয়ে ডিজাইনের বদলে অন্যরকম কিছু করে দেখানো, এই ইচ্ছা থেকেই বাটা কোম্পানির প্রতিষ্ঠা। অস্ট্রো-হাঙ্গারি সাম্রাজ্যের জলিন শহরে ১৮৯৪ সালের ২৪ অগস্ট ছোট একটি কারখানা তৈরি করেন টমাস সাহেব। টমাস সাহেব অবশ্য সেদিন একা ছিলেন না। এই কারখানা তৈরিতে সমান অবদান ছিল তাঁর ভাই এন্তোনিন ও বোন এনার। কারখানার নাম রাখা হয়েছিল ‘টি এন্ড এ বাটা’ ।

এন্তোনিন ও বোন এনার সঙ্গে টমাস সাহেব

“ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান। সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন” -এই লেখার নিচে পোস্টারে ছিল কিছু পেরেকের মতো ছবি। রাস্তায় খালি পায়ে চলতে গেলে পেরেক ফুটে ধনুষ্টঙ্কার বা টিটেনাস হয়ে যেতে পারে, অতএব জুতো পরাই সুরক্ষিত। আর জুতো মানেই বাটা।

কারখানা তো তৈরি হল, লোকবল কই! নিজেই জুতো সেলাই করতেন টমাস সাহেব। উৎপাদন কম, তবে জুতো টেকসই। মনে ধরল অনেকের। ধীরে ধীরে একজন, দুজন করে লোক জুতোর কাজ শিখতে আসতে লাগলেন। বিক্রিবাটাও বাড়তে লাগলো। ফলে চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে লাগলো উৎপাদনও। তারপর ১৮৯৫ সালেই টমাস সাহেবের ভাই এন্তোনিও চাকরি নিয়ে চলে গেলেন, বিয়ে হয়ে গেল বোন এনার। টমাস সাহেব একা পড়ে গেলেন। কিন্তু দমে গেলেন না। টি এন্ড এ বাটাকে টিকিয়ে রাখতে সবরকম ভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।

১৯০৪ সাল। নতুন ধরনের জুতো (Shoe) বানিয়ে কম দামে বাজারে ছাড়া শুরু করলেন টমাস সাহেব। হুড়হুড়িয়ে কোম্পানির নাম বাড়ল। বিক্রি বাড়ল ঝড়ের গতিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য জুতো বানানোর বরাত পেলেন টমাস সাহেব। তাঁর টি অ্যান্ড বাটা (Bata) কোম্পানির নাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে তখনও খুব কম মানুষেরই সামর্থ্য ছিল জুতো কেনার। তেত্রিশ কোটি ভারতবাসীর জন্য মেরেকেটে এক কোটি জুতো আমদানী করা হত জাপান থেকে। ফলে খালি পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যাই বেশি। ১৯২৫ সাল থেকে শুরু হয় এদেশে বাটা কোম্পানিরর জুতো আমদানি। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে আমদানি সেই জুতোর দাম হয় নূন্যতম পাঁচ থেকে সাত টাকা। কিন্ত যেদেশের সাধারণ মানুষের দৈনিক রোজগার তখন মাত্র কয়েক আনা , তাদের পক্ষে তো এই জুতো কেনা সম্ভব নয়। খোঁজ পড়লো ভিন্ন উপায়ের।

একমাত্র এদেশে বসে, এদেশের চামড়া দিয়ে, এদেশের শ্রমিকদের হাতে তৈরি বাটার জুতোই যে বিকল্প পথ দেখাতে পারে, তা ভালোই বুঝতে পারলেন টমাস সাহেব। এতে জুতোর দামও কমবে, এড়ানো যাবে আমদানী শুল্ক। ফলে তা সহজেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারবে সস্তার জাপানী জুতোকে।

সময়টা ১৯৩২ সাল।  কলকাতার একটি আউটলেটে বসেই টমাস সাহেব খোঁজ পেলেন, হুগলি (Hooghly) জেলায় গঙ্গাতীরের কোন্নগর (Konnogar) গ্রামে রয়েছে এক পরিত্যক্ত তেলকল। নাম হাতিরকুল ওয়েল মিল। কলকাতার এন্ডারসন কোম্পানি সেই তেলকল চালালেও, ১৯২৯ সালের গ্রেট ডিপ্রেশনের ধকল সইতে না পেরে তা বন্ধ হয়ে গেছে বছর তিনেক হল। টমাস সাহেব বছর পাঁচেকের জন্য ভাড়া নিলেন কোন্নগরের সেই কারখানাকে। রাতারাতি কলকাতার (Kolkata) গুদাম ঘর এবং অফিস সহ সমস্তকিছু উঠে এলো কোন্নগরের বুকে। সঙ্গে এল চোদ্দজন তরুন চেক সাহেবের জুতো তৈরির টিম। কারখানার দক্ষিণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলোতে থাকতে শুরু করলেন তারা।

