প্লাস্টিকের খেলনা নয়, শিশুদের হাতে পৌঁছে যাক মাটির পুতুলের সম্ভার

Story image

ষষ্ঠী পুতুল

মাস কয়েক আগের এক সকাল। শান্তিনিকেতন সংলগ্ন একটি সাঁওতাল গ্রাম-এর ভেতর দিয়ে হেঁটে আসার সময়ে গ্রামের বাইরের শালবনে এসে থমকে দাঁড়াই একটি দৃশ্য দেখে। এ গ্রামের শিশুরা সকলেই কমবেশি আমার চেনাজানা। দেখি, বনের ধারে সদ্য মঞ্জরিত শাল গাছের ছায়ায় ওরা খেলার আয়োজন করছে। মাটিতে সার বেঁধে সাজানো খেলার উপকরণ। দূর থেকে তত ভালো না বুঝলেও কাছে গিয়ে দেখি শহরের নামী কেকের দোকানের নাম লেখা পলিথিন ব্যাগ, আইসক্রিমের কৌটো, প্লাস্টিকের চামচ, ছুরি আর বিদেশি মদের রঙিন রঙিন ফাঁকা বোতল-শিশি। এ গ্রামে ঢোকার মুখে যে হাট বসে তাতে শহুরে মানুষের নিত্য আনাগোনা লেগেই থাকে। তাঁদের আনন্দযাত্রার উদ্বৃত্ত এইসব পলিথিন ব্যাগ, কৌটো তাঁরা ছড়িয়ে রেখে গিয়েছেন শূন্য শালের বনে, খোয়াইয়ের নির্জনতায়। শিশুরা জুটিয়ে নিয়ে এসে খেলাঘর সাজিয়েছে।

শহরের নামী শপিংমল, সাজানো দোকানে শিশুদের খেলার সামগ্রী যেখানে সারে সারে রাখা থাকে, তার গালভরা নাম রাখা হয়েছে, ‘কিডস জো়ন’। সেখানে একটু চোখ বোলালেই দেখতে পাওয়া যায় রংবেরঙের কতরকমের খেলনাপাতির সম্ভার। অধিকাংশই প্লাস্টিকজাত কিংবা প্লাস্টিক পরিবারভুক্ত। আরও আছে কৃত্রিম বিষাক্ত রং, সিন্থেটিক ফাইবার, নানা ধরনের পলিমার ইত্যাদি।

শুভময়ের পুতুল সংগ্রহ

ইপিল-পুনুরা প্রতিভূ মাত্র। আসলে কোনো শিশুর হাতে প্লাস্টিকের খেলনা তুলে দেওয়া পাপ। বোধহয় আজকের দিনে এটা ভাববার এবং মনে করবার সময় এসেছে। বা সময় অনেক আগেই বয়ে গিয়েছে, আমাদের ঘুম ভাঙেনি। দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর জানুয়ারি ২০২৩-এর একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে বার্ষিক তৈরি হওয়া ৩.৪ মেট্রিকটন প্লাস্টিকজাত বর্জ্যের মাত্র ৩০% রিসাইকেল করা হয়। এ তো সামান্য একটি পরিসংখ্যান মাত্র। আরও এরকম কত শত রিপোর্ট আছে। আমরা খোঁজ রাখি সেসব পরিসংখ্যানের? খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক কোথায় যায়? মাটির নিচে? সমুদ্রের জলে? সামুদ্রিক প্রাণীদের পাকস্থলির ভেতরে?

আমরা কিন্তু সেইসব জিনিসই নির্দ্বিধায় তুলে দিই ছোটোদের হাতে। এছাড়াও আরও একটি বিষয় আছে তা হল গিয়ে ‘ব্র্যান্ড’। এই একটি শব্দ আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের সবটুকু জুড়ে এমন জাঁকিয়ে বসে আছে যে একে তাড়ানো মুশকিল। ভোগবাদ এবং সামাজিক অবস্থানমূলক অতি সচেতনতা থেকে জাত এই ব্র্যান্ডভ্যালু আমাদের সবটুকুকে এমন গ্রাস করেছে, যে যদি ব্র্যান্ডের নামে রঙিন পলিথিনে মুড়ে বিষও দেওয়া হয় তাই বুঝি আমরা মহার্ঘ বলে গ্রহণ করবো। পৃথিবী জুড়ে শিশুদের খেলার সামগ্রী তৈরি এবং বাজারজাত করা বড়ো বড়ো ব্র‍্যান্ডের বার্ষিক আয়ের অংকটা একবার দেখলেই আমরা তা ভালো বুঝতে পারবো। অথচ শিশুদের খেলার আনন্দ কখনোই উপকরণের প্রাচুর্যের মধ্যে থাকে না, থাকে তার চারপাশের প্রকৃতি এবং পরিবেশের মধ্যে।

