শান্তিপুরের ময়ূরপঙ্খি নাও এবং গান

“ আরে, ও কানাই, পার করে দে আমারে
আজিকে মথুরার বিকি দান করিব তোমারে
তুমি তো সুন্দর, কানাই, তোমার ভাঙা নাও
কোথায় রাখব দইয়ের পশরা কোথায় রাখব পা…”

দুলিয়ে দেওয়া সারি গান। এই গানগুলি বাংলার চির সম্পদ। আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলার লোকসাহিত‍্য’ বইতে সারি গানের উল্লেখ করেছেন। কৃষ্ণবিলাস, কৃষ্ণযাত্রা-তেও এই ধরনের গানের উল্লেখ আছে। নৌকাবাইচের সময় এ গান গাওয়া হয়। শান্তিপুরের রাসের অন‍্যতম লোকশিল্প আঙ্গিক হল ময়ূরপঙ্খি নাও বা নৌকা। এই ময়ূরপঙ্খি নৌকার ইতিহাস প্রায় ২৫০-৩০০ বছরের পুরোনো। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারে লেখা ‘ঠাকুমার ঝুলি’তে ময়ূরপঙ্খি গানের কথা উল্লেখ রয়েছে। লোক-গবেষক রফিকূল ইসলাম এই গানকে নিয়েই লিখেছেন ‘ময়ূরপঙ্খি গান’ নামে বই।

ময়ূরপঙ্খি গান মূলত সেখানেই শোনা যায়, যেখানে এই নৌকার উপস্থিতি রয়েছে। মূলত, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে লক্ষ‍্য করা যায় এই নৌকা ও গান। হুগলীর বলাগড় তার মধ‍্যে অন‍্যতম একটি জায়গা। এখানে আজো নৌকা বানানো হয়। স্থানীয়রা বলেন, সিরাজদৌল্লার আমলে এখানে ময়ূরপঙ্খি বজরা তৈরি হত। এখন অবশ‍্য ছোটো-নৌকা, মাছধরার বজরা তৈরি হয়। এই ময়ূরপঙ্খি গান নদীভিত্তিক অবস্থানের নিরিখে গড়ে ওঠা। রাঢ়ের দামোদর নদীতে এই সব শিল্পীদের এখনও দেখতে পাওয়া যায়। গঙ্গা,পদ্মা ইত‍্যাদি নদীতেও ময়ূরপঙ্খি গানের শিল্পীরা রয়েছেন। নদীয়ার শান্তিপুরের রাসকে কেন্দ্র করে শিল্পীরা তৈরি করেন ময়ূরপঙ্খি মঞ্চ বা নাও। শান্তিপুরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। অতীতে হয়তো এই গঙ্গার মধ‍্যেই চলত নৌকার আছাড়ি-পিছাড়ি। দুটি নৌকাকে কেন্দ্র করে চলত কবিয়ালদের গানের লড়াই। এখনো ময়ূরপঙ্খি নৌকাতে উঠেই পালা, গানের আসর জমান ভার বা কবিয়াল সম্প্রদায়ের কবি-গায়করা। আর সেই পালা, গান রচনা হয় মূলত রাজনৈতিক, ধর্মমূলক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিষয়। ব‍্যঙ্গাত্মক, রসাত্মক ভঙ্গিতে গাওয়া হয় এইসব গান। এগুলোকে ময়ূরপঙ্খি গানও বলা হয়।

এক-একটি নৌকায় এক থেকে চারজন পর্যন্ত অবস্থান করে। ভাঙা রাসের শোভাযাত্রায় এই ময়ূরপঙ্খি নৌকাকে শামিল করা হয়। ভ‍্যান বা ছোটো ট্রাকের উপর তৈরি হয় এই নৌকো। অতীতে নদীতে হত, পরবর্তীকালে গরুর গাড়ির উপর বেঁধে রাসে দুটি নৌকাকে পাশাপাশি রেখে এই গানের তরজা চলত। এখন, নৌকার উপর বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় রাসমঞ্চের মতো ছোটো মঞ্চ। এখানে গায়করা ওঠেন মাথায় গামছা বেঁধে। গান করেন একজন, সঙ্গে বাজনদার থাকে একজন। আর একজন পুরুষ দোহারকি করেন মহিলার বেশে এবং নানা ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গী করেন। যিনি দোহারকি করেন, তিনি–“আরে কলির ভার দেখে মাথা যায় ঘুরে…” এই লাইনটি বারবার বলতে থাকেন। 

