১৭-এ পয়েন্টেই লুকিয়ে করমণ্ডলরহস্য! কী কী বলছে রেলের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট?

করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার কারণ সিগন্যাল ব্যবস্থায় বড়সড় ত্রুটি। বিভাগীয় তদন্তের পর প্রাথমিক ভাবে শনিবার এমন রিপোর্টই জমা পড়েছে রেলের কাছে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই রিপোর্টে বিভিন্ন বিভাগের পদাধিকারিকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর যে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন, সেখানে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য সমস্ত দায় চাপানো হয়েছে সিগন্যাল ব্যবস্থা উপরে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এই লাইনে সিগন্যাল ব্যবস্থা পরিচালিত হয় ‘রুট রিলে ইন্টারলকিং সিস্টেম’-এর মাধ্যমে। যার গোটাটাই স্বয়ংক্রিয়। তবে অতি বিশেষ প্রয়োজনে ‘ম্যানুয়ালি’ও এই ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে নানাবিধ সতর্কতা মানতে হয় সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীকে। এই ‘রুট রিলে ইন্টারলকিং সিস্টেম’-এ বড়সড় ত্রুটির কারণেই দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেস। যা পরে বেলাইন হয়ে পিছন থেকে ধাক্কা মারে বাহানগা বাজার স্টেশনের লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মালগাড়িকে। একই সঙ্গে বেলাইন হওয়া করমণ্ডলের কয়েকটি কামরা গিয়ে পড়ে পাশের ডাউন লাইনে এবং বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের সঙ্গে পাশাপাশি সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় শনিবার দুপুর পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ২৮৮ জন। যার জন্য প্রাথমিক ভাবে রেল দায়ী করছে সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটিকেই।

অনেকে আবার তুলছেন রক্ষণাবেক্ষণের প্রশ্ন। এই সন্দিগ্ধু অংশের মতে, বন্দে ভারত এক্সপ্রেস নিয়ে মোদী সরকার এতটাই ‘সক্রিয়’ যে, আপাতদৃষ্টিতে ‘সাধারণ’ ট্রেন এবং তাদের চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে একটা গাফিলতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গোটা দেশের প্রতিটি রাজ্য থেকে অন্তত একটি করে বন্দে ভারত এক্সপ্রেস চালানোর কথা কেন্দ্রীয় সরকারের। সেই কাজ জোরকদমে চলছে। বেশ কয়েকটি বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ওই ‘সেমি হাইস্পিড’ ট্রেনটি তৈরি এবং তা চালানোর বিষয়টি যথেষ্ট ব্যয়বহুল। রেল বাজেটে যার ‘প্রভাব’ পড়েছে। তবে এ নিয়ে এখন প্রকাশ্যে কেউই মুখ খুলতে রাজি নন। পুরোটাই অনুমানভিত্তিক। বিস্তারিত তদন্ত না হলে এমন কোনও বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউই আঙুল তুলতে চাইছেন না।

Coromandel Express was derailed due to signal failure says Rail.

রেলের এক সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবারই বাহানগা বাজারে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলের বিভিন্ন বিভাগীয় দফতরের আধিকারিকেরা। তাঁরা একটি প্রাথমিক রিপোর্ট রেলকে জমা দেন। হাতে-লেখা সেই রিপোর্টেই উল্লেখ করা হয়েছে সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটির কথা। বাহানগা বাজার স্টেশনে সব মিলিয়ে চারটি রেললাইন রয়েছে। একটি হাওড়া থেকে চেন্নাইমুখী ‘আপ মেন লাইন’। একটি হাওড়ামুখী ‘ডাউন মেন লাইন’। অন্য দু’টি এই দুই মেন লাইনের সমান্তরালে থাকা ‘আপ লুপ লাইন’ এবং ‘ডাউন লুপ লাইন’।

শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ ‘আপ মেন লাইন’ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেসের। প্রায় একই সময়ে ‘ডাউন মেন লাইন’ দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের। রেলের একটি সূত্রের দাবি, ওই দু’টি ট্রেনের কোনওটিরই বাহানগা বাজার স্টেশনে দাঁড়ানোর কথা নয়। তাই ‘থ্রু’ চলে যাওয়ার জন্য দু’টি ট্রেনেরই সিগন্যাল দিয়েছিলেন স্টেশনের সহকারী স্টেশনমাস্টার। তার আগেই তিনিই প্যানেল থেকে সিগন্যাল দিয়ে তার আগে দু’টি মালগাড়িকে ‘ডাউন’ ও ‘আপ’ লুপলাইনে দাঁড় করিয়েছিলেন। সঠিক সময়ে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ও বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস বাহানগা বাজার স্টেশনের কাছাকাছি আসে। সিগন্যাল সবুজ দেখে দু’টি ট্রেনই নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যায়। রেলের ওই সূত্রের দাবি, এর পরেই আপ মেন লাইনের ‘১৭এ পয়েন্ট’ থেকে লুপ আপ লাইনে ঢুকে পড়ে করমণ্ডল। তার পর সেটি সজোরে ধাক্কা মারে ওই লুপ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ির পিছনে। বেলাইন হওয়া করমণ্ডলের অন্তত ১৭টি বগি ছিটকে পড়ে এ দিক-ও দিক। তার ইঞ্জিন উঠে যায় মালগাড়ির ওয়াগনের উপরে। রেল জানিয়েছে, ঠিক তখনই ডাউন মেন লাইনে ঢুকে পড়েছিল বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস। বেলাইন হওয়া করমণ্ডলের কয়েকটি কামরা সেই লাইনের উপর গিয়ে পড়ে। তার জেরে বেঙ্গালুরু-হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসের দু’টি কামরা বেলাইন হয়ে যায়।