শান্তিনিকেতনের অদূরে পলাশডাঙা গ্রামের বছর তিনেকের ছোট্ট পুনু কিংবা মহিষঢাল গ্রামের খুদে কন্যে ইপিলকে যখন তার দাদু খেলার জন্য মাটির পাখি গড়ে দেন তখন মনে হয় যেন সে কোন এক মায়াবী মানুষের স্পর্শে এই বুঝি পাখিদের ঝাঁক ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাবে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের পুরোনো গলিতে সন্তান কোলে মা পুতুল, হিঙ্গুল/হিম পুতুলষষ্ঠী ঠাকরুণ/যো পুতুলের চোখে মুখে লেগে থাকতে দেখি শরতের অপরাহ্নের আলো। মখদূম পীরের মাজারের দিদি যখন পরম স্নেহে হাতে তুলে দেন একজোড়া মাটির ঘোড়া। বাংলাদেশ থেকে খালাম্মা পাঠান আঙুলে টেপা মাটির কনেবউ। গালার পুতুল,রানি পুতুলরেল পুতুল তো আছেই। এছাড়াও পথে পথে ঘুরে নিজেও সংগ্রহ করি অজস্র মণিমাণিক্য। ছলনের পুতুল, বোঙা হাতি, দেওয়ালি পুতুল এইরকম আরও কত কী!

গালার পুতুল

ইপিল-পুনুরা প্রতিভূ মাত্র। আসলে কোনো শিশুর হাতে প্লাস্টিকের খেলনা তুলে দেওয়া পাপ। বোধহয় আজকের দিনে এটা ভাববার এবং মনে করবার সময় এসেছে। বা সময় অনেক আগেই বয়ে গিয়েছে, আমাদের ঘুম ভাঙেনি। দ্য ইকোনমিক টাইমস-এর জানুয়ারি ২০২৩-এর একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে বার্ষিক তৈরি হওয়া ৩.৪ মেট্রিকটন প্লাস্টিকজাত বর্জ্যের মাত্র ৩০% রিসাইকেল করা হয়। এ তো সামান্য একটি পরিসংখ্যান মাত্র। আরও এরকম কত শত রিপোর্ট আছে। আমরা খোঁজ রাখি সেসব পরিসংখ্যানের? খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক কোথায় যায়? মাটির নিচে? সমুদ্রের জলে? সামুদ্রিক প্রাণীদের পাকস্থলির ভেতরে? 

পুনু-ইপিলরা আগামী। ওদের হাতে এই পাপ তুলে দেবার অধিকার আমাদের নেই। পরিবর্তে স্থানীয় মাটির খেলনা পুতুল তুলে দিন ওদের হাতে। রংহীন, কেবল মেটেরঙা পুতুল। বিষাক্ত রংও নয়। মাটির পুতুল আমাদের গৌরবের। অমূল্য সম্পদ। সেই কোন সুদূর অতীতকাল থেকে এই হাতে গড়া পুতুল মানবসভ্যতার সঙ্গে পায়ে পায়ে পথ চলেছে। পৃথিবীর কত গোপন খবর তার প্রতিটি বিভঙ্গে, রেখায়।

শান্তিনিকেতন সাঁওতাল গ্রামের পাশে এই দূষণ

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে শুধু গাছ লাগিয়ে আর কিচ্ছুটি হবে না। আমাদের বিপদ অনেক রকম। সবদিক থেকেই মার পড়তে শুরু করেছে আমাদের পিঠে। অতএব পরিবেশ রক্ষার সমস্ত দায় গাছেদের একার নয়।

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এবারে পৃথিবী জুড়ে সংকল্প গৃহীত হয়েছে #BeatPlasticPollution (Beat Plastic Pollution)-এর। বিশ্বব্যাপী মানবসভ্যতার সামনে এই পরিবেশ দিবসের সংকল্প যেন এক বিরাট মায়াময় চালচিত্রের মতো, আসুন না প্লাস্টিকজাত দ্রব্য বয়কট করে আমরা শিশুদের হাতে তুলে দিই মাটির পুতুল! সুবিশাল চালচিত্তিরের একটি কোণে আমরা সুন্দরের তুলি হাতে রূপটান দিই।

©শুভময় রায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.