এই গানের উল্লেখযোগ‍্য শিল্পীরা হলেন– বাবলু সিংহ, বাসুদেব মণ্ডল প্রমুখ। এককালে রাজার বা জমিদারের নানা বিজয়গাথা, রাজনৈতিক আখ‍্যান থেকে সামাজিক নানা কথা উঠে আসত গানের মধ‍্য দিয়ে। এমন কী, জমিদারের বা রাজার শাসনপ্রণালীতে ভুল কিছু ঘটলে, সেটাও বিষয় হয়ে উঠত এ গানে। এই গানে অংশ নেন মহিলারাও। গেয়ে ওঠেন তাদের নিজেদের গান, আত্মমর্যাদার গান, অধিকারের গান। বর্তমানে, যেমন ধরুন ডিমনিটাইজেশান হল, সেই বিষয়টিও এই গানের থিম হয়েছে। 

ময়ূরপঙ্খি নৌকার ইতিহাস খুবই প্রাচীন। বাংলায় চট্টগ্ৰাম, ঢাকা, ময়মৈনসিংহ অঞ্চলে এই নৌকা দেখা গেছে। বাংলার সারি গান, ভাটিয়ালি গান, রাঢ়ের ময়ূরপঙ্খি গানে এই নৌকার উপস্থিতি রয়েছে। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের অলঙ্করণেও ময়ূরপঙ্খি নাও দেখা যায়। ময়ূরপঙ্খি নৌকায় ব‍্যবহৃত হয় বাঁশ, কঞ্চি, খড়ের কাগজ, রঙিন বা রাংতা কাগজ, বাঁধার জন‍্য পাটের সুতলি ইত‍্যাদি। ময়ূরের মতো দেখতে, সামনের দিকে বাঁশের চটা ও কঞ্চি দিয়ে ময়ূরের মাথা, ঠোঁট বানানো হয়। এর উপরে খবরের কাগজের এক-দুই বা তিনটি স্তর করা হয়। পরের ধাপে রাংতা বা রঙিন কাগজ দিয়ে ময়ূরের মতো আদল দেওয়া হয়। বিভিন্ন রঙিন কাগজ দিয়ে আলাদা আলাদা করে ময়ূরে পাখনা তৈরি করা হয়। সত্যনারায়ণ গোস্বামী, বড়ো গোস্বামী-বাড়ির, পাগলা গোস্বামী-বাড়ির লোকেরা এই ময়ূরপঙ্খি নৌকা বানান। এই নৌকাগুলি রাসে অংশগ্ৰহণ করে। ভাঙা রাসের শোভাযাত্রায় বের হয়। শোভাযাত্রায় গান গাওয়া হয়। রাস হয়ে যাওয়ার পরও এই ময়ূরপঙ্খির অবস্থান হয় কোনো চণ্ডীমন্ডপ বা ঠাকুর দালানে। এই নৌকার আসল কাঠামোটি স্থায়ী হয়। প্রতিবার, এর ভাঙা অংশগুলি ঠিক করে ফের নৌকাটি তৈরি করেন শিল্পীরা।

ভাবলে অবাক লাগে, প্রায় তিনশো বছরের একটি লোকশিল্প-আঙ্গিক শান্তিপুরের লোকেরা আজও বহন করে নিয়ে চলেছেন। প্রতিবছর এই নৌকা তারা বানান রাস উপলক্ষে। এই লোকশিল্প-আঙ্গিকটি দেখতে অভূতপূর্ব। একটার পর একটা হলুদ, লাল, সবুজ রঙের কাগজ দিয়ে পেখম আর ময়ূরের গোটা শরীরটা তৈরি হয় গাঢ় নীল রঙের রাংতা কাগজ দিয়ে। বর্তমানে, মার্বেল পেপার ব‍্যবহার হচ্ছে। শিল্পীদের রঙের ব্যবহার দেখলে অবাক হতে হয়। অল্প কয়েকটি রঙে ভরিয়ে তুলেছেন নৌকাটি। 
লোকশিল্প বেঁচে আছে লোক হত লোকে। শান্তিপুরেও ময়ূরপঙ্খি নাও আজন্ম বেঁচে থাকুক সকলের বুকের ভিতর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.