রেলের কাছে যে প্রাথমিক রিপোর্ট জমা পড়েছে, তাতে এই ‘১৭এ’ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। রিপোর্টের একাংশে বলা হয়েছে, ১৭এ নম্বর পয়েন্ট থেকেই করমণ্ডল মেন আপ লাইন থেকে ঢুকে পড়ে লুপ লাইনে। অথচ তা হওয়ার কথা ছিল না। তার পরেই ট্রেনটি গিয়ে ধাক্কা মারে মালগাড়ির পিছনে। চেন্নাইমুখী সিগন্যাল ‘সবুজ’ (যে ক্ষেত্রে লুপ লাইনে ঢোকার কোনও কথাই নয়) থাকার পরেও কী ভাবে করমণ্ডল লুপ লাইনে ঢুকে পড়ল, সে প্রশ্ন তুলছেন রেলের কর্মীদের একাংশ। রিপোর্ট বলছে, ঘটনাস্থলের ১৭এ পয়েন্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গিয়েছে, ওই পয়েন্টটি লুপ লাইনে ঘোরানো ছিল। ফলে করমণ্ডল ঢুকে পড়ে লুপ লাইনে। একই সঙ্গে ওই রিপোর্টের অন্য একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘প্যানেল’-এ (যেখান থেকে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি দেখা যায় এবং রেকর্ড করা থাকে) কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। প্যানেল দেখে ওই পরিদর্শক কমিটির সদস্যদের মনে হয়েছে, সিগন্যাল ঠিক ভাবেই দেওয়া হয়েছিল দু’টি ট্রেনের জন্যই। প্যানেলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, করমণ্ডলের সিগন্যাল বা পয়েন্ট কোনও ভাবেই আপ লুপ লাইনে ঘোরানো ছিল না। বরং তা সোজা চেন্নাই যাওয়ার জন্য সঠিক ভাবে দেওয়া হয়েছিল।

রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, ১৭এ পয়েন্ট ঘোরানো ছিল আপ লুপ লাইনে। আর প্যানেলে বলছে লুপ লাইনে নয়, সোজা যাওয়ার সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল করমণ্ডল এক্সপ্রেসকে! তা হলে কোনটি ঠিক? পয়েন্ট না প্যানেল? কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পয়েন্টটি লুপ লাইনে ঘুরে থাকার ফলেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেই সঠিক তথ্য কেন প্রতিফলিত হল না প্যানেলে অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায়? তা হলে ত্রুটি কোথায়? পয়েন্টে না প্যানেলে? এখান থেকেই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন তুলছেন রেলকর্মীদের একাংশ। অন্য একাংশ আবার সন্দিহান— সিগন্যাল ব্যবস্থায় ‘ম্যানুয়ালি’ কোনও ‘হস্তক্ষেপ’ হয়নি তো? সিগন্যাল স্বয়ংক্রিয় ভাবে কাজ না করলে ম্যানুয়ালি ব্যবস্থা করা যায়। এ ক্ষেত্রেও তেমন কিছু কি করা হয়েছিল? হয়ে থাকলে পয়েন্টের বিষয়টি কি কোনও ভাবে নজর এড়িয়ে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট রেলকর্মীদের? যদিও এই তত্ত্ব মানতে নারাজ সিগন্যাল নিয়ে অভিজ্ঞরা। তাঁদের মতে, পয়েন্ট ঠিকঠাক না-থাকলে লাইনের সিগন্যাল নেওয়ারই কথা নয়। লাল বাতি কখনওই সবুজ বা হলুদ হবে না। সেই সূত্রেই ‘অন্তর্ঘাত’-এর সম্ভাবনার কথাও তুলছেন কেউ কেউ। তবে তা একান্তই তদন্তসাপেক্ষ। বিস্তারিত তদন্ত না-হলে সেই তত্ত্ব মানা হবে না। উচ্চ পর্যায়ের সেই তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে কবে সেই তদন্ত শেষ হবে, তা অবশ্য কেউই বলতে পারছেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.