বাটা কারখানার বর্তমান চিত্র 

জোর কদমে শুরু হল বাটা কারখানার এদেশের মাটিতে নিজস্ব গতিতে পথচলা। দিনকয়েকের মধ্যেই কারখানা চত্বরের সমস্ত ঝোপ জঙ্গল পরিষ্কার করে বানানো হল ভলিবল কোর্ট। অত্যাধিক উৎসাহের বশে কর্মীরা নিজের হাতেই খুঁড়ে ফেলল এক সুইমিং পুল। ফ্যাক্টরির গেটের উপর বসল বাটার সাইনবোর্ড। কারখানার ঠিক মাঝখানে ঘণ্টা বাজানোর জন্য বসানো হল বড় বড় দুটো লোহার পাত। গঙ্গার তীরে বসলো লোহার জেটি।

অবহেলিত সেই বাংলো

যদিও যত সহজে কারখানার সাজ সরঞ্জাম তৈরি হল, ঠিক ততটা সহজ ছিল সামনের পথটা। প্রাথমিক সমস্যাটা তৈরি হয় ভাষা নিয়ে। চেক সাহেবরা এসেছেন কোন্নগরে, অথচ তারা বাংলা তো দূর, ইংলিশই ঠিক করে বলতে পারতেন না। ফলে নতুন কর্মী নিয়োগ থেকে শুরু করে, খাবার-দাবার জোগাড় করা, বাজার করা থেকে শুরু করে সেলস নেটওয়ার্ক তৈরি করা – প্রতি পদে পদে বাধা পেলেন তারা। এমনকি এদেশে তখন হাওয়াই চটি তৈরি করেও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হল কোম্পানিকে। তবে কিছুতেই থামেনি কোম্পানি, শুরু হল বাংলার মানুষের চাহিদা বুঝে জুতো তৈরির প্রশিক্ষণ। গড়ে উঠল কোন্নগর বাটা ক্লাব। স্থানীয় বহু মানুষকে বিনামূল্যে বাটার জুতো বিতরন করার সাথে সাথে অনুরোধ করা হল সেই জুতো পরে একসাথে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় গিয়ে হাঁটার জন্য। ফলে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে বাটার জুতো চিনতে শিখল। মাত্র এক বছরের মধ্যেই বাটা এদেশের ৮৬ টা শহরে তাদের রিটেল চেন বিস্তার করে ফেলল। কোন্নগরের বুকেও তৈরি হল রিটেল আউটলেট, যদিও তখনও চামড়ার জুতো তৈরি শুরু হয় নি। ১৯৩২ সালের ১২ জুলাই এক প্লেন দুর্ঘটনায় টমাস সাহেব মারা গেলে তাঁর ছেলের হাত ধরে শুরু হয় নতুন যাত্রা। তাঁর চেষ্টায় ১৯৩৩ সালের পয়লা মে কোন্নগরের বুকে তৈরি হল ভারতবর্ষের প্রথম আধুনিক চামড়ার জুতো।

শুধু যে জুতোর ধরণে আধুনিকতা এলো তাই নয়, অভিনবত্বের ছোঁয়া রইলো জুতোর বিজ্ঞাপনেও। “ধনুষ্টঙ্কার হইতে সাবধান। সামান্য ক্ষত হইতে মৃত্যু ঘটিতে পারে। জুতা পরুন” -এই লেখার নিচে পোস্টারে ছিল কিছু পেরেকের মতো ছবি। রাস্তায় খালি পায়ে চলতে গেলে পেরেক ফুটে ধনুষ্টঙ্কার বা টিটেনাস হয়ে যেতে পারে, অতএব জুতো পরাই সুরক্ষিত। আর জুতো মানেই বাটা।

বাটার বাজারে তখন অন্য জাপানি কোম্পানিদের অবস্থা শোচনীয়। ফলে তারা নানাভাবে বাটার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। কিন্তু এরপরও বাটা কারখানা চললো রমরমিয়ে। শোনা যায়,  ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে প্রায় ৩০০ জন কোন্নগরের বাসিন্দা ছিলেন কোম্পানির কর্মী।  ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে স্থান সংকুলান করা দায় হল কোন্নগরে। ১৯৩৪ সালে কলকাতা পোর্ট কমিশনের কাছ থেকে গঙ্গার অপরতীরে নুঙ্গি এলাকায় এক বিশাল জল জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত প্রান্তরকে কিনে নিল বাটা কর্তৃপক্ষ। ২৮ শে অক্টোবর ১৯৩৪ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হল আধুনিক বাটানগরের সূচনা। অবশেষে ১৯৩৬ সালের আগস্ট মাসে শেষবারের মত কোন্নগরকে বিদায় জানালো বাটা কোম্পানি।

বর্তমানে ভগ্নদশা

অবশ্য আজ থেকে বছর দশেক আগেও কোন্নগরের বুকে টিকে ছিল বাটার শেষ অস্তিত্বটুকু। দীর্ঘ সত্তর বছরের পথ চলার ইতি ঘটেছে ঠিকই কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে মরচে ধরেনি কোন্নগরের বাটা কোম্পানির। বাটার প্রসঙ্গ উঠলেই এখন বাটানগরের নাম লোকমুখে বেশি প্রচার পেলেও কোন্নগরের বুকে বাটার এই শুরুর দিনগুলোর কথা আজও রয়ে গেছে কোন্নগরের ঐতিহ্যে। এখনও জি.টি রোড সংলগ্ন ওই এলাকার নাম বাটা মোড়। বাস, অটো অথবা টোটো চালকদের নিরন্তর হাঁকডাকে প্রতিনিয়ত জীবন্ত হয়ে ওঠে পুরাতন স্মৃতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.